• রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ৫ জৈষ্ঠ ১৪২৯

অপরাধ

স্পিরিট আর রং মিলেমিশে হয়ে যাচ্ছে বিদেশি মদ

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১

পুরান ঢাকার মিটফোর্ড থেকে আনা স্পিরিটের সঙ্গে পানি, রং আর কিছু কেমিক্যাল মেশানোর পর মুহূর্তেই তৈরি হয়ে যাচ্ছে বিদেশি মদ। এসব ভেজাল মদ বিভিন্ন নামিদামি ব্র্যান্ডের বোতলে করে গ্রাহকপর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছে।

মজার বিষয়, এক বোতল এ ভেজাল মদ তৈরি করতে খরচ পড়ে মাত্র ৩০ থেকে ৫০ টাকা। অথচ গ্রাহক পর্যায়ে এর দাম ছয় থেকে সাত হাজার টাকা পর্যন্ত। বর্তমান বাজারে চাহিদার তুলনায় বিদেশি মদের জোগান কমে যাওয়ার সুযোগটি কাজে লাগিয়ে এভাবেই ভেজাল মদের রমরমা বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে একটি চক্র।

সম্প্রতি রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মদপানে বেশ কয়েকজনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। ধারাবাহিক এসব ঘটনার জেরে ধরেই তদন্তে নামে পুলিশ। একটি ঘটনার সূত্র ধরে রাজধানীর ভাটারা থানার খিলবাড়িরটেক এলাকায় ভেজাল মদ তৈরির ওই কারখানার সন্ধান পায় মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। গত সোমবার রাতে ডিবির গুলশান বিভাগের পরিচালতি এক বিশেষ অভিযানে ওই কারখানা থেকে বিপুল পরিমাণ ভেজাল মদ ও মদ তৈরির বিপুল সরঞ্জামসহ ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তাররা হলেন-মনতোষ চন্দ্র অধিকারী ওরফে আকাশ (৩৫), রেদুয়ান উল্লাহ (৩৫), সাগর বেপারী (২৭), নাসির আহমেদ ওরফে রুহুল (৪৮), মো. জাহাঙ্গীর আলম (৪৫) ও সৈয়দ আল আমিন (৩০)।

ডিবি পুলিশ জানায়, গত কয়েক দিনে মদপান করে অসুস্থ হয়ে রাজধানীর ভাটারা থানা এলাকায় তিনজন ও মোহাম্মদপুর এলাকায় দুজনের মৃত্যু হয়। তদন্তে দেখা যায়, নিহত ব্যক্তিরা যে মদ পান করেছিলেন, সেসব ওই কারখানাতেই তৈরি হয়েছিল।

যেভাবে তৈরি হচ্ছিল ভেজাল মদ : খিলবাড়িরটেক এলাকার একটি বাসার দোতলায় ভেজাল মদের এ কারখানায় সহজেই তৈরি হচ্ছিল বিভিন্ন নামিদামি ব্র্যান্ডের ভেজাল মদ। এ ভেজাল মদ তৈরির মূল উপকরণ স্পিরিট, যা আনা হতো পুরান ঢাকার মিটফোর্ড এলাকা থেকে। পরিমাণমতো স্পিরিটের সঙ্গে পানি, রং, চিনির সিরা আর কিছু কেমিক্যাল মিশিয়ে নিমিশেই প্রস্তুত করা হতো এ মদ।

এদিকে পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকা ও হকারদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হতো বিভিন্ন বিদেশি মদের বোতল। রাশিয়ান, স্কটিশ, সুইডিশসহ বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মদের বোতলে ভেজাল মদ পুরে ছিপির ওপরে মোমবাতি দিয়ে প্লাস্টিকের লেবেল লাগিয়ে দেওয়া হতো। স্বাভাবিকভাবে যা দেখে বোঝার উপায় নেই মদটি নকল কি না।

গ্রেপ্তারদের বরাত দিয়ে ডিবি পুলিশ জানায়, এক গ্যালন স্পিরিট দিয়ে ৫০ থেকে ৫৫ বোতল মদ তৈরি করা হতো। যেকোনো দামি ব্র্যান্ড বলে বাজারজাত করা প্রতি বোতল এ মদ তৈরিতে খরচ হতো মাত্র ৩০ থেকে ৫০ টাকা। কারখানা থেকে চক্রটির নিয়োজিত ডিলারের কাছে বিক্রি হতো ২২০০ থেকে ২৫০০ টাকায় আর ভোক্তাপর্যায়ে প্রতি বোতল এ মদ বিক্রি হতো ছয় থেকে সাত হাজার টাকায়।

ভাঙারি ব্যবসায়ী থেকে মদ তৈরির কেমিস্ট : গ্রেপ্তার জাহাঙ্গীর আলমের বাড়ি চাঁদপুর। একসময় তিনি ভাঙারি দোকানের কর্মচারী ছিলেন। প্লাস্টিক ও কাঁচের বোতল সংগ্রহ করে মিডফোর্ডে বিক্রি করতেন। পড়ালেখা না জানা এ জাহাঙ্গীরই বনে যান মদ কারখানার প্রধান কেমিস্ট। যিনি গত প্রায় তিন মাস ধরে কারখানাটিতে ভেজাল মদ তৈরি করছিলেন। বিনিময়ে প্রতিদিন তিনি ৫০০ টাকা পেতেন।

বারটেন্ডার থেকে মদ কারখানার মালিক : এ চক্রটির মূলহোতা ও ভেজাল মদ তৈরির কারখানার মালিক নাসির আহমেদ ওরফে রুহুল। তিনি একসময় বিভিন্ন বারে বারটেন্ডার হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরেই অবৈধভাবে মদ বিক্রি করে আসছিলেন। আগে একটি মদের বোতল থেকে দুই থেকে তিনটি বোতল তৈরি করে বিক্রি করতেন। বর্তমানে বাজারে মদের সংকট তৈরি হওয়ায় নিজেই গড়ে তুলেছেন মদ তৈরার কারখানা।

যেভাবে কারখানার সন্ধান

গত কয়েক দিন মদপান করার পর অসুস্থ হয়ে ভাটারা থানা এলাকায় তিনজন, ক্যান্টনমেন্ট থানা এলাকায় একজন ও মোহাম্মদপুর থানা এলাকায় দুজনসহ মোট ছয়জনের মৃত্যু হয়। এসব মৃত্যুর ঘটনায় দায়ের করা মামলার পরিপ্রেক্ষিতে ছায়া তদন্ত শুরু করে ডিবি গুলশান বিভাগ। তদন্তে ক্যান্টনমেন্ট থানা এলাকায় মদ সেবনে মৃত্যুর ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, দুজন ব্যক্তি মোটরসাইকেলযোগে এসে এক বোতল মদ ভিকটিমকে দিয়ে চলে যায়। যা সেবন করে পরবর্তীতে ভিকটিমের মৃত্যু হয়। একপর্যায়ে ওই দুই ব্যক্তিকে শনাক্ত করতে সক্ষম হয় ডিবি পুলিশ। গত ২৮ জানুয়ারি রেদুয়ান ও মনতোষ মোটরসাইকেলযোগে গত ২৮ জানুয়ারি এক বোতল মদ দিয়ে গিয়েছিল ওই ব্যক্তিকে। তাদের গতিবিধি অনুসরণ করে গত সোমবার রাত পৌনে ৯টায় তেজগাঁওয়ের ইয়ানতুন চাইনিজ রেস্টুরেন্টের সামনে থেকে মনতোষ, রেদুয়ান ও সাগরকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ভাটারা থানার খিলবাড়িরটেক এলাকার ভেজাল মদ তৈরির ওই কারখানায় অভিযান চালানো হয়। সেখান থেকে কারখানার মালিক নাসির, ম্যানেজার আল আমিন ও জাহাঙ্গীরকে গ্রেপ্তার করা হয়।

ডিবি গুলশান বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মশিউর রহমান বলেন, এ চক্রের মূলহোতা নাসির দীর্ঘদিন ধরেই চড়া মূল্যে বিদেশি মদের নামে ক্রেতাদের হাতে বিষ তুলে দিচ্ছেন। একজন ভাঙারি ব্যবসায়ীর হাতে প্রস্তুতকৃত এ ভেজাল মদ খুচরা ও পাইকারি বিক্রেতার মাধ্যমে সেবনকারী পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়ার বিষয়টি দেখতেন ম্যানেজার আল আমিন।

ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, ভেজাল মদের এ কারখানাটি থেকে গত এক সপ্তাহে ২৩১ বোতল মদ বিক্রি করা হয়েছে বলে জানা গেছে। এ মদ যারা পান করবে তাদের অঙ্গহানি ঘটনার আশঙ্কা থাকে, কয়েকজন মারাও গেছেন।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads