• শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ৪ জৈষ্ঠ ১৪২৯
বুড়িমারীতে গুজব ছড়িয়ে পুড়িয়ে হত্যা: ৩ মামলায় গ্রেপ্তার ৪৭

প্রতীকী ছবি

অপরাধ

বুড়িমারীতে গুজব ছড়িয়ে পুড়িয়ে হত্যা: ৩ মামলায় গ্রেপ্তার ৪৭

  • লালমনিরহাট প্রতিনিধি
  • প্রকাশিত ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১

লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারীতে গুজব ছড়িয়ে গণপিটুনিতে আবু ইউনুস মো. সাহিদুন্নবী জুয়েলকে হত্যার পর মরদেহ পোড়ানোর ঘটনায় দায়ের করা ৩ মামলায় গত ৩ মাসে মোট ৪৭ জন আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

সবশেষ গত সোমবার বিকেলে গ্রেপ্তার জাবেদ ওমরকে (৩২) লালমনিরহাট আমলি আদালত-৩ এর বিচারক সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ফেরদৌসী বেগমের আদালতে হাজির করে পাঁচ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা জেলা গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক (ওসি-তদন্ত) মাহমুদুন্নবী।

আগামী ১১ ফেব্রুয়ারি রিমান্ড আবেদনের শুনানির দিন ধার্য করে গ্রেপ্তার আসামি জাবেদ ওমরকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন আদালত।

জাবেদ ওমর পাটগ্রাম পৌরসভার ১নং ওয়ার্ডের ব্যাংকান্দা এলাকার মৃত আজিজার রহমানের ছেলে।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মাহমুদুন্নবী জানান, আবু ইউনুস মো. সাহিদুন্নবী জুয়েল হত্যায় দায়ের করা হত্যা, পুলিশের ওপর হামলা ও বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) ভবনে হামলার মামলায় অজ্ঞাতনামা আসামি হিসেবে সোমবার সকালে জাবেদ ওমরসহ মোট ৪৭ আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

তদন্তে হত্যা, পুলিশের ওপর হামলা ও ইউনিয়ন পরিষদ ভাঙচুরের ঘটনায় তার সম্পৃক্ততা পাওয়ায় তিনটি মামলায় জাবেদ ওমরকে  গ্রেপ্তার দেখিয়ে গত সোমবার বিকেলে আদালতে সোপর্দ করা হয়। এসময় তাকে হত্যা মামলায় ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পাঁচ দিনের রিমান্ড আবেদন করা হলে আদালতে আগামী ১১ ফেব্রুয়ারি রিমান্ড আবেদনের শুনানির দিন ধার্য করে আসামিকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।

জুয়েল হত্যার ঘটনায় দায়ের করা তিন মামলায় গ্রেপ্তার ৪৭ জনের মধ্যে হত্যা মামলায় ১৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। যার মধ্যে মূলহোতা বুড়িমারী ইউনিয়ন শ্রমিক লীগের সভাপতি আবুল হোসেন ওরফে হোসেন ডেকোরেটর এবং মসজিদের খাদেম জোবেদ আলীসহ ৬জন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। ওই মামলায় গ্রেপ্তারদের মধ্যে হত্যা মামলায় মুয়াজ্জিন ও অন্য দুই মামলায় মোট ৬জন জামিনে মুক্তি পেয়েছেন বলে নিশ্চিত করেন জেলা গোয়েন্দা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ওমর ফারুক।

গত বছরের ২৯ অক্টোবর বিকেলে পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারী বাজার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ এলাকায় এ হামলার ঘটনা ঘটে। নিহত যুবক সাহিদুন্নবী জুয়েল রংপুর শহরের শালবন মিস্ত্রিপাড়ার আব্দুল ওয়াজেদ মিয়ার ছেলে। তিনি রংপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের সাবেক গ্রন্থাগারিক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সাবেক ছাত্র ছিলেন। গত বছর চাকরিচ্যুত হওয়ায় কিছুটা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন তিনি।

উল্লেখ্য, সাহিদুন্নবী জুয়েল ২৯ অক্টোবর বিকেলে সুলতান রুবায়াত সুমন নামে এক জনকে সঙ্গে নিয়ে বুড়িমারীতে বেড়াতে আসেন। বিকেলে বুড়িমারী কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে আসরের নামাজ আদায় করেন তারা। নামাজ শেষে পাঠ করার জন্য মসজিদের সানসেটে রাখা কোরআন শরিফ নামাতে গিয়ে অসাবধানতাবশত কয়েকটি কোরআন শরীফ ও হাদিসের বই তার পায়ের ওপর পড়ে যায়। সে সময় কোরআন শরীফ ও হাদিসের বই তুলে চুম্বন করে যথাস্থানে রেখে দেন জুয়েল। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে তার সঙ্গে মসজিদের মুয়াজ্জিনের কথা কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে আশপাশের লোকজন ছুটে এসে সন্দেহবশত জুয়েল ও সঙ্গী সুলতান রুবায়াত সুমনকে পাশে ইউপি ভবনের একটি কক্ষে আটকে রাখেন। সন্ধ্যায় পুরো বাজারে এবং পার্শ্ববর্তী গ্রামে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, কোরআন অবমাননার দায়ে দুই যুবককে আটক করা হয়েছে। সে সময় উত্তেজিত হয়ে বিক্ষুব্ধ জনতা ইউপি ভবনের দরজা-জানালা ভেঙে প্রশাসনের কাছ থেকে জুয়েলকে ছিনিয়ে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে। পরে মরদেহ টেনে-হিঁচড়ে পাটগ্রাম বুড়িমারী মহাসড়কে নিয়ে আগুনে পুড়িয়ে দেয়। সে সময় বিক্ষুব্ধ জনতা মহাসড়কে আগুন জ্বালিয়ে অবরোধ করে বিক্ষোভ মিছিল করে। পুরো এলাকা পরিণত হয় রণক্ষেত্রে।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পাটগ্রাম ও হাতীবান্ধা থানা পুলিশ, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা দফায় দফায় চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। সে সময় বিক্ষুব্ধ জনতার ছোড়া ইট-পাথরের আঘাতে পাটগ্রাম থানার ওসি সুমন্ত কুমার মোহন্তসহ ১০ জন পুলিশ সদস্য আহত হন। জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে ১৭ রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোড়ে পুলিশ। পরে রাত সাড়ে ১০টার দিকে জেলা প্রশাসক আবু জাফর ও পুলিশ সুপার আবিদা সুলতানা অতিরিক্ত পুলিশ নিয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। এসময় নিহত জুয়েলের সঙ্গী সুলতান রুবায়াত সুমনকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে পুলিশ। 

ঘটনা তদন্তে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে গত ৩০ অক্টোবর অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট টিএমএ মমিনকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এ ঘটনায় নিহত জুয়েলের চাচাত ভাই সাইফুল আলম, পাটগ্রাম থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) শাহজাহান আলী ও বুড়িমারী ইউপি চেয়ারম্যান আবু সাঈদ নেওয়াজ নিশাত বাদী হয়ে পৃথক তিনটি মামলা দায়ের করেন। ঘটনাস্থলের ভিডিও দেখে আসামি শনাক্ত করে অভিযান চালিয়ে এখন পর্যন্ত ৪৭ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গ্রেফতার সবাই বুড়িমারী এলাকার বাসিন্দা বলেও জানায় পুলিশ।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ও জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটি বুড়িমারীতে কোরআন অবমাননার কোনো সত্যতা পায়নি। গুজব ছড়িয়ে জুয়েলকে পিটিয়ে হত্যা ও পরে মরদেহ পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন দু’টি তদন্ত কমিটির সদস্যরা।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads