• শুক্রবার, ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪২৯
ধারাবাহিক স্বর্ণ পাচারে ইউএস-বাংলা!

সংগৃহীত ছবি

অপরাধ

ধারাবাহিক স্বর্ণ পাচারে ইউএস-বাংলা!

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২১

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দুবাই থেকে আসা ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনস থেকে এবার ৭ কেজি স্বর্ণ (৬০ পিস বার) জব্দ করেছে শুল্ক গোয়েন্দারা। যার আনুমানিক মূল্য প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকা। এ ঘটনায় এয়ারলাইনসের সাত কর্মীকে আটকও করা হয়েছে।

এর আগেও এই এয়ারলাইনসে বেশ কয়েকবার স্বর্ণ পাচারের ঘটনা ঘটেছে। আর এয়ারলাইনসটির গ্রেপ্তারকৃত কর্মীরা আদালতে সোনা পাচারে নিজেদের সম্পৃক্ততার কথা স্বীকারও করেছে।

শুল্ক গোয়েন্দা সূত্র জানায়, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে তারা আগে থেকেই সতর্ক ছিল। গতকাল মঙ্গলবার সকাল ৭টায় ইউএস-বাংলার দুবাই থেকে আসা ফ্লাইট বিএস ৩৪২ বিমানবন্দরে অবতরণ করে। যাত্রীদের উচ্ছিষ্ট খাবারের বক্স গাড়িতে তোলার পর সেখানে তল্লাশি চালিয়ে ৬০ পিস স্বর্ণের বার জব্দ করেন শুল্ক গোয়েন্দারা।

গোয়েন্দা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক নিয়াজুর রহমান খান ধারণা করছেন, এই স্বর্ণ চোরাচালানের ঘটনায় ইউএস-বাংলার ক্যাটারিং সার্ভিসের কর্মীরা জড়িত। তিনি জানান, আটক সাত জনকে জিজ্ঞাসাবাদ ও মামলা দায়ের করা হচ্ছে।

এদিকে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, সোনা চোরাচালানে জড়িয়ে পড়ছে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনস। কারণ তাদের উড়োজাহাজ থেকে দফায় দফায় চোরাচালানের স্বর্ণ উদ্ধার করেছে ঢাকা কাস্টম হাউস এবং শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। আর চোরাচালানে জড়িত থাকার কথা আদালতে স্বীকারও করেছেন এয়ারলাইনসটির কর্মীরা।

কাস্টমস সূত্র জানান, গত ২২ জানুয়ারি মাসকাট থেকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আসা ইউএস-বাংলার একটি ফ্লাইট থেকে ৭ কেজি ২৯০ গ্রাম সোনা উদ্ধার করেছিল ঢাকা কাস্টম হাউস। এর বাজারমূল্য প্রায় ৫ কোটি টাকা। সম্প্রতি এয়ারলাইনসটিতে স্বর্ণ পাচারের ঘটনা কম থাকলেও গত দুই মাসে প্রায় ১০ কোটি টাকার স্বর্ণ জব্দ করা হয়।

সূত্র জানায়, গত বছর ১১ জানুয়ারি শাহজালাল বিমানবন্দরে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনস থেকে ৪ কেজি ৬৪০ গ্রাম সোনা উদ্ধার হয়। একই বছরের ৩১ জুলাই একই বিমানবন্দরে ইউএস-বাংলার যাত্রী বহনকারী গাড়ির চালকের কাছ থেকে ৩ কেজি ৭১২ গ্রাম স্বর্ণ উদ্ধার করে কাস্টমস, যার বাজারমূল্য প্রায় ৩ কোটি টাকা।

২০১৯ সালের ২২ নভেম্বর ১৭ লাখ টাকা মূল্যের তিনটি স্বর্ণের বারসহ আটক হন ইউএস-বাংলার কর্মী। তার আগে ৯ সেপ্টেম্বর আদালতে সোনা চোরাচালানে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেন ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের কেবিন ক্রু রোকেয়া শেখ মৌসুমী। একই বছরের ২০ এপ্রিল প্রায় ৭ কোটি টাকা মূল্যের ১৪ কেজি সোনা জব্দ করে শুল্ক গোয়েন্দা, যার বাজারমূল্য প্রায় ১০ কোটি টাকা বলে জানিয়েছেন জুয়েলারি ব্যবসায়ীরা। ২০১৭ সালের ১১ অক্টোবর ফ্লাইট থেকে ৪ কেজি ৬৪ গ্রাম সমান সোনার বার উদ্ধার হয়, যার বাজারমূল্য প্রায় ২ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। একই বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর ৪ কেজি ৬৬৫ গ্রাম সোনার বার উদ্ধার করে কাস্টমস, যার বাজারমূল্য প্রায় ২ কোটি ৭০ লাখ টাকা। 

ঢাকা কাস্টম হাউসের কমিশনার মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ‘সোনা চোরাচালানের বিষয়ে গভীর নজরদারি রয়েছে কাস্টমসের। চোরাচালানের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে রয়েছে কাস্টমস। এয়ারলাইনসের সম্পৃক্ততার বিষয়টিও আমাদের নজরদারিতে রয়েছে।’

বাংলাদেশ জুয়েলারি প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘এয়ারলাইনসগুলো জড়িত না থাকলে কোনোভাবেই আকাশপথে সোনা চোরাচালান সম্ভব নয়। তাদের সঙ্গে অন্যরাও জড়িত। বিমানবন্দরে ১৭টি সংস্থা কাজ করে, তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে স্বর্ণ চোরাচালান অনেক কঠিন।’

বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতি-বাজুস সাধারণ সম্পাদক দিলীপ কুমার আগরওয়ালা বলেন, ‘এতদিন আমরা জেনেছি স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে এয়ারলাইনসগুলোর ক্রুরা জড়িত।’ তবে সরাসরি এয়ারলাইনসগুলো জড়িত না থাকলে বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ চোরাচালান কেবিন ক্রুরা করতে পারেন কি না খতিয়ে দেখা উচিত বলে মনে করেন ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সহসভাপতি। 

কাস্টমস সূত্র জানান, ২০২০ সালের ১২ জানুয়ারি শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে ২ কোটি ৩২ লাখ টাকার ৪ কেজি ৬৪০ গ্রাম সোনা উদ্ধার করে ঢাকা কাস্টম হাউসের প্রিভেনটিভ টিম। স্বর্ণের বারগুলো কালো স্কচটেপ মোড়ানো অবস্থায় ছিল। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে চোরাচালান প্রতিরোধে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের ফ্লাইট নম্বর বিএস৩১৬-এর যাত্রী অবতরণের সিঁড়ির নিচে ৪০টি সোনার বার পাওয়া যায়। এ বিষয়ে কাস্টমস আইনে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

এর আগে ২০১৯ সালের ২২ নভেম্বর তিনটি স্বর্ণের বারসহ আটক হয়েছিল ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের কাস্টমার সার্ভিস অ্যাসিস্ট্যান্ট ওমর ফারুক। স্বর্ণের বারগুলো নিয়ে আসা মামুন মিয়া নামে এক যাত্রীকেও আটক করা হয়েছিল। কাস্টম হাউসের প্রিভেনটিভ টিম বিমানবন্দরের বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থান নিয়ে ট্রানজিট ও বোর্ডিং এলাকায় নজরদারি এবং তল্লাশি করে তাদের আটক করেছিল।

একই বছরের ৯ সেপ্টেম্বর আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেন শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ১০ কেজি স্বর্ণের বারসহ গ্রেপ্তার ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের কেবিন ক্রু রোকেয়া শেখ মৌসুমী। পুলিশ দুদিনের রিমান্ড শেষে ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করে। এ সময় তার জবানবন্দি রেকর্ড করেন বিচারক তোফাজ্জল হোসেন।

এর আগে ৫ সেপ্টেম্বর সকালে বিমানবন্দর আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) মৌসুমীকে প্রায় ১০ কেজি স্বর্ণসহ গ্রেপ্তার করে। এ ঘটনায় এপিবিএনের এসআই হেলাল উদ্দিন বাদী হয়ে মৌসুমীসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে বিমানবন্দর থানায় সোনা চোরাচালান আইনে মামলা করেন। মামলায় ইউএস-বাংলা থেকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসে যোগ দেওয়া কেবিন ক্রু নেছার উদ্দিন, তার স্ত্রী, যাত্রী সুহেল খাঁ, লাকী ও বাপ্পীকে আসামি করা হয়।

২০১৯ সালের ২০ এপ্রিল ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের ফ্লাইট থেকে প্রায় ৭ কোটি টাকা মূল্যের ১৪ কেজি স্বর্ণ জব্দ করে শুল্ক গোয়েন্দা। ওইদিন বিকালে ব্যাংকক থেকে শাহজালাল বিমানবন্দরে আসা ফ্লাইটের টয়লেটে ওই স্বর্ণ পাওয়ার কথা জানায় শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। তারা জানায়, প্রতিটি ১০ তোলা ওজনের মোট ১২০টি সোনার বার উদ্ধার হয়েছে। শুল্ক গোয়েন্দা দল গোপন সংবাদ পায়, ব্যাংকক থেকে আসা ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের (বিএস ২১৪) ফ্লাইটের মাধ্যমে স্বর্ণ চোরাচালান হবে। উড়োজাহাজটি অবতরণের সঙ্গে সঙ্গে তল্লাশি করা হয়। একপর্যায়ে বিমানের টয়লেটে পরিত্যক্ত অবস্থায় ওই বারগুলো পাওয়া যায়।

২০১৭ সালের ১১ অক্টোবর শাহজালাল বিমানবন্দরে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইট থেকে ৪ কেজি ৬৪ গ্রাম ওজনের স্বর্ণের বার উদ্ধার করে ঢাকা কাস্টম হাউসের প্রিভেনটিভ টিম। এয়ারলাইনসের (ফ্লাইট নম্বর বিএস৩২২) ১১ এ ও ১১ বি সিটের ভেতর থেকে ওই সোনা উদ্ধার করা হয়। এর বাজারমূল্য প্রায় ২ কোটি ৩২ লাখ টাকা। এ বিষয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার কথা তখন জানায় ঢাকা কাস্টম হাউস।

একই বছর ২৪ সেপ্টেম্বর শাহজালাল বিমানবন্দরে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের ফ্লাইট থেকে ৪ কেজি ৬৬৫ গ্রাম স্বর্ণের বার উদ্ধার করে শুল্ক গোয়েন্দা। এয়ারলাইনসের (ফ্লাইট নম্বর বিএস২০২) থেকে ওই স্বর্ণ উদ্ধার করা হয়। এর বাজারমূল্য প্রায় ২ কোটি ৩০ লাখ টাকা।

এ বিষয়ে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের জনসংযোগ কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম বলেন, ইউএস-বাংলা কর্তৃপক্ষ কোনোভাবেই স্বর্ণ পাচারের সঙ্গে জড়িত নয়। আমরা তো প্যাসেঞ্জার চেক করতে পারি না। প্যাসেঞ্জার চেক করার পৃথক কর্তৃপক্ষ রয়েছে। তিনি বলেন, বিমানবন্দর দিয়ে স্বর্ণ পাচারের ৭৩ শতাংশ বাংলাদেশ বিমানে হয়েছে বলে রিপোর্টও প্রকাশিত হয়েছে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কোনো প্যাসেঞ্জারকে দেখে তো আমরা চোরাকারবারি চিহ্নিত করতে পারি না। সুতরাং আমাদের এখানে দায় নেই।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads