• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪২৯

অপরাধ

টার্গেট কিলিংয়ের মাস্টারমাইন্ড

নয় বছর আত্মগাপনে জিয়া

  • ইমরান আলী
  • প্রকাশিত ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১

দেশে টার্গেট কিলিংয়ের অন্যতম মাস্টারমাইন্ড সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত মেজর জিয়া। সংক্ষেপে তাকে জঙ্গি জিয়া হিসেবেই চেনে সবাই। দীর্ঘ ৯ বছর ধরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে আত্মগোপনে রয়েছে। জিয়া দেশে নাকি দেশের বাইরে আছে এ বিষয়েও সুস্পষ্ট কোনো তথ্য নেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে। তবে বিভিন্ন সময় ধরা পড়া জঙ্গিদের জিজ্ঞাসাবাদে জঙ্গি জিয়া দেশেই আছে বলে জানতে পারেন তারা। পর পর দুটি হত্যাকাণ্ডে তার বিরুদ্ধে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। আর এই মৃত্যুপরোয়না নিয়েই পালিয়ে বেড়াচ্ছে জিয়া। সম্প্রতি চাঞ্চল্যকর অভিজিৎ ও আরেফিন দীপন হত্যা মামলায় তার বিরুদ্ধে ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন আদালত। গতকাল মঙ্গলবার ও গত ১০ ফেব্রুয়ারি দীপন হত্যা মামলায় নিষিদ্ধ জঙ্গিগোষ্ঠী আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) প্রধান মেজর জিয়াউল হক ওরফে জঙ্গি জিয়ার ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়।

কে এই মেজর জিয়া :

মেজর জিয়ার পুরো নাম সৈয়দ মোহাম্মদ জিয়াউল হক। তার বাবার নাম সৈয়দ মোহাম্মদ জিল্লুর হক। তার গ্রামের বাড়ি মৌলভীবাজারের মোস্তফাপুরে। সর্বশেষ  সে মিরপুর সেনানিবাসে থাকত। ২০১১ সালে সেনাবাহিনীতে একটি ব্যর্থ অভ্যুত্থানচেষ্টার পরই আলোচনায় আসে মেজর (চাকরিচ্যুত) সৈয়দ মোহাম্মদ জিয়াউল হক। অভ্যুত্থানচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর থেকেই জিয়ার আর কোনো সন্ধান মেলেনি। তাকে ধরতে বিভিন্ন সময়ে অভিযান পরিচালনা করা হলেও আজো রয়েছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।

দেশে ব্লগার, প্রকাশক, মুক্তমনা লেখকদের মধ্যে ৯ জনকে টার্গেট কিলিংয়ের ঘটনার নেপথ্যে ছিল এই মেজর জিয়া। আরো কয়েকজনকে হত্যাচেষ্টা পরিকল্পনার সঙ্গেও সে যুক্ত ছিল। গোয়েন্দাদের ধারণা, আশপাশের দেশের কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গেও তার যোগাযোগ রয়েছে। দেশকে অস্থিতিশীল করার পাশাপাশি সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে গুপ্তহত্যাসহ নানা পরিকল্পনার নেপথ্যে রয়েছে সে।

তার তত্ত্বাবধানে এবিটির অন্তত আটটি স্লিপার সেল রয়েছে। প্রতিটি সেলের সদস্য সংখ্যা চার থেকে পাঁচজন। সেই হিসেবে অন্তত ৩০ জন দুর্ধর্ষ ‘স্লিপার কিলার’ জঙ্গি তৈরি করেছে মেজর জিয়া। তারাই ব্লগার, প্রকাশক, মুক্তমনা ও ভিন্নমতাবলম্বীদের হত্যা করেছে।

গোয়েন্দা সূত্র বলছে, দেশে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ বিস্তারে অন্যতম পরিকল্পনাকারী হিসেবে কাজ করছে জিয়া। রাজধানী ও আশপাশে টার্গেট কিলিংয়ে জড়িত কয়েকজন জঙ্গিকে গ্রেপ্তারের পর মেজর জিয়ার নাম জানা যায়। তা ছাড়া এসব জঙ্গির মোবাইল ফোনের কল রেকর্ড পর্যালোচনা, ই-মেইল অ্যাকাউন্ট, ফেসবুক ও টুইটার অ্যাকাউন্ট ঘেঁটেও অনেক তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) একাংশের সঙ্গেও মেজর জিয়ার যোগাযোগ রয়েছে। তবে তাকে গ্রেপ্তারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সব ধরনের চেষ্টা চলছে।

কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্র্যান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) সূত্র জানায়, এবিটির কার্যক্রম ঢাকা ও চট্টগ্রামেই বেশি। স্লিপার সেল তৈরির ধারণাটি মেজর জিয়ার মস্তিষ্কপ্রসূত।  সে নিজেই এই অভিযানগুলো সমন্বয় করে। স্লিপার সেলের সদস্যরা তাকে ইশতিয়াক নামে চেনে। স্লিপার সেলের সদস্যদের ঢাকা ও আশপাশের নির্জন এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে প্রশিক্ষণ দিত জিয়া।

কমপক্ষে ৯টি হত্যার ‘মাস্টারমাইন্ড’ জিয়া : ২০১৩-২০১৫ সালের মধ্যে পাঁচজন ব্লগার, একজন প্রকাশক ও সমকামীদের অধিকার নিয়ে কাজ করতেন এমন দুজনকে হত্যা করেছে এবিটি। এই সময়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী হত্যার পেছনেও এবিটি জড়িত। এসব ঘটনার তদন্ত করে মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে জিয়ার নাম উঠে এসেছে। ২০১৬ সালের ২৫ এপ্রিল কলাবাগানের একটি বাসায় জুলহাজ মান্নান ও মাহবুব তনয় নামে দুজনকে হত্যা করে এবিটির স্লিপার সেলের সদস্যরা। তারা দুজনই সমকামীদের অধিকার নিয়ে কাজ করতেন। এর আগে একই বছরের ৫ এপ্রিল রাজধানীর সূত্রাপুরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাজিমুদ্দিন সামাদকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ২০১৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির অদূরে বিজ্ঞানমনস্ক লেখক ও ব্লগার ড. অভিজিৎ রায়, তেজগাঁওয়ে ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবু, সিলেটের সুবিদবাজার এলাকায় ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশ, রাজধানীর গোড়ানে ব্লগার নীলাদ্র্রি চ্যাটার্জি ওরফে নিলয়কে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ওই বছরের শেষ দিকে আজিজ সুপার মার্কেটে নিজ কার্যালয়ে হত্যা করা হয় জাগৃতি প্রকাশনীর কর্ণধার ফয়সল আরেফিন দীপনকে। এর আগে ২০১৩ সালে রাজধানীর পল্লবীতে খুন হন ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার।

গোয়েন্দারা বলছেন, অভ্যুথানচেষ্টায় যুক্তরা হিযবুত তাহরীরকে সংগঠিত করার চেষ্টা করছিল। পরে মেজর জিয়া এবিটির সঙ্গে যুক্ত হয়ে একের পর এক টার্গেট কিলিং মিশন বাস্তবায়ন করে। গত বছরের ৯ জানুয়ারি পাকিস্তানের করাচিতে সে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে এজাজ ওরফে সাজ্জাদসহ আলকায়েদার চার জঙ্গি নিহত হয়। ওই সময় বিভিন্ন গণমাধ্যমে বলা হয়, এজাজ আলকায়েদার কমান্ডার এবং এবিটির অন্যতম শীর্ষ নেতা ছিল। তার মৃত্যুর পর এবিটির নেতৃত্বে পরিবর্তন আসে। জসীমুদ্দিন রাহমানী জেলে থাকায় সে সময় তার স্থলে তাত্ত্বিক নেতা হয় পুরান ঢাকার ফরিদাবাদের এক মাদরাসা শিক্ষক। আর সামরিক শাখার একক নেতৃত্বে আসে মেজর জিয়া। গ্রেপ্তার হওয়ার পর জসীমুদ্দিন রাহমানী জিজ্ঞাসাবাদে বলেছেন, তিনি ঢাকা ও চট্টগ্রামে একাধিকবার জিয়ার সঙ্গে দেখা করেছেন। সংগঠনে জিয়ার একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারের পর এবিটি ‘আনসার আলইসলাম’ নাম ধারণ করে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads