• শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ৩ জৈষ্ঠ ১৪২৯

অপরাধ

ভয়ংকর হামলার ছক হুজির

সাংবাদিক ছদ্মবেশেও চলছে জঙ্গিরা

  • ইমরান আলী
  • প্রকাশিত ০৬ মার্চ ২০২১

কারাগারে বসে ভয়ংকর হামলার ছক কষছে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ (হুজি)। বন্দি শীর্ষ নেতা আতিকুল্লাহর নেতৃত্বে আবারো সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে তারা। নানা ছদ্মবেশে দেশের বিভিন্ন স্থানে আঞ্চলিক কমান্ডার নির্বাচিত করে ঝিমিয়েপড়া সংগঠনের সদস্যদের চাঙ্গা করার চেষ্টা চলছে। এমনকী বিভিন্ন সময় তৎপর অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনের সদস্যদের দলে ভেড়ানোর চেষ্টাও করা হচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর সায়েদাবাদ এলাকায় অভিযান চালিয়ে শীর্ষ ৩ নেতাকে গ্রেপ্তার করে ডিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি)। গ্রেপ্তারকৃতরা হলো, মো. মাইনুল ইসলাম ওরফে মাহিন ওরফে মিঠু ওরফে হাসান, শেখ সোহান স্বাদ ওরফে বারা আব্দুল্লাহ ও মুরাদ হোসেন কবির। এ সময় তাদের কাছ থেকে ১ টি প্রাইভেটকার, ৫ টি মোবাইল ফোন, ১ টি মাইক্রোফোন, ১ টি চাপাতি, ২ টি ছোড়া, ১০ টি ডেটোনেটর, ১৭০ টি বিয়ারিং লোহার বল, ১ টি স্কচটেপ, ৫ লিটার এসিড, ৩ টি আইডি কার্ড ও ১ টি জিহাদি বই উদ্ধার করা হয়।

সিটিটিসির উপ-কমিশনার মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম জানান, গ্রেপ্তারকৃতরা ‘হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী’-এর সক্রিয় সদস্য। তারা মাইনুল ইসলামের নেতৃত্বে দলকে পুনর্গঠন, শূরা কমিটি তৈরি, সংগঠনের অর্থদাতা এবং সদস্যদের কাছ থেকে অর্থের যোগান নিশ্চিত, সংগঠনের সদস্য সংগ্রহ, অস্ত্র সংগ্রহ, বোমা তৈরির সরঞ্জাম সংগ্রহ, কারাগারে আটক সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদের জামিনের ব্যবস্থা, বান্দরবান-নাইক্ষ্যংছড়ি পাহাড়ি দুর্গম এলাকায় জমি ইজারা নিয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থার কাজে নিয়োজিত ছিল। পাশাপাশি দেশের ৬৪ জেলায় সংগঠনের বিস্তার ও সক্ষমতা বাড়াতে সাংবাদিকতাসহ বিভিন্ন পরিচয়ে কার্যক্রম চালাচ্ছিল। তারা কারাগারে আটক ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি মাওলানা আবু সাঈদ ওরফে ডাক্তার জাফর ও ২০০০ সালের কোটালিপাড়ায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হত্যাচেষ্টা মামলার যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি মেহেদী হাসান ওরফে আব্দুল ওয়াদুদ ওরফে গাজী খানের নির্দেশে সাংগঠনিক কাজ করছিল।

তিনি জানান, গ্রেপ্তারকৃত মাইনুল ইসলাম দীর্ঘদিন ধরে নিষিদ্ধ সংগঠন হুজির প্রধান অপারেশন সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করছিল। সে সাংবাদিক বেশ ধারণ করে সংগঠনের দাওয়াতি কাজ, অর্থ সংগ্রহ, বোমা তৈরির সরঞ্জাম সংগ্রহ করে আসছিল। তার পরিকল্পনা ছিল রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য বড় শহরে বড় ধরনের নাশকতা করে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করা। তাকে ২০১৫ সালে হুজির শীর্ষ নেতা কারাবন্দি মুফতি মঈনউদ্দিন ওরফে আবু জান্দালকে ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।

সাইফুল ইসলাম বলেন, অপর গ্রেপ্তারকৃত সোহান স্বাদ সুনামগঞ্জের বিবিয়ানা কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করে।  সে ঢাকায় মিরপুর বাঙলা কলেজে পড়ার পাশাপাশি একটি মাদরাসায় শিক্ষকতা করতো। ২০১৬ সালে  একুশে বই মেলায় নাশকতার ঘটনায় গ্রেপ্তার হয়। এছাড়াও সে ২০১৭ সালে বিষ্ফোরক মামলায় এবং ২০১৯ সালে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের একটি মামলায় গ্রেপ্তার হয়। জামিনে বের হয়ে সে মাইনুলের নেতৃত্বে হুজির সক্রিয় সদস্য হিসেবে কাজ করতো। গ্রেপ্তারকৃত মুরাদ হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামীর সক্রিয় সদস্য। সে ব্যবসার আড়ালে হুজি সংগঠনের দাওয়াতি ও বায়তুল মালের দেখভালের দায়িত্ব পালন করতো। গ্রেপ্তারকৃতদের বিরুদ্ধে যাত্রাবাড়ী থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।

এদিকে গত ৩০ ডিসেম্বর রাজশাহী ও খুলনা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কমান্ডার ইব্রাহিম খলিল রাজশাহীতে আটক হয়। আটকের পর তাকে জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য পায় পুলিশ। সেই তথ্যের ভিত্তিতে সারা দেশে সংগঠনের যে বিস্তার ঘটেছে তাতে কিছু আঞ্চলিক নেতার নাম পেয়েছে পুলিশ। তাদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।

রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার আবু কালাম সিদ্দিক বলেন, হুজির আঞ্চলিক কমান্ডার ইব্রাহিম খলিল ও আব্দুল আজিজকে গ্রেপ্তারের পর তাদের কাছ থেকে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া যায়। সে তথ্যের ভিত্তিতে পুরো গ্রুপকে গ্রেপ্তারে কাজ করছি।

গোয়েন্দা সূত্রের মতে, বিভিন্ন সময় জঙ্গি সংগঠনগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠার চেষ্টা করছে। যখন কোনো পরিকল্পনাতে তারা এগোনোর চেষ্টা করে, তখন তাদের গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। এরই মাঝে হরকাতুল জিহাদও এরকম এক চেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে। কারাগারে আটক হুজির শীর্ষ নেতা আতিকুল্লাহ এই গ্রুপকে নির্দেশনাও দিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে বিচ্ছিন্নভাবে তারা দল গোছানোরও কাজ করছে।

সূত্র জানায়, যেহেতু তারা রাজশাহী ও খুলনা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত একজনকে মনোনীত করেছে, সেহেতু গোয়েন্দাদের ধারণা, অন্যান্য বিভাগেও তারা কোনো একজনকে দায়িত্ব দেওয়ার জন্য মনোনীত করেছে। এরই মধ্যে রাজশাহীতে কর্মী সম্মেলন করতে গিয়েই আটক হয় দায়িত্বপ্রাপ্ত ইব্রাহিম খলিল ও তার সহযোগী।

গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, মাইনুল ও ইব্রাহিম খলিলের মতো সারা দেশে এরকম ৮ জন দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা নির্বাচিত হয়েছে হুজির। তারা আবারো সক্রিয় হয়ে উঠতে চায়। বিভিন্ন সময়ে তাদের দলে থাকা কর্মীদের ডাকাও হচ্ছে। এছাড়া অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে থাকা কর্মীদের দলে ভেড়াতে চাচ্ছে তারা। বিশেষ করে কারাগারে বন্দি শীর্ষ নেতা আতিকুল্লাহসহ অন্যান্য নেতাদের মুক্ত করতে তহবিলও সংগ্রহ করছে। দুবাইসহ মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক বিভিন্ন রাষ্ট্র থেকে এ টাকা সংগ্রহ করা হচ্ছে। কারাগার থাকা অন্যান্য নেতাদের নির্দেশে হামলার ছক আঁকছে।

গোয়েন্দারা বলছেন, কারাগার থেকেই মূলত আতিকুল্লাহ এসব দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। তার এ দিক নির্দেশনা অনুসারে কাজ করছে তারা। এক প্রশ্নের জবাবে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলেন, আপাতত নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের তেমম শক্তি নেই হুজির। শুধু হুজি নয়, অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনের আছে বলে মনে হয় না। এর আগে রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ এবং বগুড়ায় নব্য জেএমবি সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছিল। তাদেরও আটক করা হয়েছে। সব মিলিয়ে জঙ্গিরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজর এড়ানোর চেষ্টা করছে। তারপরও আমাদের নজর এড়ানো কঠিন। জঙ্গিদের গ্রেপ্তারে যে ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন সেই পদক্ষেপগুলো রয়েছে।

কে এই আতিকুল্লাহ

সিটিটিসির কর্মকর্তারা জানান, আতিকুল্লাহ ১৯৯৬ সালে মুফতি হান্নানের নেতৃত্বে গঠিত হুজিবির কমিটিতে সাংগঠনিক সম্পাদক ছিল। পরে সে বায়তুল মাল ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের দায়িত্বশীল হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রথমদিকে আতিকুল্লাহ দুবাই হয়ে সৌদি আরব পালিয়ে যায়। সেখান থেকে একাধিকবার সে পাকিস্তান গিয়ে দেশটির জঙ্গি সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে। সেসব বৈঠকে বাংলাদেশে হুজিকে সচল করার নানা পরিকল্পনা করা হয়।

জানা যায়, আশির দশকের শেষের দিকে আফগানিস্তানে সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধে অংশ নেয় আতিকুল্লাহ। সে বোমা তৈরিতে বিশেষভাবে দক্ষ। ওই সময় সে আল-কায়েদার প্রয়াত প্রধান ওসামা বিন লাদেন, তালেবানের সাবেক শীর্ষ নেতা মোল্লা ওমরসহ আল-কায়েদার বর্তমান নেতা আইমান আল জাওয়াহেরির সঙ্গে কয়েকবার বৈঠক করেছে। গত বছরের মার্চে সে দেশে এসে নতুন করে হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশকে সংগঠিত করার কাজে নামে। এরই মাঝে তাকে গত বছরের অক্টোবরে রাজধানীর খিলক্ষেত থেকে গ্রেপ্তার করে ডিএমপির সিটিটিসি ইউনিট।

গ্রেপ্তারের আগে সে নতুন-পুরনো অনেক সদস্যের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। এছাড়া সে জেলে থাকা হুজিবি সদস্যদের জামিনে বের করে আনার জন্যও তৎপর ছিল। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে তার তৎপরতা ছিল। রোহিঙ্গা ও কাশ্মীর ইস্যুকে কাজে লাগিয়ে সে নতুন সদস্য সংগ্রহ করার চেষ্টা করছিল।

এক কর্মকর্তা জানান, হুজিবি সংগঠিত করতে আতিকুল্লাহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সফর করেছে বলে স্বীকার করে। এছাড়া দেশি সমর্থক ও মধ্যপ্রাচ্যে থাকা হুজিবি সমর্থকদের কাছ থেকে সে সংগঠনের জন্য অর্থ সংগ্রহ করছিল। তার সঙ্গে পাকিস্তান, দুবাই ও সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশে পলাতক জঙ্গিদের যোগাযোগের তথ্য-প্রমাণও পাওয়া যায় ওই সময়।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads