• রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪২৯

অপরাধ

রাজধানীতে বেপরোয়া মাদকচক্র

  • ইমরান আলী
  • প্রকাশিত ১১ মার্চ ২০২১

রাজধানীর মাদকের স্পটগুলোর মধ্যে অন্যতম মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্প। তাই দিনদিন ভয়ংকর হয়ে উঠছে এখানকার মাদক সিন্ডিকেট। বিশেষ করে কসাই গোলাম কোরাইশী ও আজম সিন্ডিকেট বেশি বেপরোয়া। আধিপত্য নিয়ে গত কয়েকদিন ধরেই সেখানে চলছে উত্তেজনা। অবশেষে মঙ্গলবার রাতে সংঘর্ষে জড়ায় দুই গ্রুপ। এতে ৬ জন আহত হয়েছে। আহতের মধ্যে একজনের অবস্থা গুরুতর।

তবে জেনেভা ক্যাম্পের শক্তিশালী মাদক সিন্ডিকেটকে মদত দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে আটকেপড়া পাকিস্তানিদের সংগঠন এসপিজিআরসির প্রেস সেক্রেটারি ইকবালের বিরুদ্ধে। স্থানীয় অবাঙালিরা জানান, কাউন্সিলর মিজান গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে জেনেভা ক্যাম্পের এসপিজিআরসির কেন্দ্রীয় কমিটির অফিস বন্ধ হয়ে যায়। প্রায় ৬ মাস এই অফিস বন্ধ ছিল। কিন্তু দুই মাস হলো আবারো এসপিজিআরসির অফিস খোলা হয়। তখন থেকেই জেনেভা ক্যাম্পে মাদক ব্যবসায়ীদের প্রভাব বিস্তার হওয়া শুরু হয়।

মাদক ব্যবসায়ীদের মদত দেওয়ার জন্য প্রতি সপ্তাহে সিন্ডিকেট থেকে প্রায় ৬০ হাজার টাকা করে দেওয়া হয় এসপিজিআরসি নেতা ইকবালকে। এসপিজিআরসির বিভিন্ন শাখা ও ইউনিট কমিটিতেও মাদক ব্যবসায়ীদের স্থান দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে এই ইকবালের বিরুদ্ধে। সম্প্রতি মিরপুরের এক কুখ্যাত মাদক ব্যবসায়ী সাব্বির আলমকে এসপিজিআরসি, মিরপুর শাখার সাধারণ সম্পাদক মনোনীত করেছেন ইকবাল। তবে ইকবাল এ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, কিছুদিন মাদক বিস্তার বন্ধ হলেও এখন আবার চালু হয়েছে। এ ব্যাপারে আমরা প্রশাসনকেও বলেছি। গতকাল বুধবার সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা যায়, সেখানে চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে। আহত শওকত বলেন, মাদকের সিন্ডিকেটের অন্যতম কসাই গোলামের নেতৃত্বে আরমান, রহমান, আব্দুস সাত্তার, রাজু, সুমন, মাউড়া রাসেল, আশরাফ আলী, নওশাদ, বাবু তৌসিফসহ ২০ থেকে ২৫ জন হামলা চালায়। তিনি বলেন, আমরা জেনেভা ক্যাম্পে নিরীহভাবে বসবাস করি, এটাই অনেকের সহ্য হচ্ছে না। আমাদের উপরে হামলা হবে এমনটা আগে থেকে কিছুটা বুঝতে পেরে, নিজেদের নিরাপত্তার কথা ভেবে স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অবহিত করেছিলাম।

স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, হামলাকারীরা ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ৩২ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর সৈয়দ হাসান নুর ইসলাম রাষ্ট্রনের অনুসারী। তবে কাউন্সিলর সৈয়দ হাসান নুর ইসলাম রাষ্ট্রন বলেন, ক্যাম্পে যারা বসবাস করেন সবাই আমার অনুসারী। কিন্তু অপরাধী আমার দলের কেউ না, সে যে-ই হোক, আর এ ঘটনার বিষয় আমাকে কেউ জানায়নি। আমার কথা হচ্ছে যদি কেউ অন্যায়ভাবে কারো সাথে অপরাধজনক কাজ করে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে, আর সেজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সজাগ আছে।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, কসাই গোলামসহ তাদের লোকজন বেশ কিছুদিন ধরে চাঁদা দাবি করে আসছিল। চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে তারা ক্ষিপ্ত হয়ে দোকানে হামলা চালায়, দোকান ভাঙচুর করে ও কর্মচারীকে কুপিয়ে আহত করে। হামলাকারীরা ওই এলাকায় একটি ক্লাব ঘর বানিয়ে চাঁদাবাজি করে আসছে। শুধু তাই নয়, ওই এলাকায় তারা মাদক ব্যবসাও করে। প্রতিবাদ করতে গেলে তাদের হামলার শিকার হতে হয় বলে আহতরা দাবি করেছেন।

আহত জাবেদ জানান, হামলাকারীরা মাদকের সঙ্গে জড়িত। বাধা দিলেই মারধর ও কুপিয়ে জখম করে। আমার দুটি দাঁত পড়ে গেছে। শওকতের হাতে পিঠে কুপিয়ে জখম করেছে। তার হাতের রগ কেটে গেছে। তাকে হূদরোগ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। তবে গোলাম কসাই এ প্রতিবেদককে বলেন, তিনি মাদকের বিরুদ্ধে। মাদকের স্পট বানানোর চেষ্টা করছে আজম ও তার সহযোগীরা। আমরা তাতে প্রতিবাদ করেছি। প্রতিবাদ করায় তারা আমাদের লোকজনের ওপর হামলা করে

সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা যায়, ক্যাম্পের ভেতরেই রয়েছে একটি রাজনৈতিক দলের অঙ্গ সংগঠন, মোহাম্মাদপুর থানা কমিটির কার্যালয়। এ অফিসে নিয়মিত আড্ডায় বসে মাদক ব্যবসায়ীরা। মূলত এ অফিসকে ঘিরেই এখন জেনেভা ক্যাম্পের পুরো মাদকের সিন্ডিকেট পরিচালিত হচ্ছে বলে গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। তাদের বিরুদ্ধে অবাঙালিদের ঘর-বাড়ি দখল করাসহ রাস্তায় বসা দোকান থেকে চাঁদাবাজির অভিযোগও রয়েছে। আর এসব কিছুই নিয়ন্ত্রণ করছে স্থানীয় কাউন্সিলরের ঘনিষ্ঠ সহযোগী পরিচয়দানকারী ও সৈনিক লীগ মোহাম্মাদপুর থানা কমিটির  স্বঘোষিত সভাপতি মো. গোলাম কোরাইশী। ক্যাম্পের শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী ইশতিয়াক এখন কোরাইশীকে হাত করে দেদার চালাচ্ছে মাদকের কারবার।

দেখা যায়, ঘনবসতিপূর্ণ এই ক্যাম্পের বাইরে ও ভেতরে অসংখ্য অলি-গলি রয়েছে। অধিকাংশ গলিতেই রয়েছে মাদকের আলাদা আলাদা স্পট। ক্যাম্পে বসবাস না করলেও সব স্পট নিয়ন্ত্রণ করছে রাজধানীর শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী ইশতিয়াক। তার মনোনীত লিডাররাই নিয়ন্ত্রণ করছে প্রত্যেকটা মাদকের স্পট। অভিযোগ রয়েছে, মাদক ব্যবসায়ীদের নিরাপত্তার জন্য ক্যাম্পের চেয়ারম্যান গোলাম জিলানী ও সৈনিক লীগের নেতা গোলাম কসাই ওরফে গোলাম কোরাইশীকে প্রতি সপ্তাহে মোটা অঙ্কের টাকা প্রদান করে ইশতিয়াক।

সরেজমিনে দেখা যায়, ওই অফিসের সামনে কিছু তরণ-কিশোরের ভিড়। সেখানে কিছু কিশোরের হাতে পলিথিনে মোড়ানো অবস্থায় ইয়াবা তুলে দিচ্ছে এক ব্যক্তি। সেগুলো নিয়েই সব কিশোর বিভিন্ন গলির সামনে দাঁড়িয়ে যায়। পথচারীদের অনেকেই তাদের টাকা দিয়ে ইয়াবা কিনে নিয়ে যাচ্ছে।

এ  অফিসের পাশেই এক চা দোকানি জানান, এরা সৈনিক লীগের লোকজন। সৈনিক লীগ নেতা গোলাম কোরাইশীর সবচেয়ে কাছের লোক। এই মোড়ের মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে মফিজ সুমন, চুসনি রাজু, কালু রহমান, ফর্মা মোস্তাকিম, পিচ্চি সাগর ও মোটকা রুবেল। এদের সহযোগিতা করে খোদ গোলাম কোরাইশী।

খোঁজ নিয়ে জানা যোয়, সেখান থেকে বিভিন্ন ক্রেতার কাছে মাদক সরবরাহ করা হচ্ছে। পরিচিত ক্রেতারা ফোনে অর্ডার দিয়েছে, সেই অনুযায়ী তাদের দেওয়া ঠিকানায় মাদক পৌঁছে দিয়ে আসবে বিক্রেতারা। এর জন্য টাকা কিছুটা বেশি নেওয়া হয়। এবি ব্লকের পাকিস্তানি পান দোকান এলাকার স্পটটি চালায় ল্যাংড়া সুমন নামে একজন। তার ইয়াবা ব্যবসায় সহায়তা করে রাজা ও শাহাজাদা নামে দুই ভাই। শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী ইশতিয়াকের বড় ভাই রাজু, দুই ভাই মামুন ও মাহমুদ এবং আবীর ফাট্টা এই স্পটের অন্যতম ব্যবসায়ী।

এদিকে জয়নাল হোটেলের মোড়ের (তিন রাস্তার মোড়) মাদক স্পট নিয়ন্ত্রণ করে ইমতিয়াজ। তার অধীনে কাজ করে কোপ মনু, চার ভাই হাসিব, মনির, হীরা ও সনু এবং মুতনা আরজু গওহরের দোকান স্পটে মাদক বিক্রি করে চোর জানু ও টুনটুন। গোবরপট্টি রোডের শহীদ হোটেল এলাকায় মাদকের ডিলার চুহা সেলিমের শ্যালক রানার সঙ্গে আছে চোর নূর, শাহনাজ, আরজু, রাজু ও ময়লা সেলিম। সৈনিক লীগ মোড়ের বিক্রেতাদের মধ্যে রয়েছে-গোলাম কসাই, মফিজ সুমন, চুসনি রাজু, কালু রহমান, ফর্মা মোস্তাকিম, পিচ্চি সাগর ও মোটকা রুবেল। মুরগিপট্টিতে আছে সৈয়দপুরী নওশাদ, মাউরা রাসেল, বাবু, রাজা, ভাতিজা রুবেল ও শমসদ। মাছপট্টিতে রয়েছে লম্বু আজিজ ওরফে হানড্রেড আজিজ, তার বড় ভাই পোলার, বুড্ডা রাজু ও জনি।

জানা যায়, আগে আজম গোলাম কোরাইশীর সঙ্গে ছিল। আজম নতুন করে আলাদা গ্রুপ করে বিভিন্ন স্পটে মাদকের ব্যবসা করছে। দেশব্যাপী জোরদার মাদকবিরোধী অভিযানের সময় এই ক্যাম্পেও কয়েক দফায় বড় অভিযান চালানো হয়। তারপরও পুরোপুরি বন্ধ হয়নি মাদক ব্যবসা। সর্বশেষ করোনাকালে প্রশাসনিক নজরদারির শিথিলতার সুযোগে মাদক ব্যবসায়ীরা আবারো তৎপর হয়ে উঠেছে। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ফাঁকি দিতে মাদক বিক্রির সময় আর স্পট বদলে ফেলা হয়েছে।

এদিকে এ বিষয়ে জানতে স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর সৈয়দ হাসান নূর ইসলাম রাষ্ট্রন বলেন, ‘আমার জানামতে সে মাদক ব্যবসায় জড়িত না। তবে মাদক ব্যবসায়ীদের শেল্টার দেয় কি না তা জানি না।’ এক প্রশ্নের জবাবে কাউন্সিলর বলেন, গোলাম কোরাইশীর রাজনৈতিক পরিচয় সে সৈনিক লীগের সহসভাপতি হিসেবে জানি।’

স্থানীয় থানার ওসি আব্দুল লতিফ বলেন, ‘গোলাম কোরাইশীর বিরুদ্ধে সরাসরি মাদক ব্যবসার কোনো অভিযোগ এখনো আসেনি। তবে মাদক ব্যবসায়ীদের শেল্টার দেন কি না এ বিষয়টা তদন্ত সাপেক্ষ বিষয়। আমরা জেনেভা ক্যাম্পের মাদক নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছি। ইতোমধ্যে চেকপোস্টও বসিয়েছি। তদন্ত করে গোলাম কোরাইশী যদি মাদক ব্যবসায়ীদের শেল্টারের প্রমাণ পাই তবে অবশ্যই তাকে গ্রেপ্তার করা হবে।’

এদিকে সৈনিক লীগ মোহাম্মাদপুর থানার স্বঘোষিত সভাপতি গোলাম কোরাইশীর বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি আরো বলেন, তার বিরুদ্ধে এ সব অভিযোগ সত্য নয়। ক্যাম্পের কিছু লোকজন শত্রুতা করে আমার বিষয়ে অভিযোগ দিচ্ছে।

স্থানীয় লোকজন বলছেন, গোলাম কোরাইশী আর আজম এক সময় একসঙ্গেই ছিল। এখন আলাদা হওয়ার কারণে আধিপত্য নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই দুপক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। বুধবার তারা সংঘর্ষেও জড়ায়। এ নিয়ে এখনো উত্তেজনা বিরাজ করছে, যে-কোনো মুহূর্তে বড় ধরনের সংঘর্ষ হতে হতে পারে বলে তারা আশঙ্কা করছেন।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads