• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯

অপরাধ

অপরাধের হটস্পট পল্লবী

  • ইমরান আলী
  • প্রকাশিত ১৫ মার্চ ২০২১

রাজধানীর পল্লবী এখন অপরাধের নতুন হটস্পটে পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ও শীর্ষ সন্ত্রাসী মামুন গ্রেপ্তারের পর এলাকায় কিছুটা স্বস্তি এলেও এখন আড্ডুর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন এলাকাবাসী। বর্তমানে চাঁদাবাজি, দখলবাজি ও আধিপত্য বিস্তারে প্রায় অপ্রতিরোধ্য আড্ডু। এ সময় বেশ কয়েকজন শীর্ষ সন্ত্রাসীর নিয়ন্ত্রণে থাকা এই এলাকায় এখন জিম্মি হয়ে আছে তিন-চারটি গ্রুপের কাছে। গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে সন্ত্রাসী আড্ডুর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। 

স্থানীয়দের অভিযোগ, পলাতাক অন্যতম শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদাতের সঙ্গে যোগসাজশ করে পুরো পল্লবী এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছেন আড্ডু। এলাকার চাঁদাবাজ বাহিনী হিসেবে পরিচিত সুমন বাহিনী ও জয় বাহিনীকেও নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি। কুর্মিটোলা বিহারি ক্যাম্পে শতাধিক কিশোর নিয়ে বিশাল গ্যাংও গড়ে তুলেছেন। এ গ্যাংকে নিয়ন্ত্রণ করেন ক্যাম্পের রাজ আহম্মেদ ভলু। তিনি আড্ডুর ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত।

এ গ্যাংয়ের সদস্যরা আড্ডুর টোকেন দিয়ে অটোরিকশা থেকে চাঁদা তোলেন। কিছু সদস্য মাদক কারবারেও জড়িত। বাউনিয়া বাঁধের ছোট ডনখ্যাত ও আড্ডুর ঘনিষ্ঠ শুক্কুর মাতবরও একটি বাহিনী পরিচালনা করেন। এলাকায় জমি দখল ও মারামারির পরিকল্পনা হলে শুক্কুর সেখানে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য সরবরাহ করেন।

সম্প্রতি একটি সংস্থার গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উঠে এসেছ এমন সব চাঞ্চল্যকর তথ্য। প্রতিবেদনে ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতির সাথে জড়িত আড্ডু ভয়ংকর সন্ত্রাসী হয়ে উঠছে বলে উল্লেখ করে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়।

স্থানীয়রা বলছেন, শুধু পল্লবী নয়, পুরো মিরপুরের অন্যতম শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকায় আড্ডু। বিশেষ করে অটোরিকশার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর থেকে আড্ডু বেপরোয়া হয়ে ওঠে। পল্লবী এলাকায় প্রায় ৬ হাজার অটো রিকশা চলাচল করে। প্রতি অটো থেকে মাসে ১৫শ থেকে ১৭শ টাকা উঠানো হয়। আর এই টাকা দিয়ে কয়েকটি গ্রুপ তৈরি করে মাদক ব্যবসা থেকে শুরু করে দখল, ফুটপাতে চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্ম করছে।

পল্লবীর ৩ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সহসভাপতি হাজি আমান বলেন, দলীয় নামে আড্ডু এখন যা করছে তা আমাদের জন্য বোঝা হয়ে যাচ্ছে। তার চাঁদাবাজির বিষয় এখন ওপেন সিক্রেট। এক অটো থেকে মাসে কোটি কোটি টাকা চাঁদা আদায় করছে। আর এই সেই টাকা দিয়ে কিমাৈরদের দলে ভিড়িয়ে বিপথে নিয়ে যাচ্ছে।

প্রবীণ আওয়ামী লীগের এ নেতা বলেন, আড্ডুর বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য আমরা ইতোমধ্যে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতার সঙ্গে কথা বলেছি। সে যেভাবে তার কর্মকান্ড পরিচালনা করছে তাতে দলের দুর্নাম আরো বেশি হচ্ছে। আর বর্তমানে আড্ডু কোনো কমিটিতেও নেই। তিনি আরো বলেন, শুধু অটোরিকশা নয়, সে বাহিনী গড়ে সব জায়গা থেকে চাঁদাবাজি করে যাচ্ছে। প্রশাসনকে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ারও দাবি জানান তিনি। কাউন্সিলর কাজী জহিরুল ইসলাম মানিক বলেন, আমরা এক সময় বিভিন্ন সন্ত্রাসীর জিম্মি ছিলাম। পরে পরিস্থিতি পাল্টে যায়। কিছুদিন আগেও শীর্ষ সন্ত্রাসী যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত মামুন গ্রেপ্তার হয়েছে। কিন্তু নতুন করে আড্ডুর চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে সাধারণ মানুষ জিম্মি হয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, তার চাঁদাবাজিতে কোটি কোটি টাকা আসে। আর এই টাকা দিয়েই সে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে।

অটোতেই কোটি টাকার চাঁদাবাজি : অবৈধ হলেও রাজধানীর মিরপুর এলাকার ছোট সড়কে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। পল্লবী, রূপনগর, শিয়াল বাড়ি, দুয়ারীপাড়া, ইস্টার্ন হাউজিং, লালমাটি, বাউনিয়াবাঁধ, জুটপট্টি এলাকায় কয়েক হাজার অটোরিকশা চলাচল করে। এই যানগুলো এভাবে সড়ক দাপিয়ে বেড়ানোর পেছনে চলছে কোটি টাকা চাঁদার কারবার।

জানা গেছে, পল্লবী, মিরপুর ১৩ নম্বরসহ আশপাশের এলাকায় ৬ হাজার অটোরিকশা চলাচল করে। রূপনগর ও আশপাশের এলাকায় চলে প্রায় ৩ হাজার রিকশা।

এই ৯ হাজার অটোরিকশার প্রত্যেকটি থেকে প্রতি মাসে ১৫শ টাকা চাঁদা তোলা হয়। হিসাব অনুযায়ী, তাতে প্রতি মাসে ওঠে ১ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। কোনো অটোরিকশাচালক যেন ফাঁক-ফোকরে চাঁদা না দিয়ে চলতে না পারে, সেজন্য মাসে মাসে কার্ড বা মার্কা দেওয়ারও নিয়ম তৈরি করা হয়েছে। এক মাসের চাঁদা দিলে পরের মাসের জন্য দেওয়া হয় কার্ড বা মার্কা। এই কার্ড বা মার্কা দেখলে রাস্তায় ট্রাফিক শৃঙ্খলায় নিয়োজিত কোনো কর্মকর্তাও অটোরিকশাগুলোকে ধরেন না। আবার মূল সড়কে কখনো এসে যদি কোনো অটোরিকশা ধরাও পড়ে, তবে সেগুলোকে ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য চলে দেনদরবার। একপর্যায়ে ছাড়িয়ে নিয়েও যাওয়া হয়। আর এ কার্ডগুলো সরবরাহ করে আড্ডু। রাস্তায় কিশোর গ্যাংকে এই কার্ড তদারকির জন্য ব্যবহার করা হয়। যেন কার্ডের বাইরে কেউ চলতে পারেনা।

গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, আড্ডুর নিয়ন্ত্রণাধীন গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে মাদক, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, খুনসহ বিভিন্ন ধরনের ভয়ংকর অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ রয়েছে। পল্লবীতে অনেক নিম্ন আয়ের মানুষ বসবাস করে। বিহারি পল্লি ও বস্তি এলাকায় তাদের বাস। এসব এলাকার কিশোররা অল্প বয়সে স্কুল থেকে ঝরে পড়ে। তাদের খুব সহজে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করছে আড্ডু।

বেপরোয়া সুমন ও জয় বাহিনী : মাদক ব্যবসা ও জুয়া খেলাসহ নানা অপকর্মে জড়িত সুমন বাহিনী। তার কথামতো না চললে হামলা চালিয়ে হত্যাচেষ্টা করা হয়। নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ার কারণে সুমন বাহিনীর বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা করছে ভুক্তভোগীরা। এক মাসের ব্যবধানে সুমন বাহিনীর বিরুদ্ধে চারটি মামলা হয়েছে। চাঁদা না দিলে হামলার শিকার হতে হয়। এ বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে রয়েছে-সিফাত, রনি, জামান আহমেদ জামাল, লিজা, রাজন, সাগর, দুলাল, টিটু, দীপু, কাল্লু, লিটন, আবুল, বাবু ওরফে ইয়াবা বাবু, রুবেল, জাকির, তাহের, হাবিব, আপন আহমেদ ওরফে আপন। তাদের বিরুদ্ধে পল্লবী থানায় অনেক মামলা রয়েছে।

পুলিশ বলছে, সুমন এলাকার একজন চিহ্নিত সন্ত্রাসী। তার বিরুদ্ধে পল্লবী থানায় মামলা রয়েছে। স্থানীয়রা বলছেন, পল্লবী এলাকায় জয় চাঁদাবাজ হিসেবে পরিচিত। ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি পরিচয়ে জয় চাঁদাবাজি করছেন। চাঁদা না পেলে তার বাহিনী দিয়ে হামলা করেন। বিজয় দিবসে চাঁদা না পেয়ে এক ব্যবসায়ীর ওপর ফিল্মি স্টাইলে হামলা করে জয় বাহিনীর সদস্যরা।

জয়ের সহযোগী হিসেবে রয়েছে-ওয়াহিদ, সোহাগ, এহতেশাম, আশিক, আমান, রাসেল, সাকিল, আকাশ, সৈকত, ইমন, রানা, আরজুসহ অন্তত ২০ কিশোর। মিরপুর-১১ নম্বর এলাকার কয়েকটি কিশোর গ্যাংয়ের নিয়ন্ত্রণও করেন জয়।

সক্রিয় রাজন গ্রুপ : একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভয়ংকর রাজন গ্যাং পল্লবী এলাকায় এখনো সক্রিয়। সক্রিয় এ গ্রুপের অধিকাংশ সদস্য কিশোর ও তরুণ। গ্রুপের সদস্যরা দিনের বেলায় ঘুমায় আর রাত হলেই বিভিন্ন এলাকায় ছিনতাই শুরু করে। গ্রুপটির পেছনে রয়েছে সুমন।

গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, পল্লবী এলাকায় বিহারি রাসেল গ্যাং সক্রিয় রয়েছে। রাসেল মাদকের অন্যতম হোতা। রাসেল এক সময় পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ করত। সাত বছর আগে পল্লবী থানায় নির্যাতন করে ইমতিয়াজ হোসেন জনি হত্যার ঘটনায় সাত বছরের সাজাপ্রাপ্ত আসামি রাসেল। পুলিশের খাতায় তিনি এখনো পলাতক। এ ছাড়া বিচ্চু বাহিনী, পিচ্চি বাবুর গ্যাং, সাইফুল গ্যাং, সাব্বির গ্যাং, রিপন গ্যাং, মোবারক গ্যাং সক্রিয় রয়েছে।

অভিযোগের বিষয়ে শেখ মোহাম্মদ আলী আড্ডু বলেন, তার নাম ব্যবহার করে অপকর্ম করলে সে দায় তার নয়। তার বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কেউ কেউ অপপ্রচার চালাচ্ছে বলেও তিনি দাবি করেন। অটোরিকশা থেকে তিনি চাঁদা তোলেন না বলেও দাবি করেন।

ট্রাফিক পুলিশের মিরপুর বিভাগের ডিসি জসীম উদ্দীন মোল্লা বলেন, ব্যস্ত রাস্তায় অটোরিকশা চলাচল করতে পারবে না-এমন নির্দেশনা ট্রাফিকের সব কটি বিভাগকে দেওয়া হয়েছে। যেসব জায়গায় ট্রাফিক সদস্যরা দায়িত্ব পালন করেন না, সেসব স্থানে হয়তো অটোরিকশা চলাচল করে। এলাকার ভেতরে হয়তো কিছু অটোরিকশা চলাচল করে।

পল্লবী থানার ওসি কাজী ওয়াজেদ আলী বলেন, এলাকার শান্তিশৃঙ্খলা বিঘ্নকারী কেউ হলে আমরা অবশ্যই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব। এছাড়া পল্লবী এলাকাকে ঘিরে সন্ত্রাসী কার্যকালাপ করার চেষ্টা করলেও তা প্রতিহত করা হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, চাঁদাবাজ, চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নিয়ে থাকি।

সার্বিক বিষয়ে মিরপুর বিভাগের উপ-কমিশনার আ স ম মাহতাব উদ্দিন বলেন, চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িতদের কোনোভাবেই ছাড় দেওয়া হবে না। আমরা এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads