• মঙ্গলবার, ২১ মে ২০২৪, ৭ জৈষ্ঠ ১৪২৮
দ্বন্দ্ব গড়িয়েছে খুনে

ফাইল ছবি

অপরাধ

দ্বন্দ্ব গড়িয়েছে খুনে

  • ইমরান আলী
  • প্রকাশিত ২৩ মে ২০২১

জমি অধিগ্রহণ থেকে রক্ষা পেতে আওয়ালের নিকট সহায়তা চাওয়াই কাল হয়েছে সাহিনুদ্দিনের পরিবারের। জমি খেকো আওয়ালের অধিগ্রহণ থেকে রক্ষা পেতে ফ্রেশ জমিও দিয়েছিলেন সাইনুদ্দিনের পরিবার। তারপরও লোভী আওয়াল উল্টো তাদের সব জমি নিজের প্রকল্পের বলে বিক্রি ও দখল করার চেষ্টা করছিলেন। দীর্ঘ ১৮ বছর ধরে ভাড়াটে সন্ত্রাসী দিয়ে একের পর এক হামলা থেকে বেঁচে যাওয়া সাহিনুদ্দিনকে শেষ পর্যন্ত জীবন দিতেই হলো।

এদিকে আওয়ালের আটক হওয়ার খবরে তার নির্বাচনী এলাকা থেকেও একের পর এক চাঞ্চল্যকর খবর আসা শুরু হয়েছে। সেখানে সংসদ সদস্য হওয়ার পরও প্রতারণা করে অবৈধভাবে আয় করেছেন কোটি কোটি টাকা।  

সরেজমিনে পল্লবী এলাকায় ঘুরে দেখা যায়, এখনো এলাকাবাসীর চোখেমুখে আতঙ্কের ছাপ। নৃশংস হত্যার দৃশ্য বার বার যেন ফুটে উঠছে। সন্ত্রাসী সুমন ব্যাপারির দাপটও চোখে পড়ে।

জানা যায়, নিহত সাহিনুদ্দীন ও মাঈনুদ্দীন দুই ভাই। পল্লবীতে সরকারের অধিগ্রহণ থেকে তাদের জমি ছাড়িয়ে আনতে সাবেক এমপি এম এ আউয়ালের সঙ্গে তাদের রফা হয়। এর বিনিময়ে সাহিনুদ্দীনসহ তার ভাইয়েরা তাদের মালিকানাধীন জমি আউয়ালকে উপঢৌকন হিসেবে দেন।

কিন্তু উদ্ধার না করে আউয়াল উল্টো সব জমি তার আবাসন প্রকল্পের জন্য বিক্রি করতে শুরু করেন। মূলত এ নিয়েই শুরু হয় বিরোধ। এ নিয়ে দুই ভাইয়ের ওপর কয়েক দফায় হামলা করেন আউয়াল।

গত ১৬ মে রাজধানীর পল্লবীতে নিজ সন্তানের সামনে সাহিনুদ্দীন নৃশংসভাব খুন হন। তাকে আওয়ালের ভাড়া করা সন্ত্রাসীরা চাপাতি, রামদাসহ বিভিন্ন ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে।

পরদিন সাহিনুদ্দীনের মা মো. আকলিমা রাজধানীর পল্লবী থানায় ২০ জনের নামে মামলা করেন। এতে আউয়ালকে প্রধান আসামি করা হয়। অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয় ১৪-১৫ জনকে। পরে ২০ মে র্যাবের অভিযানে ভৈরব থেকে গ্রেপ্তার হন আউয়াল।

এম এ আউয়াল লক্ষ্মীপুর-১ আসনের সাবেক এমপি। তিনি তরীকত ফেডারেশনের নেতা হিসেবে আওয়ামী লীগের সমর্থনে মহাজোটের প্রার্থী হয়েছিলেন। তবে ২০১৮ সালে আর মনোনয়ন পাননি।

পল্লবীতে তার হ্যাভেলি প্রোপার্টিজের একটি আবাসন প্রকল্প আছে।

নিহত সাহিনুদ্দীনের ভাই মাঈনুদ্দীন বলেন, আউয়ালের সঙ্গে ২০০৪ সাল থেকে তাদের জমি নিয়ে মামলা-হামলা চলছে।

মাঈনুদ্দীন জানান, পল্লবীর উত্তর কালশিতে বুড়িরটেক এলাকায় তাদের পৈতৃক সূত্রে পাওয়া ৮৫ শতাংশ জমি আছে। পাঁচটি খণ্ডে বিভক্ত এই জমির চারটি খণ্ড ১৯৭২-৭৩ সালে সরকার একটি প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণ করে। মুক্তিযুদ্ধের পরে রক্ষীবাহিনীর আবাসনের জন্য এটি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল। জমিটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। কোনো স্থাপনা নেই।

মাঈনুদ্দীন বলেন, ‘এই জমি সরকারের অধিগ্রহণ থেকে ছাড়িয়ে আনার জন্য আমরা আউয়ালের সঙ্গে চুক্তি করি। আমাদের পাঁচ দাগের জমির মধ্যে চার দাগ সরকার নিয়ে গেছে। একটা দাগ ছিল আমাদের মালিকানায়। চার দাগের জমি সরকারের কাছ থেকে উদ্ধারের জন্য আউয়ালকে ২০ কাঠা ফ্রেশ জমি ফ্রি দিছি।’

মাঈনুদ্দীন বলেন, ‘আমি আমাদের ভাগের জমির পাওয়ার অব অ্যাটর্নি। তাই আমি আউয়ালকে জমি দিছিলাম আমাদের বাকি জমি উদ্ধারের জন্য। আউয়াল আমাদের জমি উদ্ধার না করে জমির মধ্যে সাইনবোর্ড দিয়ে আমাদের কাছ থেকে জমি কিনছে বলে মানুষের কাছে বেচা শুরু করে।’

মাঈনুদ্দীন ও সাহিনুদ্দীনের মালিকানাধীন জমিতে একসময় প্রায় এক হাজার বস্তিঘর ছিল, যা দুই ভাই ভাড়া দিতেন। আউয়ালকে উপঢৌকন হিসেবে দেওয়ার জন্য তারা সেই বস্তি তুলে দেন। এমপি আউয়াল সব জমিই বিক্রি শুরু করেন। এ নিয়ে দুই ভাই আপত্তি তোলেন।

আউয়াল এমপি থাকাকালে তাদের ওপর আগেও হামলা করেছেন উল্লেখ করে মাঈনুদ্দীন বলেন, ‘সে সময় মমিন বাহিনী নামে একটা বাহিনীর ৩০ জনকে আউয়াল বেতন দিয়ে রাখতেন। আমরা কিছু বললেই আমাদের মারধর করা হতো। এই মমিনের সঙ্গে আমাদের কোপাকোপিও হয়। তখন আমার ভাইয়ের হাত কেটে ফেলে।

‘আমার ভাই আহত হলে ওকে নিয়ে ঢাকা মেডিকেল চলে যাই। তখন ওরা আমাদের বাড়িতে হামলা করে। চঞ্চল নামে একটা ছেলেকে আমার ভাই মনে করে ওরা ওকে মেরে ফেলে। চঞ্চল আমাদের প্রতিবেশী।’

‘তখন মমিন ও তার বাহিনীর সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা হয়। আউয়াল হুকুম দিলেও রানিং এমপি ছিলেন বলে রেহাই পান। পরে মমিনরে র‍্যাব ক্রসফায়ারে দিছে। তখন কিছুদিন শান্তিতে ছিলাম। পরবর্তীতে সুমন এবং টিটুর মাধ্যমে ২০ থেকে ৩০ জন লোক নিয়োগ দেয়।’

এদিকে পল্লবীর যে বাড়িতে ১৬ মে সাহিনুদ্দীনকে কোপানো হয়েছিল এবং সেখান থেকে তিনি দৌড়ে পাশের যে বাসায় গিয়েছিলেন, এ দুই বাসার গ্যারেজে এখনো রক্তের দাগ লেগে আছে। ওইদিন বিকেল চারটার দিকে এলাকার অনেকের চোখের সামনে ঘটনাটি ঘটলেও এখন কেউ তা স্বীকার করছেন না। সবাই বলছেন, তারা হত্যার পরে সেখানে হাজির হয়েছেন।

পাশের ভবনের দোতলার ভাড়াটিয়া আলামিন বলেন, ‘আমরা তখন ঘুমায় ছিলাম। মারামারি হওয়ার পরে চিল্লাচিল্লির শব্দ শুনে বাইর হইছি। গিয়ে দেখি অনেক লোকজন। আর লাশ পড়ে আছে। বিকেল চারটার পরে হবে ঘটনাটা। এর বাইরে কিছু জানি না।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কিশোর বলেন, ‘এরা সবাই দেখছেন। কিন্তু সুমন বাহিনীর ভয়ে কেউ কিছু বলছে না। সুমনকে এলাকার সবাই ভয় পায়। তার ভয়ে কেউ মুখ খুলছে না।’

সাহিনুদ্দীনের স্ত্রী মাহমুদা আক্তার শোকে পাথর হয়ে আছেন। এলাকার মানুষ তাকে দেখতে এসে ভিড় করছেন। কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন তিনি।

মাহমুদা আক্তার  বলেন, ‘আউয়াল দীর্ঘদিন ধরে আমার স্বামীকে একটার পর একটা মামলা দিছে এই জমি দখল করার জন্য। যখন দেখছে মামলা দিয়ে কাজ হয় না, তখন তার গুন্ডা-পান্ডা দিয়ে হামলা শুরু করছে। প্রতিবার হামলায় আমরা দৌড়াইয়া গিয়া আমার স্বামীকে উদ্ধার করছি।

কিন্তু এবার আর হলোনা। এবার তারা মেরেই ফেললো।

সাহিনুদ্দীনের মা আকলিমা খাতুন বলেন, ‘এই জমি নিয়ে আমার স্বামীও লইড়া গেছে। কতবার বসছে এটা নিয়ে, সমাধান হয় নাই। জমি মাপ দিয়েই আমাদের সান্ত্বনা দিয়ে রাখে। কিন্তু বুঝাইয়া দেয় না। জমির যে দাম, এই দাম আমাদের দিতে গেলে অনেক টাকা দেওয়া লাগত। রংবাজ সন্ত্রাসগো অল্প কিছু দিয়ে মাইরা পথের কাটা সরাইয়া দিতে চাইছিল।’

এদিকে দশম সংসদ নির্বাচনে মহাজোট থেকে তিনি তরীকত ফেডারেশনের হয়ে লক্ষ্মীপুর-১ আসনের প্রার্থী হন। কিন্তু প্রথম থেকেই তিনি গলদ শুরু করেন। নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করে ২০১৩ সালের ২৩ ডিসেম্বর হেলিকপ্টার নিয়ে রামগঞ্জে আসেন। তার হেলিকপ্টারটি রামগঞ্জ পৌরসভা ভবনের ছাদে অবতরণ করে। একইদিন বিকেলে তিনি হেলিকপ্টারে করে আবার ঢাকায় ফিরে যান। নিজের অবস্থান জানান দিতে ওইদিন হেলিকপ্টারে এসে তিনি ‘কারিশমা’ দেখিয়েছিলেন।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি ‘একতরফা’ নির্বাচনে আউয়াল সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। অবশ্য তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীও ছিল। কিন্তু কেন্দ্রীয় নির্দেশে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা নির্বাচনে তার জন্য কাজ করেছিল। নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে রামগঞ্জে এসে নিজের অবস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে তিনি কাজ শুরু করেন।

কিন্তু তার বিরুদ্ধে এলাকায় স্থানীয় প্রশাসনে প্রভাব বিস্তার, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের হয়রানি, সরকারি বরাদ্দ লুটপাট ও কমিশন বাণিজ্যের অভিযোগ এখনো মানুষের মুখে-মুখে। তার অপকৌশল আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতাকর্মীই মেনে নিতে পারেননি। এজন্য অনেক নেতাকর্মীই হামলা-মামলা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এ নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা তার ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুইজন ইউপি চেয়ারম্যান জানান, এমপি পদটি আউয়াল প্রতারণা ব্যবসা প্রসারে ব্যবহার করেছেন। স্থানীয়ভাবেও তিনি চেয়েছিলেন তার অপকর্মের রাজত্ব সৃষ্টি করতে, কিন্তু পারেননি। এজন্য বিভিন্নভাবে নেতাকর্মীদের হয়রানি হতে হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় আওয়ামী লীগের দুইজন সিনিয়র নেতা জানান, ভূমি দস্যুতার মাধ্যমে আউয়াল টাকার পাহাড় গড়েছেন। প্রতারণা করে অনেককেই নিঃস্ব করে দিয়েছেন। প্রতারণার মাধ্যমেই তার উত্থান হয়েছে। তার বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করতে গেলেই নিজস্ব লাঠিয়াল বাহিনী দিয়ে তাদের হয়রানি করত। এমপি পদ ব্যবহার করে তিনি প্রতরণার ব্যবসার প্রসার ঘটিয়েছেন। রামগঞ্জে আশানুরূপ কোনো উন্নয়ন করেনি। উল্টো প্রতিনিধির মাধ্যমে সব কাজ থেকে কমিশন হাতিয়ে নিতেন।

রামগঞ্জ উপজেলা বিআরডিবির চেয়ারম্যান ও উপজেলা যুবলীগের সাবেক যুগ্ম-আহ্বায়ক মোস্তাফিজুর রহমান সুমন ভূঁইয়া বলেন, আউয়াল এমপি থাকাকালে রামগঞ্জে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা অনেক হামলা-মামলার শিকার হয়েছে। তিনি ভূমিদস্যু হিসেবে স্থানীয়ভাবে সবার কাছে পরিচিত। প্রয়োজনের তাগিদে নিজের স্বার্থে তিনি আওয়ামী লীগকে ব্যবহার করে টাকার পাহাড় গড়েছেন। আমরা তখন অসহায় ছিলাম।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads