• শনিবার, ৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪২৯

অপরাধ

পারিবারিক দ্বন্দ্বে বাড়ছে খুন

  • ইমরান আলী
  • প্রকাশিত ২১ জুন ২০২১

‘বাবা, মা ও বোনকে খুন করেছি, তাদের উদ্ধার করুন। আপনাদের আসতে দেরি হলে স্বামী ও মেয়েকেও খুন করব।’ ৯৯৯-এ ফোন করে এভাবেই বলছিলেন মেহজাবিন। গত শনিবার সকাল আটটার দিকে এ কল করেন তিনি। পরে কদমতলী থানা-পুলিশ উদ্ধার করে তিনজনের মরদেহ। অসুস্থ অবস্থায় মেহজাবিনের স্বামী শফিক ও তার মেয়েকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

শুধু কদমতলীর নৃশংস এ ঘটনাই নয়, সম্প্রতি পারিবারিক কলহে বাড়ছে হত্যার ঘটনা। আর এসব হত্যাকাণ্ড ঘটানো হচ্ছে নৃশংস ও অমানবিকভাবে। এর আগে রাজধানীর দক্ষিণখান, বনানী ও গাজীপুরে স্বামীকে ৬ টুকরো হত্যার ঘটনা ঘটেছে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এমনটা মানসিকতার পেছনে অন্যতম কারণ বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক। বিশেষ করে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পারস্পরিক সময় না দেওয়াটাই তৈরি করেছে বড় দেয়াল। নিজেদের মধ্যে আস্থার অভাব তৈরি হয়েছে দিনে দিনে। বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক কিংবা অন্য কোনো অনৈতিক সম্পর্ক যখন জানাজানি হয়ে যায়, তখনই ভুক্তভোগীদের মধ্যে এক ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, যার প্রভাবে ব্যক্তি হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত ঘটাতে পারে। গত ২৫ মার্চ রাজধানীর দক্ষিণখান সরদারবাড়ি জামে মসজিদের সেপটিক ট্যাংক থেকে আজহারুল ইসলাম (৪০) নামে এক গার্মেন্টকর্মীর ৭ টুকরো লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় র্যাব মসজিদের ইমাম আব্দুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, বাসায় আসা-যাওয়ার সূত্র ধরে আজহারুলের স্ত্রীর সঙ্গে আব্দুর রহমানের অনৈতিক সম্পর্ক তৈরি হয়। এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করতে ২০ মে মসজিদে ইমামের কক্ষে গিয়ে খুন হন তিনি। পরে তার লাশ গুম করতে সাত টুকরো করে সেপটিক ট্যাংকে লুকিয়ে রাখা হয়। রাজধানীর দক্ষিণখানের পর এবার গাজীপুর মহানগরীর কাশিমপুরে পরকীয়ায় বাধা দেওয়ায় স্বামীকে ছয় টুকরো করে হত্যা করেছে স্ত্রী ও তার প্রেমিক। নিহতের নাম সুমন মোল্লা (২৮)। তার বাড়ি বাগেরহাটের চিতলমারী থানায়। এ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতে কাশিমপুর সারদাগঞ্জ হাজি মার্কেটের পুকুরপাড় এলাকায় জামাল উদ্দিন নামে এক ব্যক্তির সেপটিক ট্যাংক থেকে অজ্ঞাত হিসেবে সুমনের হাত-পা ও মাথাবিহীন লাশ উদ্ধার করেছিল পুলিশ।

গত ৩০ মার্চ  ভোরে সুমন মোল্লার স্ত্রী আরিফা বেগম (২৪) ও তার প্রেমিক তনয় সরকারকে (৩১) গ্রেপ্তার করে পুলিশ। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা হত্যাকাণ্ডের কথা স্বীকার করেছে। এরপর গত শনিবার সারদাগঞ্জের তেঁতুইবাড়ির মিল সংলগ্ন ময়লার ভাগাড় থেকে গলিত অবস্থায় লাশের বাকি পাঁচ টুকরো, একই এলাকার হাজি মার্কেটের পুকুরপাড়ের ময়লার স্তূপ থেকে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহূত চাপাতি ও করাত এবং তনয়ের বাসা থেকে সুমনের মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়। গত ১ জুন রাজধানীর মহাখালী ও বনানী এলাকা থেকে এক ব্যক্তির ছয় টুকরা লাশ উদ্ধারের ঘটনায় অপরাধীকে শনাক্ত করেছে গোয়েন্দা পুলিশ। দাম্পত্য কলহের জেরে অচেতন করে হত্যার পর, স্ত্রী নিজেই স্বামী ময়নার লাশ ছয় টুকরা করেছে  বলে জানান  ডিএমপির যুগ্ম-কমিশনার (ডিবি) হারুন-অর-রশিদ।

এর আগে রাজধানীর বনানী এলাকা থেকে ময়নার প্রথম স্ত্রী ফাতেমাকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ। ডিবির কর্মকর্তা হারুন অর রশিদ বলেন, ‘দাম্পত্য কলহের জেরে ময়নাকে পানির সঙ্গে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে খাওয়ায় তার প্রথম স্ত্রী ফাতেমা। এ সময় ময়না মিয়ার সঙ্গে ফাতেমার ধস্তাধস্তি হয়। আবারো পানি চাইলে ঘুমের ওষুধ মেশানো পানি  খাওয়ানো হয় তাকে। পানি খেয়ে অচেতন হয়ে পড়লে দা দিয়ে কুপিয়ে ছয় টুকরো করে হত্যা করে তার স্ত্রী ফাতেমা। গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদে তিনি সব ঘটনা এবং দায় স্বীকার করেছেন।

বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের জেরে হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞানের অধ্যাপক ডক্টর জিয়া রহমান বলেন, ‘আস্থার অভাব তো আছেই, তারপরও সম্পর্কগুলো যখন জনসম্মুখে চলে আসে তখন এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হয়। নিরাপত্তাহীনতা ও হিংসাত্মক মনোভাবের কারণেই হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলো ঘটছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ ধরনের সম্পর্কগুলো যখন সমাজের সামনে চলে আসে তখন আরো অনেক মানুষ এতে জড়িয়ে পড়ে।’

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডাক্তার মেখলা সরকার বলেন, ‘বিষয়টি এমন নয় যে, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক আগে ছিল না। তবে সম্প্রতি এটি প্রকাশ হচ্ছে বেশি। দাম্পত্য সম্পর্কে যখন কোনো সমস্যা হয়, তখন বিষয়টি জানাজানি হলে তা মানসিক চাপ বাড়ায়। অনেকেই তা সহ্য করতে পারেন না। তখনই ব্যক্তি হিতাহিত জ্ঞান হারায় ও হত্যার মতো ঘটনা ঘটায়। আবার ক্রাইম সিরিয়ালগুলোও এ ধরনের হত্যাকাণ্ডে উসকানি দেয়।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, ‘সম্প্রতি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে আস্থার অভাব বেশি দেখা যাচ্ছে। এতে আন্তরিকতা কমে যাচ্ছে। এ ছাড়া দেখা যাচ্ছে স্বামী বিভিন্ন সময়ে কাজের কারণে বাইরে থাকছে। স্ত্রী বাসায় একা। একাকিত্বের সুযোগে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। আবার একইভাবে দেখা যাচ্ছে স্বামীরাও জড়িয়ে পড়ছেন বিভিন্ন বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের দিকে। একটি পরিবার কিংবা দাম্পত্য পরিচালনা করতে যে মানসিক ও সামাজিক দক্ষতা উপলব্ধির প্রয়োজন, নিজেদের প্রস্তুত করার প্রয়োজন, ওই জায়গায় মোটা দাগে ঘাটতি দেখা যাচ্ছে।’

ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার কৃষ্ণপদ রায় বলেন, পারিবারিক বন্ধন আগের মতো নেই। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এক রকমের সন্দেহপ্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। আবার এই অবিশ্বাস থেকে পরস্পর বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে জড়ায়। এটিই যখন প্রকাশ হয়ে যায় তখন উগ্রতা চলে আসে। আর এ থেকে খুনের মতো নৃশংস ঘটনাও ঘটে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, আমরা বেশ কিছু মামলা তদন্ত করতে গিয়ে স্বামী-স্ত্রীর অবিশ্বাসের জায়গা থেকে এ ধরনের ঘটনার অনেক তথ্য পেয়েছি। পারিবারিক বন্ধন আরো দৃঢ় করতে হবে। পরস্পরের আস্থা বৃদ্ধি করণীয় সবকিছু দুজনের করা প্রয়োজন। পারিবারিক আস্থা বৃদ্ধি পেলে সমাজে এ ধরনের ঘটনা কমে আসবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads