• বুধবার, ১৫ মে ২০২৪, ১ জৈষ্ঠ ১৪২৯

অপরাধ

অনলাইনে সক্রিয় নারী জঙ্গি

  • ইমরান আলী
  • প্রকাশিত ৩০ আগস্ট ২০২১

দেশে বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনে রয়েছে নারী সদস্য। বিশেষ করে নব্য জেএমবিতে প্রায় একশর মতো নারী সদস্য বিভিন্ন সময় আটক হয়েছে। এমনকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে নারী সদস্যরা আত্মঘাতী হামলার ঘটনাও ঘটিয়েছে। তবে এবারই প্রথম আনসার আল ইসলাম নামের জঙ্গি সংগঠনের এক নারী সদস্যকে আটক করল ডিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম (সিটিটিসি)।

সিটিটিসির কর্মকর্তারা বলছেন, জোবাইদা সিদ্দিকা নাবিলা নামের গ্রেপ্তার নারী জঙ্গির সাথে আনসার আল ইসলামের সর্বোচ্চ কথিত সামরিক শাখার যোগাযোগও ছিল। যে কোনো মুহূর্তে জিহাদের ডাক আসলে সে সামনের সারিতে থাকতে প্রস্তুত ছিল। তাকে গ্রেপ্তারের মধ্যে দিয়ে বড় ধরনের অঘটন থেকে রক্ষা হয়েছে বলেও দাবি কর্মকর্তাদের।

জঙ্গি নাবিলার এবার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল। গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর বাড্ডা এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় তার কাছ থেকে সিমকার্ড ও মেমোরিকার্ডসহ একটি মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়। সিটিটিসির দাবি, এই প্রথম আনসার আল ইসলামের কোনো নারী সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হলো। এর আগে অন্য জঙ্গি সংগঠনের নারী সদস্য গ্রেপ্তার হলেও তারা নাবিলার মতো ‘প্রশিক্ষিত’ ছিলেন না।

গতকাল রোববার ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে সিটিটিসির প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান বলেন, আনসার আল ইসলামের মিডিয়া শাখায়. অর্থাৎ ‘জঙ্গিবাদের প্রচার প্রচারণার’ দায়িত্ব পালন করতেন নাবিলা। তবে সামরিক শাখার সঙ্গেও তার ‘যোগাযোগ ছিল’। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে নাবিলা জানায়, সে ২০২০ সালের প্রথম দিকে ছদ্মনামে একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খোলে। এক সময় সে ফেসবুকে আনসার আল ইসলামের অফিসিয়াল ফেসবুক পেইজ ‘তিতুমীর মিডিয়া’র খোঁজ পায়। তখন ওই পেজে যুক্ত হয়ে আনসার আল ইসলামের বিভিন্ন উগ্রবাদী ভিডিও, অডিও এবং আর্টিকেল সম্পর্কে ধারণা পায় এবং তাদের মতাদর্শ নিজের ভেতরে লালন করতে শুরু করে। তিনি জানান, এক পর্যায়ে তিতুমীর মিডিয়ার পেজ অ্যাডমিনের সাথে তার যোগাযোগ হয়। পরে সেই পেজ অ্যাডমিন তাকে উগ্রবাদী জিহাদি কন্টেন্টসহ আনসার আল ইসলামের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটগুলোর লিংক দেয়। এভাবে ধীরে ধীরে ওই তরুণী আনসার আল ইসলামের মতাদর্শ ছড়িয়ে দেওয়ার কাজে যুক্ত হন। ফেসবুক ও টেলিগ্রামসহ বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফরমে ছদ্মনামে একাধিক অ্যাকাউন্ট খুলে তিনি কাজটি করতেন।

সিটিটিসি প্রধান বলেন, সে আনসার আল ইসলামের মতাদর্শ প্রচারের জন্য টেলিগ্রাম মাধ্যম ব্যবহার করত। টেলিগ্রামে তার চারটি অ্যাকাউন্ট এবং সেই টেলিগ্রাম একাউন্টের মাধ্যমে ১৫টির বেশি চ্যানেল চালাত। এসব চ্যানেলে আনসার আল ইসলামের বিভিন্ন উগ্রবাদী সহিংস ভিডিও, অডিও, ছবি ও ফাইল শেয়ার করত। তার সবগুলো টেলিগ্রাম চ্যানেল মিলে আনুমানিক ২৫ হাজার সাবস্ক্রাইবার আছেন, যারা নিয়মিত তার চ্যানেলগুলো অনুসরণ করে।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ‘জিহাদ কেন প্রয়োজন’, ‘কিতাবুল জিহাদ’, ‘একাকী শিকারি লোন উলফ’, ‘স্লিপার সেলগুলোতে গোয়েন্দাদের অনুপ্রবেশ প্রতিরোধের উপায়’,  ‘নীরবে হত্যার কৌশল’, ‘পুলিশ শরিয়তের শত্রু’, ‘আল আনসার ম্যাগাজিন ইস্যু’, ‘জিহাদের সাধারণ দিকনির্দেশনা’, ‘তাগুতের শাসন থেকে মুক্তির ঘোষণা’ ইত্যাদি উগ্রবাদী বই বিভিন্ন সময়ে নাবিলার টেলিগ্রাম চ্যানেলগুলো থেকে প্রকাশ করা হতো। পাশাপাশি নাবিলা আনসার আল ইসলামের বিভিন্ন অফিসিয়াল ও আন-অফিসিয়াল চ্যানেলেও যুক্ত ছিলেন। সেসব চ্যানেলে আইইডি, স্মোক বম্ব, আগ্নেয়াস্ত্র তৈরি করা এবং বিভিন্ন হামলার কৌশলগত বিষয় নিয়ে ‘ভিডিও ও ফাইল শেয়ার করতেন’ তিনি।

আসাদুজ্জামান বলেন, এসব প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই নাবিলা জিহাদের ময়দানে অংশগ্রহণের জন্য নিজেকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করে। এমনকি সম্প্রতি তার বিয়ের কথাবার্তা চললে সে ছেলেপক্ষকে জানায়, জিহাদের ময়দানে ডাক এলে সামনের সারিতে থাকবে। এমনকি শহীদি মৃত্যু এলেও পিছু হটবে না। ছেলেও যদি এমন মতাদর্শের না হয়, সে বিয়ে করবে না বলে জানিয়ে দেয়।

তাকে ছাড়া আনসার আল ইসলামের আর কোনো নারী সদস্যের সন্ধান পাওয়া গেছে কিনা জানতে চাইলে আসাদুজ্জামান বলেন, ‘এ বিষয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করছি। সে আনসার আল ইসলামের যে গ্রুপের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল, সেইসব লোকজনের নাম আমরা জানার চেষ্টা করছি। তবে এই মুহূর্তে এই বিষয়ে বিস্তারিত আমরা বলতে চাইছি না।’

নাবিলার টেলিগ্রাম চ্যানেলের সাবস্ক্রাইবারদের মধ্যে কোনো নারী আছেন কিনা-এমন প্রশ্নের জবাবে সিটিটিসি প্রধান বলেন, ‘সাবস্ক্রাইবার কোনো নারী থাকতে পারে। আমরা মূলত তরুণদের টার্গেট করে এবিষয়ে অনুসন্ধান করছি। সে নারী-পুরুষ সকলকে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করত।’

তার জঙ্গিবাদে জড়ানোর ক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকা কী ছিল জানতে চাইলে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘পরিবার চেষ্টা করেছিল তাকে জঙ্গিবাদ থেকে দূরে সরিয়ে আনতে। কিন্তু পারেনি। পরিবারের অমতে তিনি এক আত্মীয়র বাড়িতে বেড়ানোর কথা বলে বেরিয়ে পড়েন।’ নাবিলার বিরুদ্ধে বাড্ডা থানায় একটি মামলা হয়েছে। আদালতে হাজির করে ৫ দিনের রিমান্ডে নিয়ে পুলিশ তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে।

এদিকে গুলশানের হোলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার পর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি) এখন পর্যন্ত ৮৫ নারী জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করে। আর জঙ্গিবাদবিরোধী অভিযানে নিহত হন ১১ জন।

২০১৬ সালের ২৪ ডিসেম্বর রাজধানীর আশকোনায় অপারেশন রিপল ২৪ চলাকালীন এক নারী সন্তানকে সামনে ঠেলে দিয়ে আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণে নিহত হন। এর মধ্যে দিয়ে নব্য জেএমবিতে নারী জঙ্গিরা প্রকাশ্য হয়। তখনই এ ব্যাপারে সতর্ক হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এছাড়া রাজশাহীর গোদাগাড়িতে অভিযান চলাকালীন সময়ে নারী এক জঙ্গি প্রকাশ্য ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে ফায়ার সার্ভিস কর্মীকে হত্যা করে। ওই সময়ও নারী জঙ্গিদের নিয়ে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি হয়।

সূত্র জানায়, বাংলাদেশের নারীদের জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হওয়ার পেছনে সিটিটিসি কোনো একক কারণ খুঁজে পায়নি। জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ স্বামীরা স্ত্রীদের জঙ্গিবাদের দিকে ঠেলে দিয়েছেন, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবও উদ্বুদ্ধ করেছেন। কোথাও ভার্চুয়াল যোগাযোগের মাধ্যমে নারীরা উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। কোথাও নারী নিজেই সঙ্গী বা স্বামীকে উদ্বুদ্ধ করেছেন জঙ্গিবাদে।

সিটিটিসি বলছে, পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, স্টাডি গ্রুপ, মসজিদ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন নারীরা। কেউ জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন হতাশা থেকে কিংবা বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে।

সিটিটিসির কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশের পুরোনো জঙ্গিগোষ্ঠী হরকাতুল জিহাদ, বাংলাদেশ (হুজি, বি), জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (পুরোনো জেএমবি) বা আল-কায়েদা সমর্থিত জঙ্গিগোষ্ঠী আনসার আল ইসলামের আগে নারী শাখা ছিল না। তবে আইএসপন্থি নব্য জেএমবি নানা কারণে ব্যাপকভাবে নারীদের অন্তর্ভুক্ত করছে। যত নারী জঙ্গিবাদে জড়িয়েছেন, তাঁদের ৬৩ শতাংশই নব্য জেএমবির, ২৩ শতাংশ পুরোনো অংশের।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, নজরদারি আগের চেয়ে কঠোর করা হয়েছে। এ কারণে তারা গ্রেপ্তারের আওতায় এসেছে। নাবিলাকে আরো জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। নারী জঙ্গিরা যেন কোনোভাবে মাথাচাঁড়া দিয়ে না উঠতে পারে সে ব্যাপারে সবাই সতর্ক রয়েছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads