• বৃহস্পতিবার, ১৬ মে ২০২৪, ২ জৈষ্ঠ ১৪২৯

অপরাধ

ইয়াবার রুটে আসছে আইস

  • ইমরান আলী
  • প্রকাশিত ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২১

ইয়াবার পর মায়ানমার থেকে আসছে ভয়ঙ্কর মাদক আইস। দেশে এখন পর্যন্ত যত আইসের চালান ধরা পড়েছে সবগুলোর রুট মায়ানমার। ইয়াবা কারবারিরাই বর্তমানে আইস বেচাকেনায় জড়িয়ে পড়ছে। গত দুই দিনে ধরা পড়েছে আড়াই কেজির বেশি আইস। এর মধ্যে বিজিবি অভিযানে দুই কেজি বাকিটা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর উদ্ধার করেছে।

এদিকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে রাজধানীতে সাড়ে ৩ হাজার মাদক ব্যবসায়ী রয়েছে উল্লেখ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। গতকাল শুক্রবার সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানায় তারা। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২১-২৫ বছর বয়সীরাই সবচেয়ে বেশি মাদকাসক্ত। 

১০ কোটি টাকার আইস জব্দ বিজিবির : গত বৃহস্পতিবার বিজিবির টেকনাফ ব্যাটালিয়ন গোপন তথ্যের ভিত্তিতে জানতে পারে, টেকনাফের মিঠাপানিছড়া গ্রামের একটি বাড়ীতে ক্রিস্টাল মেথ আইস পাচারের জন্য রাখা হয়েছে। এমন তথ্যের ভিত্তিতে টেকনাফ বিজিবির একটি বিশেষ টহলদল মিঠাপানিছড়ার সন্দেহজনক বাড়িতে তল্লাশি চালায়। এ সময় সন্দেহভাজন একজন বাড়ির পিছনের দরজা দিয়ে পালানোর চেষ্টা করে। বিজিবি টহলদল চারদিক থেকে ঘেরাও ওই ব্যক্তিকে আটক করতে সক্ষম হয়। আটককৃত ব্যক্তির স্বীকারোক্তিতে উক্ত বাড়ির ফলস সিলিংয়ের উপরে অভিনবভাবে লুকানো অবস্থায় ২ কেজি ক্রিস্টাল মেথ আইস উদ্ধার করে। এ সময় মুজিব নামের ওই ব্যক্তিকে আটক করা হয়। বিজিবি জানায়, জব্দকৃত আইসের মূল্য প্রায় ১০ কোটি টাকা। এখন পর্যন্ত এটাই আইসের সর্বোচ্চ চালান। আর এগুলো আনা হয় মায়ানমার সীমান্ত দিয়ে।

রাজধানী ঘিরে সাড়ে ৩ হাজার কারবারি : গতকাল শুক্রবার মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সংবাদ সম্মেলনে জানায়, ঢাকাকে ঘিরে সাড়ে ৩ হাজার মাদক ব্যবসায়ী রয়েছে। মাঠ পর্যায়ে নতুন তালিকা তৈরি করে বার্ষিক প্রতিবেদন আকারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালায় থেকে আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী পুলিশ ও র্যাবকে এ তালিকা দিয়ে মাদকবিরোধী অভিযান জোরদার করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়,  সম্প্রতি রাজধানীর গুলশান, ভাটারা, কুড়িল ও রমনা এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৫৬০ গ্রাম আইস ও ১২০০ পিস ইয়াবাসহ পাঁচ মাদক কারবারিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) দাবি, এটি এখন পর্যন্ত ঢাকায় জব্দ হওয়া আইসের এটা সবচেয়ে বড় চালান। এ সময় দুটি প্রাইভেটকারও জব্দ করা হয়, যার আনুমানিক মূল্য কোটি টাকা।

সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন ঢাকা বিভাগের প্রধান ও সংস্থাটির অতিরিক্ত পরিচালক ফজলুর রহমান। তিনি বলেন, আইস ২০০৭ সালে প্রথম ধরা পড়েছিল। দীর্ঘদিন অস্তিত্ব না থাকলেও ২০১৯ সাল থেকে আবার নতুন করে আইসের প্রভাব বাড়ছে। গত আগস্টে আমরা একজনকে গ্রেপ্তার করি। তার তথ্যের ভিত্তিতে গত ২১ ও ২২ সেপ্টেম্বর অভিযান পরিচালনা করি। সেই অভিযানে ১০ জনের সিন্ডিকেটকে আটক করতে সক্ষম হই। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে আবারো এই পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছি।

তিনি বলেন, মাদকটির প্রতি গ্রামের দামই প্রায় ১০ হাজার ৫০০ টাকা। এই মাদকসেবন ব্যয়বহুল হওয়ায় সচ্ছল পরিবারের ছেলেমেয়েরাই এই মাদকের সঙ্গে জড়িত হয়। গ্রেপ্তার পাঁচজনও সচ্ছল পরিবারের। যেমন- জাকারিয়া অস্ট্রেলিয়া থেকে পড়াশোনা করে এসেছে। তারেক আহম্মেদ যুক্তরাজ্য থেকে এসেছে। এছাড়া জসিম উদ্দিন বাড়ি ও গাড়ির মালিক। সবাই অর্থ ও বিত্তশালী। এরা কেন জড়িয়ে পড়ছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের এই কর্মকর্তা বলেন, মূলত এরা প্রলোভনে এই অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়ছে। আইসের দাম অনেক বেশি হওয়ায় মাদকদ্রব্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা অধিক টাকা আয়ের লোভে প্রলোভন দেখিয়ে এসব কাজে তাদের নিয়ে আসে।

মাদকের সঙ্গে জড়িত মূলহোতারা কেন আটক হচ্ছে না জানতে চাইলে তিনি বলেন, মূলত গডফাদারেরা গা ঢাকা দিয়ে থাকে। অর্থ বিনিয়োগ ও সহযোগিতা করলেও সাধারণত তারা আড়ালে থাকে। আর সংশ্লিষ্টদের এমনভাবে ট্রেইন করা হয়, তাদের যত কিছুই করা হয় মূলহোতাদের তথ্য দিতে চায় না। তারপরেও কেবল ঢাকারই প্রায় ৩ হাজার ৫০০ জনের মতো মাদক কারবারির তথ্য আমাদের কাছে এসেছে। আমরা অভিযান পরিচালনা করছি।

তিনি বলেন, তথ্য থাকলেও এসব মাদক কারবারিদের আটক করা যায় না। আটক করার জন্য তাদের কাছে মাদক থাকতে হয়। এখন তারা দিনে মাদক চালান না করে রাতে করে কিংবা গভীর সমুদ্রে লেনদেন করে। আমরা কৌশল পরিবর্তন করে অভিযান পরিচালনা করছি।

কোন দেশ থেকে এই নতুন মাদক আইস আসছে জানতে চাইলে ফজলুর রহমান বলেন, এই মাদক মূলত মিয়ানমার থেকেই বাংলাদেশে আসছে। দেশে এই মাদক তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা আছে কি-না প্রশ্নে তিনি বলেন, এই মাদক দেশে তৈরি হওয়ার সুযোগ নেই। যে উপাদান এই আইসের জন্য প্রয়োজন হয় তা আমাদের দেশে পাওয়া যায় না। কিছু উপাদান ওষুধ তৈরিতে ব্যবহার হলেও এগুলো অনেক আগেই নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

যারা ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে যারা জড়িত তারা আইসের সঙ্গেও জড়িত কি-না জানতে চাইলে ফজলুর রহমান বলেন, ইয়াবা ব্যবসায়ীরাই এই আইসের ব্যবসা শুরু করছে। এখনো বিস্তার বড়ভাবে না হলেও তারা বাজার পাওয়ার চেষ্টা করছে। বেশি দাম হওয়ায় এখনো সেভাবে কাস্টমার পায়নি তারা। সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ঢাকা মেট্রো উত্তরের উপ-পরিচালক মো. রাশেদুজ্জামান ও সহকারী পরিচালক মো. মেহেদী হাসান উপস্থিত ছিলেন।

তরুণ-তরুণীরাই বেশি মাদকাসক্ত : মাদকাসক্ত রোগীর মধ্যে ২১ থেকে ২৫ বছরের তরুণদের সংখ্যাই বেশি, ২৫.৮৯  শতাংশ। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) অ্যানুয়াল ড্রাগ রিপোর্ট-২০২০ বা বার্ষিক মাদকবিষয়ক সমীক্ষা প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

প্রতিবেদনের বলা হয়, কয়েক বছর ধরে ইয়াবা ও হেরোইন আসক্ত বেশি রোগী ভর্তি হচ্ছে মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে। ২০২০ সালে সবচেয়ে বেশি আসক্ত হয় হেরোইনে, ৩৪.১ শতাংশ। মাদকাসক্তদের মধ্যে বেশির ভাগই বেকার, যাদের কোনো আয় নেই; এই হার ৫৭.৮৭ শতাংশ। বেশি ক্ষতিকর মাদকে আসক্ত হয়ে যারা রোগী হয়েছে তাদের বেশির ভাগই অশিক্ষিত; এই হার ২৫.৩৮ শতাংশ।

রাজধানীর তেজগাঁওয়ে কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রসহ ডিএনসির চারটি সরকারি নিরাময়কেন্দ্র এবং ৩৭০টি বেসরকারি নিরাময়কেন্দ্রে ২০২০ সালে চিকিৎসা নেওয়া প্রায় ৩০ হাজার মাদকাসক্ত রোগীর ওপর এই সমীক্ষা চালানো হয়েছে। প্রতিবছর ২৬ জুন মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস উপলক্ষে আগের বছরের প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। এ বছর করোনার বিধি-নিষেধের কারণে সম্প্রতি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, সমীক্ষা প্রতিবেদনের বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করে মাদক নিয়ন্ত্রণের কার্যক্রম গ্রহণ করছেন তারা। সচেতনতা বাড়ানোর বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

এবিষয়ে ডিএনসির পরিচালক (নিরোধ শিক্ষা, গবেষণা ও প্রকাশনা) মুু নূরুজ্জামান শরীফ বলেন, মাদকে আসক্ত রোগীর হার ও ধরন সমীক্ষা করে সে অনুযায়ী আমরা ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ করেছি। সচেতনতার জন্য বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম চলছে। পিআর গ্রুপ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বয়স ও পেশাকেন্দ্রিক সচেতনতার কাজ করছি। পাশাপাশি আভিযানিক কাজও চলছে।’

জরিপে দেখা গেছে, গত বছরের মাদকাসক্ত রোগীদের মধ্যে ২১ থেকে ২৫ বছরের তরুণ ২৫.৮৯ শতাংশ। এর পরই ছিল ১৬ থেকে ২০ বছর বয়সীরা এবং ২৬ থেকে ৩০ বছরের যুবকরা। বয়সের দুই ধাপেই হার ১৭.২৬ শতাংশ। আগেও এ বয়সেই আসক্তের হার বেশি দেখা গেছে। ২১ থেকে ২৫ বছরের আসক্ত রোগী ২০১৯ সালে ছিল ১৬.৭২ শতাংশ; ২০১৮ সালে ২০.৭২ শতাংশ; ২০১৭ সালে ১৯.২৩ শতাংশ এবং ২০১৬ সালে ১৮.৯৭ শতাংশ। গত বছর ৩১ থেকে ৩৫ বছর পর্যন্ত আসক্ত রোগী ছিল ১৫.২৩ শতাংশ। গত বছর ১৫ বছরের নিচে শিশু ছিল ৪.৫৭ শতাংশ; ৩৬ থেকে ৪০ বছরের ৮.৬৩ শতাংশ; ৪১ থেকে ৪৫ বছরের ৩.৫ শতাংশ; ৪৬ থেকে ৫০ বছরের ৬.৯ শতাংশ এবং পঞ্চাশোর্ধ্ব ছিল ২.৩ শতাংশ।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads