• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪২৯

অপরাধ

চটকদার কথায় আস্থা অর্জনের চেষ্টা

এবার মোবাইল অ্যাপে সুদের কারবার চক্র

  • ইমরান আলী
  • প্রকাশিত ০৮ অক্টোবর ২০২১

ভার্চুয়াল মাধ্যমে ফেসবুক আইডি কিংবা ইনস্টাগ্রামে অ্যাকাউন্ট খুললেই ঋণ দেওয়ার প্রলোভন দেখানো হচ্ছে। টাকাওয়ালা, ক্যাশম্যান, এসম্যানেজার, ইনস্ট্যান্ট স্যালারি ডটকম, ক্যাশক্যাশসহ আরো বেশ কয়েকটি ভার্চুয়াল প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ দেওয়ার আগ্রহ প্রচার করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণে ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে নানা গ্রাফিক্যাল উপস্থাপনা। টাকার ছবি দিয়ে গ্রাফিক্স ছাড়াও অডিও-ভিজ্যুয়াল বিজ্ঞাপনও দিচ্ছেন অনেকে।

বিভিন্ন চটকদার কথায় মানুষের আস্থা অর্জনে সচেষ্ট এসব অ্যাপ ও আইডি। বলা হচ্ছে, কাগজবিহীন আবেদন করা যাবে। কোনো ক্রেডিট ইতিহাসের প্রয়োজন নেই। স্বল্প ও যথাসময়ে ঋণ পর্যালোচনা করার আশ্বাসও দেওয়া হচ্ছে। এমনকি ১০ মিনিটেও ঋণ পৌঁছানোর প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে কেউ কেউ।

গত বুধবার এ বিষয়ে হাইকোর্ট রিট করেন আলোচিত ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন। রিটের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত অবৈধ সুদকারবারিদের গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেয়।

এদিকে হাইকোর্টের নির্দেশনার একদিনের মধ্যে ডিজিটাল মাইক্রোফাইন্যান্সের নামে অবৈধ সুদের কারবারে জড়িত পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে ডিএমপির গোয়েন্দা সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ। গ্রেপ্তাররা হলেন-ইমানুয়েল এডওয়ার্ড গোমেজ, আরিফুজ্জামান, শাহিনুর আলম ওরফে রাজীব, শুভ গোমেজ ও মো. আকরাম। তাদের কাছ থেকে একটি এলিয়ন গাড়ি, নয়টি মোবাইল ফোন, নয়টি সিমকার্ড, চারটি ল্যাপটপ, চারটি বিভিন্ন ব্যাংকের চেকবই উদ্ধার করা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার এসব তথ্য জানান। তিনি জানান, সুদ কারবারের অ্যাপগুলোর মধ্যে রয়েছে-টাকাওয়ালা (পার্সোনাল লোনস অনলাইন), র্যাপিডক্যাশ, আমার ক্যাশ, ক্যাশক্যাশসহ আরো অনেক অ্যাপ। এসব অ্যাপ প্রায় ৫০ হাজার থেকে ৫০ লাখ মানুষ ডাউনলোড করেছে। সবাই ব্যবহার না করলেও বিশাল একটা অংশ এসব অ্যাপের মাধ্যমে প্রতারিত হচ্ছে।

হাফিজ আক্তার বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক-ইউটিউবে ক্ষুদ্র, জামানতবিহীন ঋণ ও চটকদার বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে বিভিন্ন লোভ দেখিয়ে অনৈতিকভাবে সুদের ব্যবসায় করত তারা। মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে তারা গ্রাহকদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ডাটা সংগ্রহে রাখত।

তিনি আরো বলেন, এ ব্যবসার মূলে রয়েছে কিছু চীনা নাগরিক। এদের ব্যবহূত অ্যাপ মূলত চীনের সার্ভার থেকে পরিচালিত হতো। ফলে কত টাকা কিংবা কতজন এ ব্যবসার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা আমরা এখনো জানতে পারিনি। এসব কাজ তারা মূলত দেশীয় এজেন্টদের মাধ্যমে করে থাকে।

তারা যদিও বলত তিন থেকে ২৫ হাজার টাকার মতো লোন নিতে পারবে কিন্তু তারা তিন হাজার থেকে বেশি লোন দিত না। প্রাথমিক পর্যায়ে তাদের ছোট অ্যামাউন্টের টাকা দিয়ে পয়েন্ট অর্জন করতে হতো। প্রতি সপ্তাহে তাদের বিভিন্ন অ্যামাউন্টের টাকা দেওয়া হতো এবং সাপ্তাহিকভাবেই তাদের সুদসহ টাকা পরিশোধ করতে হতো। তারা প্রথমেই নানা খরচ যেমন অ্যাপ্লিকেশন ফি, সার্ভিস চার্জ এসব দেখিয়ে টাকা কেটে রেখে বাকি টাকা দিত। কিন্তু গ্রাহককে পরিশোধ করতে হতো পুরো টাকাই। যেমন কোনো যদি গ্রাহক তিন হাজার টাকা নিতে চায় তাহলে সে পাবে ২১৫০ টাকা কিন্তু তাকে তিন হাজার টাকাই পরিশোধ করতে হতো।

কীভাবে গ্রাহক থেকে পরবর্তীতে টাকা উদ্ধার করে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তারা অ্যাপের মাধ্যমে গ্রাহকদের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নিয়ে থাকে। গ্রাহক জেনে না মোবাইলের বিভিন্ন সুবিধা যেমন লোকেশন, ক্যামেরা, ফাইলের অ্যাকসেস দিয়ে দেয় অ্যাপে। আর তার মাধ্যমে বিভিন্ন তথ্য নিয়ে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে তারা। এতে টাকা পরিশোধ করতে তারা বাধ্য হয়। এরা অ্যাপে স্থায়ী কোনো ঠিকানাও দেয় না।

মূলহোতাদের গ্রেপ্তারে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে? জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করছি। আর চীনের নাগরিক যারা আমাদের দেশে আছে তাদের আমরা ধরার চেষ্টা করব। আর এর সঙ্গে যদি আরো কেউ জড়িত থাকে তাদেরও আমরা গ্রেপ্তার করব।

ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার আরো বলেন, আমরা চাই না আমাদের দেশে কেউ অবৈধভাবে সুদের ব্যবসা করবে এবং এর মাধ্যমে কেউ প্রতারিত হবে। এরা মূলত গ্রামের মহাজনদের মতো সুদের ব্যবসা করে আসছে। মহাজনরা যেভাবে টাকা প্রদানের আগেই সুদের টাকা কেটে রাখতো। এরাও একই রকম কাজ করছে।

এদিকে গত বুধবার মাইক্রোক্রেডিটের (ক্ষুদ্রঋণ) নামে সারাদেশে অনিবন্ধিত সুদের ব্যবসা পরিচালনাকারী (সমবায় সমিতি ও এনজিওর) প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করার নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে আদালতের এ নির্দেশ বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে।

গত ২৭ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চ থেকে দেওয়া মৌখিক আদেশের পর বুধবার (৬ অক্টোবর) বিচারপতি আবু তাহের মো. সাইফুর রহমান ও বিচারপতি মো. জাকির হোসেনের লিখিত আদেশ প্রকাশ পায়। লিখিত আদেশের বিষয়টি নিশ্চিত করেন রিটকারী আইনজীবী ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন।

আইনজীবী সুমন বলেন, আমরা তিন পৃষ্ঠার লিখিত আদেশ হাতে পেয়েছি। দেশজুড়ে যেসব সুদকারবারি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সুদ নেওয়ার অনুমোদন নেই, তাদের বিরুদ্ধে মামলা করার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে এ নির্দেশ বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে।

এর আগে গত ২৭ সেপ্টেম্বর মাইক্রোক্রেডিটের (ক্ষুদ্রঋণ) নামে সারাদেশে অনিবন্ধিত সুদের ব্যবসা পরিচালনাকারী (সমবায় সমিতি ও এনজিওর) প্রতিষ্ঠানের তালিকা প্রণয়নের নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে তালিকা করতে গিয়ে ওই সব প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোনো অনিয়ম ধরা পড়লে ব্যবস্থা নিয়ে তাদের কার্যক্রমও বন্ধের নির্দেশ দেন আদালত।

সেইসঙ্গে অননুমোদিত আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ক্ষুদ্রঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমের বিষয়ে তদন্ত করতে একটি বিশেষ কমিটি গঠনের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতি নির্দেশনা দিয়েছেন হাইকোর্ট।

এ ছাড়া ঋণদানকারী স্থানীয় সুদকারবারিদের তালিকা দিতে মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আদালতের আদেশ প্রতিপালন করে আগামী ৪৫ দিনের মধ্যে এসব বিষয়ে অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল করতে সংশ্লিষ্টদের বলেছেন আদালত।

এ ছাড়া রুল জারি করেছে আদালত। রুলে লাইসেন্স এবং অনুমোদন ছাড়া ক্ষুদ্রঋণদানকারী বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ ও তদারকিতে বিবাদীদের নীরবতা কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়েছেন হাইকোর্ট। অর্থসচিব, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির এক্সিকিউটিভ ভাইস চেয়ারম্যান ও সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। এ বিষয়ে পরবর্তী শুনানি ও আদেশের জন্য আগামী ৩০ নভেম্বর দিন নির্ধারণ করেছে আদালত।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads