মিয়ানমার থেকে নাফ নদী, সেখান থেকে টেকনাফ। পরে কক্সবাজার হয়ে আসে রাজধানীতে। তারপর যায় সারা দেশে। এটাই ইয়াবার রুট। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নজরদারির কারণে ইয়াবার বড় চালানের রুট পাল্টে ফেলেছে কারবারিরা। বর্তমানে তারা প্রধান রুট হিসেবে ব্যবহার করছে দুর্গম পার্বত্য অঞ্চল। মিয়ামানমার থেকে বান্দরবান ও খাগড়াছড়ির দুর্গম অঞ্চল দিয়ে বড় চালান যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। গোয়েন্দা নজরদারি এড়াতে ব্যবহার করা হচ্ছে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোকনজনকে। এদের প্রতি পিস ইয়াবা বহনে দেওয়া হচ্ছে ১৫ টাকা।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অভিযানে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ১১ জনকে বিপুল পরিমাণ ইয়াবাসহ আটকের পর এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে। ইয়াবা কারবারিদের নানা প্রলোভনে পড়ে ক্ষৃদ্র নৃগোষ্ঠীর লোকজনের ইয়াবা কারবারে জড়িত হওয়ার ঘটনাকে বিপজ্জনক বলে আখ্যায়িত করছেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার আজিমুল হক বলেন, ইয়াবা কারবারিরা তাদের পরিচিত রুট পাল্টিয়েছে। কক্সবাজার হয়ে পার্বত্য এলাকা এরপর সেখান থেকে ইয়াবা নিয়ে কুমিল্লা হয়ে রাজধানীসহ সারা দেশে পৌঁছে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, কারবারিরা এখন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোকজনকে ইয়াবা বহনে ব্যবহার করছে। এটা খুবই আতঙ্কজনক। দেশে ইয়াবাসহ মাদক নিয়ন্ত্রণ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ অন্যান্য সংস্থার কঠিন হয়ে পড়বে।
তিনি বলেন, এটি খুবই আশ্চর্যজনক যে টাকার প্রলোভন দেখিয়ে এই গোষ্ঠীকে এ কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি এড়াতে তারা এ কৌশল বেছে নিয়েছে। তাদের নিকট থেকে পাওয়া তথ্যে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ নজরদারি আরো বাড়িয়েছে বলে জানান তিনি।
গোয়েন্দা পুলিশ জানায়, গত বুধবার গোপন সংবাদের ভিত্তিতে গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে। প্রথমে এ গোষ্ঠীর ৫ জনকে আটক করা হয়। এরপর তাদের দেওয়া তথ্যমতে দুই নারীসহ আরো ৬ জনকে আটক করা হয়। উদ্ধার করা হয় ১৫ হাজার ইয়াবা।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, গ্রেপ্তারদের জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর এ তথ্য বেরিয়ে আসে। প্রতি পিস ইয়াবা বহনে ১৫ টাকা করে দেওয়ার প্রস্তাবে তারা এসব ইয়াবা বান্দরবান থেকে ঢাকায় নিয়ে আসে। তাদের মতো আরো বেশ কিছু লোকজন এ কাজে জড়িয়ে পড়েছে বলেও ডিবির কাছে তথ্য দেয়।
গোয়েন্দা পুলিশ পুরো চক্রকে গ্রেপ্তার অভিযান অব্যাহত রেখেছে। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, এর আগেও বিক্ষিপ্তভাবে এই জনগোষ্ঠীর সদস্যদের অস্ত্র ও মাদকসহ গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। কিন্তু এবারের বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে। মনিতেই তারা লোকালয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারির বাইরে থাকে। কিন্তু তারা যে তথ্য দিয়েছে তা সত্যিই খুব উদ্বেগজনক।
তাদের এ জনগোষ্ঠীর মধ্যে যারা একটু প্রভাবশালী, টাকাপয়সা রয়েছে তারাও এ কারবারে রয়েছে। পার্বত্য অঞ্চলে গিয়ে অপরেশন চালানো কঠিন ব্যাপার। আবার যখন তারা লোকালয়ে আসে কনক্রিট ইনফরমেন ছাড়াও তল্লাশি চালানোও কঠিন।
তবে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, তারা যেন এ পথে না আসতে পারে এ কারণে তারা কাজ করছেন। পাশাপাশি আরো শক্তিশালী সোর্স নিয়োগ করে যারা এ কারবারের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে তাদের দ্রুত আইনের আওতায় আনতে হবে।
সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল ইসলাম বলেন, এই খবরটি আতঙ্কের। ক্ষুদ্র এ জনগোষ্ঠীর লোকজনকে আমরা কর্মঠ ও তাদের দ্বারা এ ধরনের অপরাধ সংগটিত হয় না বলেই জানি। মাদক কারবারিরা কৌশলে তাদের এ পথে এনেছে।
তিনি বলেন, এখন তারা বাহক, পরবর্তীতে তারা নিজেরাই ব্যবসায়ী হয়ে যাবে। বর্তমানে তারা দেখছে কোথায়, কীভাবে কার দ্বারা ইয়াবা আনতে হয়। একসময় যখন তারা এ বিষয়ে দক্ষ হয়ে যাবে তখন তারা নিজেরাই এ কাজে জড়িয়ে পড়বে।
তৌহিদুল ইসলাম বলেন, প্রাথমিক পর্যায়ে এদের নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে নয়তো একসময় সমাজ থেকে ইয়াবা নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে পড়বে। এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তাদের নজরদারি আরো বাড়াতে হবে।
গোয়েন্দা সংস্থার দেওয়া তথ্যমতে, ইয়াবা মিয়ানমার থেকে জলপথে নাফ নদী অতিক্রম করে। এরপর টেকনাফ থেকে কক্সবাজার হয়ে হয়ে ছড়িয়ে পড়ে রাজধানীসহ সারা দেশে। এ পথেই নজরদারি থাকে সকল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের। বিশেষ করে বিজিবি, র্যাব, কোস্টগার্ড এবং পুলিশ সার্বক্ষণিক নজরদারি করে থাকে। এ কারণে মাদক কারবারি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি এড়াতে এ রুট পরিবর্তন করে দুর্গম অঞ্চলের দিকে যাচ্ছে। বান্দরবান সীমান্ত দিয়ে ইয়াবার বড় চালান ঢুকছে।
গোয়েন্দা সংস্থার দেওয়া তথ্যমতে, টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে ইয়াবা আসা যে বন্ধ হয়েছে তা নয়। তবে কারবারিরা যে পথে ধরা পড়ার সম্ভাবনা কম থাকে সেই পথ দিয়ে এগুতে চায়।
এদিকে বিজিবির দেওয়া তথ্যমতে, গত অক্টোবর মাসে কক্সবাজার সীমান্ত এলাকায় ১২ লাখের বেশি ইয়াবা জব্দ করেছে। চলতি মাসে গত ২ নভেম্বর কক্সবাজারের রামুতে ৫০ হাজার এবং ৮ নভেম্বর ৭০ হাজার পিস ইয়াবা জব্দ করা হয়।