প্রতিবেশী এক নারীর সঙ্গে অন্তরঙ্গ অবস্থায় দেখে ফেলায় নিজ কন্যা সন্তান ফাহিমাকে হত্যা করেন কুমিল্লার দেবিদ্বারের ট্রাক্টরচালক আমির হোসেন। গত ৭ নভেম্বর মেয়েকে চকলেট কিনে দেওয়া ও ঘুরতে যাওয়ার কথা বলে নির্জন জায়গায় নিয়ে যান আমির। সেখানে হাত-পা বেঁধে ফাহিমাকে ছুরিকাঘাত করেন তার চাচাতো ভাই রেজাউল। আর গলা চেপে শ্বাসরোধে মৃত্যু নিশ্চিত করেন বাবা আমির হোসেন নিজেই।

শুধু তাই নয়, মৃত্যুর পর বাবা নিজেই মাইকিং করেন, বিভিন্ন স্থানে শ্বশুর-শাশুড়িসহ মেয়েকে খোঁজাখুঁজি করেন। এমনকি এই ঘটনায় থানায় মামলাও করেন আমির। তবে বস্তাবন্দি লাশ উদ্ধারের পর ব্যবহূত বস্তার সূত্র ধরে বাবা আমির হোসেনসহ মোট পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব।

বুধবার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে এসব তথ্য জানান র্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। আর হত্যার ঘটনায় জড়িত অভিযোগে বাবা আমির হোসেন, চাচাতো চাচা রবিউল আউয়াল ও রেজাউল ইসলাম ইমন, পরকীয়া সম্পর্কে জড়িত মোসাম্মত লাইলি আক্তার এবং সোহেল রানাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

র্যাবের দাবি, লাইলি আক্তার নামে এক নারীর সঙ্গে পরকীয়া সম্পর্ক ছিল আমির হোসেনের। গত ৫ নভেম্বর লাইলি ও আমির হোসেনকে শিশু ফাহিমা আপত্তিকর অবস্থায় দেখে ফেলে। এ ঘটনা মাকে বলে দেওয়ার কথা বললে লাইলি ও আমির উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। তাই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে আমিরকে চাপ দেয় লাইলি। তার প্ররোচনায় গত ৬ নভেম্বর ঘাতক আমির গ্রেপ্তারকৃত অন্য সহযোগীদের নিয়ে শিশু ফাহিমা আক্তারকে হত্যার পরিকল্পনা করেন এবং লাইলি আক্তারকে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের বিষয়টি জানান।

শিশু ফাহিমাকে হত্যা করলে পথ পরিষ্কার এবং তাদের অনৈতিক সম্পর্ক কেউ জানবে না এমন পরিকল্পনায় নিজ মেয়েকে হত্যা করা হয় জানিয়ে র্যাব মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, শিশু ফাহিমাকে হত্যার পর স্ত্রীকেও খুন কিংবা ডিভোর্স দিয়ে লাইলিকে নিয়ে সংসার শুরু করতে চেয়েছিলেন আমির।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তারকৃতরা জানিয়েছেন, ৭ নভেম্বর বিকালে কুমিল্লার দেবিদ্বারে ৫ বছরের শিশু ফাহিমা আক্তার নিখোঁজ হয়। শিশু ফাহিমার পিতা আমির দেবিদ্বার থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। নিখোঁজের পর আমির ৭ ও ৮ নভেম্বর আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় মাইকিং করেন এমনকি গত ৮ নভেম্বর ঝাড়ফুঁক দিয়ে মেয়েকে খোঁজার জন্য একজন ফকিরকেও খবর দেন।

পরে গত ১৪ নভেম্বর পুলিশ কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলার এলাহাবাদ ইউনিয়নের কাচিসাইর জনৈক নজরুল মাস্টারের বাড়ির সামনে কালভার্টের নিচে সরকারি খালের ডোবা থেকে শিশুটির বস্তাবন্দি মরদেহ উদ্ধার করা হয়। পরে ফাহিমার পরিচয় নিশ্চিত করে তার পরিবার। ওই ঘটনায় ঘাতক বাবা আমির হোসেন বাদী হয়ে দেবিদ্বার থানায় একটি মামলা দায়ের করেন।

নির্মম এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় র্যাব-১১ ছায়া তদন্ত শুরু করে এবং হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটন এবং জড়িত বাবাসহ ৫ আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে। র্যাব জানায়, পরিকল্পনা অনুযায়ী ৬ নভেম্বর রাতে রেজাউল ইসলাম ইমনের ফার্নিচার দোকানে পিতা আমির টাকার বিনিময়ে রবিউল আউয়াল, রেজাউল ইসলাম ইমন ও সোহেল রানাকে সঙ্গে নিয়ে ফাহিমাকে হত্যার জন্য পরিকল্পনা করে।

ধারালো ছুরি ও হত্যার পর লাশ লুকানোর জন্য দুইটি প্লাস্টিকের বস্তাও সংগ্রহ করেন তারা। এরপর ৭ নভেম্বর বিকালে চকলেট কিনে দেওয়া ও বেড়াতে যাওয়ার কথা বলে চাঁপানগর রাস্তার মোড়ে সোহেল রানার সিএনজিতে করে দেবিদ্বার পুরান বাজারের দক্ষিণে নদীর নির্জন স্থানে শিশু ফাহিমাকে নিয়ে যান।

এসময় লাইলির উপস্থিতিতে আমির তার মেয়ে ফাহিমার মুখে চেপে ধরে নিজেই মেয়েকে ছুরি দিয়ে আঘাত করেন। রবিউল ভিকটিমের পায়ে ছুরি দিয়ে আঘাত করেন। আর ইমন ছুরি দিয়ে পায়ে ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত করেন। সোহেল ছুরি দিয়ে ভিকটিমের পেছনে ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত করে ক্ষত-বিক্ষত করে দেন। পরে বাবা আমির নিজেই ফাহিমার গলায় চেপে শ্বাসরোধ করে মৃত্যু নিশ্চিত করেন। এরপর শিশু ফাহিমার মরদেহ বস্তায় ভরে সিএনজিতে করে ইমনের গরুর ঘরে ড্রামে লুকিয়ে রাখেন। ৯ নভেম্বর রাতে সোহেল রানার সিএনজিতে করে আমির হোসেন, রবিউল, ইমন বস্তাবন্দি ফাহিমার মরদেহ দেবিদ্বার উপজেলার এলাহাবাদ ইউনিয়নের কাচিসাইর কালভার্টের নিচে ডোবায় ফেলে দেন।

পরে নিখোঁজ কন্যা ফাহিমাকে খুঁজে পেতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কোম্পানীগঞ্জেও স্ত্রী ও শ্বশুর-শাশুড়িসহ খুঁজতে যায় আমির। ১৪ নভেম্বর বস্তাবন্দি মরদেহ উদ্ধারের পর ঘাতক নিজেই বাদী হয়ে দেবিদ্বার থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। এমনকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন পোস্ট করে, যাতে তাদের ওপর কারো সন্দেহ না হয়-উল্লেখ করেন র্যাব মুখপাত্র।

কিভাবে বাবাসহ হত্যাকারীদের শনাক্ত হলো জানতে চাইলে কমান্ডার মঈন বলেন, ‘শিশু ফাহিমাকে হত্যার পর গরুর খাবারের বস্তা দেখেন র্যাব সদস্যরা। এরপর ইমনকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে হত্যার মূল রহস্য। এরপর একে একে গ্রেপ্তার করা হয় বাবা আমির হোসেনসহ বাকি আসামিদের।’