• বৃহস্পতিবার, ২ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪২৯

অপরাধ

মিলেছে নতুন পাঁচ মাদক

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ৩০ ডিসেম্বর ২০২১

ইয়াবার বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী শক্ত অবস্থান নেওয়ায় নিত্যনতুন মাদকে ঝুঁকছে মাদক কারবারিরা। গত এক বছরে দেশের বাজারে সন্ধান মিলেছে নতুন ৫ ধরনের মাদক। এগুলো হলো-এলএসডির, ক্রিস্টাল মেথ বা আইস বা মেথামফেটামিন, ম্যাজিক মাশরুম, ইয়াবার বিকল্প ‘ট্যাপেনটাডোল’ নামের ক্যানসারের ওষুধ ও ইস্কাফ সিরাপ। এই পাচটি মাদকই বেশ ব্যয়বহুল। এখন পর্যন্ত যারা এসব মাদক নিয়ে গ্রেপ্তার হয়েছেন, তাদের অধিকাংশই সচ্ছল পরিবারের বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী।

জানা যায়, নিত্যনতুন মাদকের প্রতি বেশি আগ্রহ থাকে মাদকসেবীদের। এজন্য নতুন নতুন মাদক আনার চেষ্টা করে মাদকচক্রগুলো। সীমান্ত এলাকাসহ বিভিন্ন জেলা দিয়ে এসব মাদক দেশে প্রবেশ করছে। একারণে পুলিশ, ডিবি, র্যাব, বিজিবি ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের বিভিন্ন অভিযানে বিপুল পরিমাণ নতুন নতুন মাদক জব্দ করছে।

সূত্র বলছে, সাম্প্রতিক সময় উদ্ধার হওয়া বেশিরভাগ মাদকই ব্যয়বহুল। সাধারণ ঘরের মানুষের পক্ষে এটি সেবন করা সম্ভব নয়। উচ্চবিত্ত ঘরের সন্তানরা এসব মাদক বেশি সেবন করে। সর্বশেষ তিন বছরে উদ্ধার হওয়া পশ্চিমা মাদকের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বিদেশফেরৎ বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করে। যারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।

গ্রেপ্তারের পর তারা জানিয়েছে, মূলত বিদেশে পড়তে গিয়েই তারা এসব মাদকের সন্ধান পান। সেবনের পর নতুন অনুভূতি পাওয়ায় দেশে আসার সময় কেউ কেউ সঙ্গে করে নিয়ে আসেন। পরে দেশের বন্ধুদের মাঝে ছড়িয়ে দেন। সঙ্গে আনা মাদক শেষ হওয়ার পর বিদেশি বন্ধুদের সাহায্যে আর্ন্তজাতিক কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে ও পরিচিত বিদেশফেরতদের মাধ্যমে ফের নিয়ে আসতেন। অনেক শিক্ষার্থী সেবন করতে গিয়ে বিক্রির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে।

২০১৮ সালে সরকার ইয়াবা ও মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এতে টান পড়ে সরবরাহে। কিন্তু এরপরও বাজারে দেখা যাচ্ছে নতুন মাদকের দৌরাত্ম্য। মাদককারবারি চক্র এখন লেনদেনও করছে মোবাইল ব্যাংকিং ও অনলাইনে।

একাধিক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেছেন, চতুর মাদককারবারিরা এক রুটে বেশিদিন মাদক পাচার করেন না। ব্যাপক চাহিদার কারণে অনেক দেশের কারবারিরা বাংলাদেশকে রুট হিসাবেও ব্যবহার করেন। এবছর ডিএমপির অভিযানে উদ্ধার করা নতুন মাদকের মধ্যে এলএসডি জব্দ হয়েছে ৫ গ্রাম ১২ মিলিগ্রাম ও ৪০ পিস, আইস জব্দ হয়েছে ২ কেজি ৬৯০ গ্রাম, ডায়েমেথিল ট্রাইপ্টেমিন বা ডিএমটি জব্দ হয়েছে ১ গ্রাম ৩ মিলিগ্রাম, ট্যাপেনটাডোল ট্যাবলেট জব্দ হয়েছে ৯ হাজার ২৯০ পিস, ইস্কাফ সিরাপ জব্দ হয়েছে ১৭৯ বোতল।

এছাড়া র্যাবের অভিযানে উদ্ধার এলএসডি জব্দ হয়েছে ৪১ স্লট, আইস ১৩ কেজি ৪৯৪ গ্রাম, ডায়েমেথিল ট্রাইপ্টেমিন বা ডিএমটি ৬০০ মিলিগ্রাম ও ম্যাজিক মাশরুম ৫টি বারে ১২০টি স্লাইস, যার পরিমাণ ২ হাজার ৫০০ মিলিগ্রাম। আর বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) অভিযানে উদ্ধার নতুন মাদকের মধ্যে আইস জব্দ হয়েছে ৭ কেজি ১০০ গ্রাম ও ইস্কাফ সিরাপ জব্দ করা হয় ৫৬ হাজার ৭৫১ বোতল।

এলএসডির হ্যালুসিনেশন তৈরি করার প্রবণতা থেকে অনেক মানুষই এই মাদকসেবন শুরু করে। ১৯৬৮ সালে বিশ্বব্যাপী এলএসডি নিষিদ্ধ করা হয়। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে রিক্রিয়েশনাল ড্রাগ হিসেবে এলএসডির ব্যবহার হয়।

দেশে প্রথমবারের মতো ২৬ জুন বিশেষ অভিযান চালিয়ে রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার লাভ রোড এলাকা থেকে ডায়েমেথিল ট্রাইপ্টেমিন বা ডিএমটিসহ চার যুবককে গ্রেপ্তার করে র্যাব। এসময় তাদের কাছ থেকে ৬০০ মিলিগ্রাম ডিএমটি জব্দ করা হয়।

র্যাব-২-এর অধিনায়ক (সিও) লেফটেন্যান্ট কর্নেল খন্দকার সাইফুল আলম বলেন, বিদেশে পড়ালেখা করার সময় সেখানে থাকতে সমভ্রান্ত পরিবারের সন্তানরা ভয়ঙ্কর সব নতুন মাদকের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। পড়াশোনা শেষে দেশে ফিরলেও আসক্তি থেকে পোস্টাল সার্ভিসের মাধ্যমে দেশে আমদানি করছে এলএসডি ও ডিএমটি।

নতুন মাদক ডিএমটি চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় যার নাম ডায়েমেথিল ট্রাইপ্টেমিন। এটি একটি হ্যালুসিনোজেনিক ট্রিপটামাইন ড্রাগ। এটি সেবনের পর ৩০ থেকে ৪০ মিনিট গভীর হ্যালুসিনেশন তৈরি করে। এ থেকে মারাত্মক দুর্ঘটনা হতে পারে, এমনকী জীবননাশও হতে পারে।

সীমান্তরক্ষীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে ইয়াবার মতো মিয়ানমার থেকে ভয়াবহ মাদক আইস (ক্রিস্টাল মেথ) বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। এটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল। পাঁচ গ্রাম আইসের বাজারমূল্য প্রায় লাখ টাকা। ২০২১ সালে আইসের সবচেয়ে বড় চালান ধরা পড়ে গত ১৬ অক্টোবর। ইয়াবার চেয়ে প্রায় ৫০ গুণ বেশি ক্ষতিকর ক্রিস্টাল মেথ বা আইস।

র্যাব জানায়, পার্শ্ববর্তী মিয়ানমার থেকে টেকনাফ ও সেন্টমার্টিনের মধ্যবর্তী নৌপথ দিয়ে দেশে আসছে আইস। কখনো আচার, কখনো কাপড়ের প্যাকেট আবার কখনো চায়ের ফ্লেভারের প্যাকেটে।

গত ৬ জুলাই দেশে প্রথমবারের মতো উদ্ধার করা হয় নতুন মাদক ‘ম্যাজিক মাশরুম’। র্যাব সদরদপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-১০-এর একটি বিশেষ দল রাজধানীর হাতিরঝিল এলাকা থেকে মাদকচক্রের দুজনকে গ্রেপ্তার করে। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় ম্যাজিক মাশরুমের পাঁচটি বারে ১২০টি স্লাইস।

র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ম্যাজিক মাশরুম যদি কেউ ৫ থেকে ১০ মিলিগ্রাম সেবন করে তাহলে হ্যালুসিনেশন শুরু হয় এবং এর প্রতিক্রিয়া থাকে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত। এছাড়া এই মাদকসেবীরা জীবজন্তুর সঙ্গেও কথা বলা শুরু করে। কখনো কখনো অক্সিজেনের জন্য গাছ জড়িয়ে ধরার মতো কাণ্ডও ঘটায়। এ মাদক মূলত উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবারের তরুণরা সেবন করে।

এসব নতুন নেশাদ্রব্যের দিকে ঝুঁকছে উঠতি বয়সী মাদকসেবীরাও। নেশার জন্য তারা প্রচলিত গাঁজা-ফেনসিডিল-ইয়াবার মতো মাদকের পাশাপাশি মারাত্মক ঝুঁকির ওষুধও সেবন করছে। মাদকসেবীদের মধ্যে ক্যানসারের ওষুধ ‘অক্সিমরফোন’ ব্যবহারের তথ্য আগেই মিলেছিল। এবার মাদক হিসেবে তাদের নতুন আরেকটি ওষুধ সেবনের খবর মিলেছে। ইয়াবার বিকল্প হিসেবে ‘ট্যাপেনটাডোল’ নামক ওষুধটি সেবন করছে মাদকাসক্তরা।

গোয়েন্দা পুলিশ জানায়, বছরের শেষে সম্প্রতি রাজধানীর বংশাল থানা এলাকা থেকে বিপুল পরিমাণ নিষিদ্ধঘোষিত ‘ট্যাপেনটাডোল’ ট্যাবলেটসহ একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গোয়েন্দা পুলিশের লালবাগ বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) মো. সাইফুর রহমান আজাদ বলেন, ইয়াবার বিকল্প হিসেবে উঠতি বয়সী তরুণরা এই ভয়ঙ্কর মাদক সেবন করছে, যা মূলত ক্যানসারের রোগীদের ব্যথার জন্য ব্যবহূত হয়। ওষুধটি বিক্রি নিষিদ্ধ হলেও রাজধানীতে কারা বিক্রি করছে আর এর ক্রেতা কারা, এসব তথ্য যাচাই-বাছাই চলছে।

ট্যাপেনটাডোল ওষুধটির বিষয়ে জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও হেলথ অ্যান্ড হোপ স্পেশালাইজড হাসপাতালের পরিচালক ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘ট্যাপেনটাডোল’ ট্যাবলেটটি তীব্র ব্যথানাশক ওষুধ। এটি সেবনে ঝিমুনি ভাব, ঘুম ঘুম ভাব আসতে পারে। ক্যানসার অথবা যে ব্যথাগুলো অনিরাময়যোগ্য, সেসব ক্ষেত্রে বেদনানাশক হিসেবে এটি ব্যবহার করা হয়। এটি নেশা হিসেবে কোনোমতেই ব্যবহার করা উচিত নয়।

 দেশে প্রথমবারের মতো ইস্কাফ জব্দ করা হয় ২৫ জুন। ফেনসিডিলজাতীয় ভারতীয় মাদক এটি। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সীমান্ত দিয়ে দেশে ঢোকে এই মাদক। ‘ইস্কাফ’র চালান ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে রাজধানীতে নিয়ে আসার সময় খিলগাঁওয়ের নাগদারপাড়ায় মাদকচক্রের চার সদস্যকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) তেজগাঁও বিভাগের অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও মাদক নিয়ন্ত্রণ টিম। এ সময় তাদের কাছ থেকে ১৮৪ বোতল ইস্কাফ জব্দ করা হয়।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, গোয়েন্দা পুলিশ শুরু থেকেই মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে আসছে। ব্যাপক অভিযানের ফলে এ বছর এসব মাদক জব্দ করা হয়। সঙ্গে গ্রেপ্তার করা হয় কারবারিদের।

গোয়েন্দা পুলিশ উত্তরের যুগ্ম-কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ জানান, মাদক ব্যবসায়ীরা নিজেদের আড়াল করতে ব্যবসার ধরনে পরিবর্তন আনছে। তারই অংশ হিসেবে সবজি বিক্রেতা সেজে পিকআপে মাদক পরিবহন করছিল এই চক্রটি। ফেনসিডিলজাতীয় সিরাপ ‘ইস্কাফ’ দেশে প্রথমবারের মতো জব্দ করা হয়।

র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতিতে আমরা কঠোর নজরদারি ও অভিযান অব্যাহত রাখছি। অনলাইনে বা নতুন কৌশলে যেভাবেই কারবার হোক না কেন, আমরা সেদিকে গোয়েন্দা নজরদারি করছি। এ কারণে এলএসডিসহ নতুন আনা মাদকগুলোও ধরা পড়ছে। আমরা নতুন প্রযুক্তি ও কৌশলে মাদকবিরোধী অভিযান চালিয়ে যাবো।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads