• সোমবার, ৬ মে ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪২৯

অপরাধ

কৌশল পাল্টেছে প্রশ্ন ফাঁসকারীচক্র

  • ইমরান আলী
  • প্রকাশিত ২৩ জানুয়ারি ২০২২

কৌশল পাল্টেছে বিভিন্ন চাকরি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসকারীচক্র। আগে প্রশ্নপত্র ফাঁস করে পরবর্তীতে পরীক্ষার্থীদের কাছে দেওয়া হতো। এখন পরীক্ষা শুরু হওয়ার দুই তিন মিনিটের মধ্যে নির্ধারিত ব্যক্তির মাধ্যমে প্রশ্নপত্রের ছবি তুলে চক্রের কছে দেয়। এরপর ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে সেই প্রশ্নের উত্তর চুক্তি করা পরীক্ষার্থীর কাছে পাঠানো হয়।

গত শুক্রবার বিকেলে অনুষ্ঠিত প্রতিরক্ষা মহাহিসাব নিরীক্ষকের কার্যালয়ে অডিটর নিয়োগ পরীক্ষার এ ধরনের প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটেছে। পরীক্ষার কেন্দ্র থেকে ডিভাইসের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র বাইরে পাঠানো হয়েছিল। বাইরে থেকে ফাঁস হওয়া প্রশ্নের উত্তর আবার পাঠানো হয় পরীক্ষা কেন্দ্রে নির্ধারিত পরীক্ষার্থীর কাছে। এই জালিয়াতির ঘটনায় জড়িত চক্রের সাত সদস্য ও তিন পরীক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করেছে ডিএমপির গোয়েন্দা গুলশান বিভাগের একটি দল। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন-নোমান সিদ্দিকী, মাহমুদুল হাসান আজাদ, আল আমিন রনি, নাহিদ হাসান, শহীদ উল্লাহ, তানজির আহমেদ, মাহবুবা নাসরীন রুপা, রাজু আহমেদ, হাসিবুল হাসান ও রাকিবুল হাসান।

গ্রেপ্তারদের কাছ থেকে ইয়ার ডিভাইস ছয়টি, মাস্টার কার্ড মোবাইল সিম হোল্ডার ছয়টি, ব্যাংকের চেক পাঁচটি, নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প সাতটি, স্মার্ট ফোন ১০টি, বাটন মোবাইল ছয়টি, প্রবেশপত্র ১৮টি ও চলমান পরীক্ষার ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রের তিনটি সেট জব্দ করা হয়। গতকাল শনিবার দুপুরে রাজধানীর ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) এ কে এম হাফিজ আক্তার।

তিনি বলেন, প্রতিরক্ষা মহাহিসাব নিরীক্ষকের কার্যালয়ের অধীন ডিফেন্স ফাইন্যান্স ডিপার্টমেন্টের ৫৫০টি অডিটর পদে নিয়োগের জন্য গত শুক্রবার বিকেল ৩টা থেকে বিকেল সোয়া ৪টা পর্যন্ত ৭০ নাম্বারের এমসিকিউ পরীক্ষা ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন অঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হলগুলোতে অনুষ্ঠিত হয়। এ পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে এনএসআই আগে থেকে অসাধু কার্যক্রম ও জালিয়াতি কার্যক্রমের বিরুদ্ধে গোয়েন্দা নজরদারি অব্যাহত রাখে।

গোয়েন্দা কার্যক্রমের একটি অসাধুচক্রের নিয়োগ পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া ও জালিয়াতির মাধ্যমে প্রশ্নপত্র ফাঁসের তথ্য পায় এনএসআই ও গুলশান গোয়েন্দা বিভাগ। দুপুর ১২টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত চারটি টিম রাজধানীর মিরপুর, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল ও কাকরাইলসহ বিভিন্ন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে।

গোয়েন্দা গুলশান বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মশিউর রহমানের নেতৃত্বে অভিযানে কাকরাইলে অবস্থিত নিউ শাহিন হোটেল থেকে অসাধু উপায়ে অবলম্বনকারী দুই পরীক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের দেওয়া তথ্য মতে কাফরুল থানাধীন সেনপাড়া পর্বতা এলাকার একটি অ্যাপার্টমেন্ট থেকে ডিভাইস, প্রশ্নপত্র এবং উত্তরপত্রের খসড়াসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। ডিবি পুলিশের অপর দল বিজিপ্রেস উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে অভিযান চালিয়ে পরীক্ষার্থী এবং অন্যতম পরিকল্পনাকারী মাহবুবা নাসরীন রুপাকে টাকা, ডিজিটাল ডিভাইসসহ গ্রেপ্তার করে। পরবর্তীতে তার দেওয়া তথ্য মতে অপর আসামিদের গ্রেপ্তার করা হয়।

হাফিজ আক্তার বলেন, গ্রেপ্তারদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে জানা গেছে চক্রটির একটি গ্রুপ পরীক্ষার আগে থেকে পরীক্ষার্থী সংগ্রহ ও অর্থ হাতিয়ে নেয়। নগদ, রকেট ও বিকাশসহ মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস ও চাকরি পাইয়ে দিতে অর্থ লেনদেন হয়। টার্গেট পরীক্ষার্থী প্রতি ১৪ থেকে ১৬ লাখ টাকার লিখিত চুক্তি হয়। যেহেতু এমসিকিউ পরীক্ষা, তাই এমসিকিউ পরীক্ষায় পাস করার পরই ভাইভা। তাই এমসিকিউ পরীক্ষার আগে কিছু টাকা নিয়ে নেয় চক্রের সদস্যরা। নিয়োগ পাওয়ার পর বাকি টাকা দেওয়ার চুক্তি হয়।

প্রশ্ন ফাঁস ও জালিয়াতি সম্পর্কে হাফিজ আক্তার বলেন, চক্রের আরেকটি গ্রুপ ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস, ইয়ার ডিভাইস, মাস্টার কার্ড, মোবাইল সিম হোল্ডার ও বাটন মোবাইল টার্গেট পরীক্ষার্থীদের মধ্যে সরবরাহ করে। পরীক্ষা শুরুর দুই/তিন মিনিটের মধ্যেই প্রশ্ন ফাঁস করে বাইরে পাঠানো হয় ডিভাইসের মাধ্যমে। বাইরে থেকে প্রশ্নপত্রের সমাধান করে ডিভাইসের মাধ্যমে ফের পাঠানো হয় পরীক্ষার্থীদের কাছে।

হাফিজ আক্তার বলেন, গ্রেপ্তারদের মধ্যে মাহমুদুল হাসান আজাদ হিসাব মহানিয়ন্ত্রকের কার্যালয় (সিজিএ) অডিটর। মাহবুবা নাসরীন রুপা বগুড়ার দুপচাঁচিয়া উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান।

গ্রেপ্তারদের মধ্যে প্রতিরক্ষা মহাহিসাব নিরীক্ষকের কার্যালয়ে অডিটর মাহমুদুল হাসান আজাদ প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় ২০১৯ সালে বরখাস্ত হয়েছেন। নাহিদ হাসান, আল আমিন সিদ্দিকী ইতোপূর্বেও প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় ২০১৩, ২০১৬ এবং ২০১৯ সালে গ্রেপ্তার হয়েছিল। গ্রেপ্তার আসামিরা অন্য আসামিদের যোগসাজশে বিভিন্ন সোশ্যাল অ্যাপস ও ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করে পরীক্ষার হল থেকে প্রশ্ন ফাঁস করে দেওয়া, বাইরের রুমে ওয়ানস্টপ সমাধান কেন্দ্র বসিয়ে স্মার্ট ওয়াচ, এয়ার ডিভাইস, মোবাইল এসএমএসের মাধ্যমে উত্তর সরবরাহ করার কাজ করেছে।

ইতোপূর্বে গ্রেপ্তাররা বিভিন্ন ব্যাংক, অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন অধিদপ্তর, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর, কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ, সিটি করপোরেশন, বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন হিসাব নিরীক্ষক কার্যালয়, জ্বালানি অধিদপ্তর, সমবায় অধিদপ্তর, খাদ্য অধিদপ্তর, সাধারণ বীমা করপোরেশনসহ অন্যান্য সংস্থার প্রশ্নপত্র ফাঁস এবং উত্তরপত্র সরবরাহ করে বিপুল পরিমাণ টাকা বিভিন্ন ব্যাংক এবং বিকাশের মাধ্যমে ও নগদে হাতিয়ে নিয়েছে।

পরীক্ষা বাতিল হবে কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে হাফিজ আক্তার বলেন, কোনো সংস্থাই চায় না পরীক্ষা বিতর্কিত হোক। পরীক্ষা বাতিল হবে কি-না তা সংশ্লিষ্ট দপ্তরই সিদ্ধান্ত নেবে।

বগুড়ার দুপচাঁচিয়া উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মাহবুবা নাসরীন রুপার ভূমিকা সম্পর্কে তিনি বলেন, তার ভূমিকা ছিল মিডিয়ার কাজ করা। একটি গ্রুপ অর্থ সংগ্রহ করেছে। আরেকটি গ্রুপ ডিভাইস সরবরাহ করেছে। মাহবুবা নাসরীন রুপা নিজে পরীক্ষা দিয়েছে সঙ্গে অন্য পরীক্ষার্থীদের কাছে ডিভাইস সরবরাহের কাজ করেছে। গ্রেপ্তারদের মধ্যে চক্রের শিক্ষার্থী তিনজন, চক্রের সদস্য সাতজন। ১৮ শিক্ষার্থীর সঙ্গে তাদের চুক্তি হয়েছিল। এর মধ্যে এখন পর্যন্ত তদন্তে ৯ শিক্ষার্থীর মধ্যে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রের উত্তর সরবরাহের তথ্য মিলেছে। এ চক্রের সঙ্গে আরো যারা জড়িত রয়েছে, তাদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads