• রবিবার, ৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪২৯

অপরাধ

ভেঙে গেছে সব ধরনের জঙ্গি নেটওয়ার্ক

  • ইমরান আলী
  • প্রকাশিত ২৫ জানুয়ারি ২০২২

দেশে মাথাচাড়া দিয়ে উঠা জঙ্গিবাদ দমনে গত দেড় বছরে বড় সাফল্য এসেছে পুলিশে। পুলিশ, র্যাব, সিটিটিসি ও এটিইউয়ের অভিযানে জঙ্গিদের নেটওয়ার্ক ভেঙে দিয়ে জঙ্গিবাদকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয়েছে। এ সময়ে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে চার শতাধিক। বাংলাদেশ পুলিশের এই সাফল্য আন্তর্জাতিকভাবেও স্বীকৃত হয়েছে। পাশাপাশি দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ পুলিশ।

হলি আর্টিজানে হামলার পর জঙ্গিবাদ নির্মূলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) গঠন করে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট-সিটিটিসি নামে এ বিশেষায়িত পুলিশ ইউনিট। এরপর থেকে শুধু ঢাকায় নয়, ঢাকার বাইরেও বিভিন্ন জেলায় জঙ্গি আস্তানাসহ বিভিন্ন অভিযান চালিয়ে আসছে সিটিটিসি। পাশাপাশি উগ্রবাদ ও সন্ত্রাস প্রতিরোধে গঠিত পুলিশের এন্টি টেরোরিজম ইউনিটও (এটিইউ) জঙ্গিদের আইনের আওতায় আনতে কাজ করে যাচ্ছে।

অন্যদিকে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব) জঙ্গিদের শুধু আইনের আওতায়ই আনছে তা নয়, তারা জঙ্গিদের পুনর্বাসনে ডি-রেডিক্যালাইজেশনেরও কাজ করছে। পুলিশ সদরদপ্তরের পরিসংখ্যান বলছে, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের আগস্ট পর্যন্ত দেড় বছরে ৩১৭ ব্যক্তিকে জঙ্গিবাদে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিটগুলো, যেমন সিআইডি ও পিবিআইয়ের পাশাপাশি জেলা ও মেট্রো ইউনিটগুলো মামলা নিষ্পত্তিতে মুনশিয়ানা দেখিয়েছে। এসব মামলার তদন্ত বাংলাদেশ পুলিশ সক্ষমতা ও দক্ষতা উন্নয়নের পরিচয় দিয়েছে।

র‍্যাব সদর দপ্তর সূত্রে জানা যায়, গেল বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে ২৭৩ জঙ্গিকে গ্রেপ্তার, নয় জঙ্গি ‘আত্মসমর্পণ’ এবং বিপুল পরিমাণ দেশি-বিদেশি অস্ত্র, গোলাবারুদ, বিভিন্ন ধরনের উগ্রবাদী বই ও লিফলেট উদ্ধার করে র‍্যাব। র‍্যাব সদরদপ্তরের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে র‍্যাব জঙ্গিবাদবিরোধী অভিযান পরিচালনা করে আসছে। এখন পর্যন্ত পূর্ববর্তী ধারা সমুন্নত রেখে র‍্যাব বহুমুখী কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে জঙ্গিবাদ দমন অব্যাহত রেখেছে। শুধুমাত্র অভিযান নয়, জঙ্গিবাদবিরোধী জনমত গড়তে এবং জনসম্পৃক্ততা অর্জনে র‍্যাব ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছে। অন্যদিকে, গ্রেপ্তারের পাশাপাশি জঙ্গিদের অর্থের উৎস এবং অস্ত্র ও বিস্ফোরকপ্রাপ্তি বন্ধে র‍্যাবের কার্যক্রমও চলমান রয়েছে।

এছাড়া র‍্যাব জঙ্গি আত্মসমর্পণে বিশেষ উদ্যোগ ‘র‍্যাব ডি-র‍্যাডিকালাইজেশন ও রিহ্যাবিলিটেশন’ কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। ২০১৬ সালে হলি আর্টিজান হামলার মাধ্যমে পুনরায় জঙ্গিরা তাদের সংগঠনের অস্তিত্বের জানান দেয়। হলি আর্টিজান ঘটনা-পরবর্তী র‍্যাব জঙ্গিদের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের গ্রেপ্তারে সক্রিয় হয়। জঙ্গি সংগঠনের আমিরসহ গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে সাফল্যও পায়।

র‍্যাবের অভিযানে কেন্দ্রীয় দাওয়াতি শাখাপ্রধান, শুরা ও শরিয়া বোর্ড সদস্য, মহিলা শাখার নেতৃবৃন্দ এবং বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) বিশেষজ্ঞ গ্রেপ্তার হয়। এর মাধ্যমে জঙ্গি সংগঠনকে দুর্বল করে দেয় বলে জানান র‍্যাব কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

হলি আর্টিজান হামলার পর র‍্যাবের তৎপরতায় ১৫৫৮ জঙ্গি আটক হয়। এর মধ্যে ৮৩১ জন জেএমবি সদস্য। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের দুই হাজার ৬৮৫ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব। এর মধ্যে জেএমবি সদস্য ছিলেন ১৩৯৬ জন।

র‍্যাব সদরদপ্তর জানায়, ২০২১ সালে অভিযান চালিয়ে বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের ২৮৫ সদস্যকে গ্রেপ্তার  করে র‍্যাব। এর মধ্যে জেএমবি সদস্য ছিলেন ৮২ জন। উদ্ধার করা হয় দেশি-বিদেশি অস্ত্র, গোলাবারুদ ও বিভিন্ন ধরনের উগ্রবাদী বই ও লিফলেট।

গেল বছরের ১৫ জুলাই র‍্যাব সদরদপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র‍্যাব-৪ এর অভিযানে রাজধানী ঢাকার শাহ আলী থানাধীন বেড়িবাঁধ সংলগ্ন এলাকা থেকে আনসার-আল ইসলামের আধ্যাত্মিক নেতা মাহমুদ হাসান গুনবী ওরফে হাসান ওরফে গুনবীকে (৩৬) গ্রেপ্তার  করা হয়।

গত ৪ সেপ্টেম্বর সদরদপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র‍্যাব-১৪ এর অভিযানে ডাকাতির প্রস্তুতিকালে জেএমবির সক্রিয় সদস্য জুলহাস উদ্দিন ওরফে কাদেরী ওরফে মেহেদী (৩৪), মোহাম্মদ রোবায়েদ আলম ওরফে ধ্রুব (৩৩), আলাল ওরফে ইসহাক (৪৮) ও আবু আইয়ুব ওরফে খালিদ (৩৬) ময়মনসিংহের খাগডহর এলাকা থেকে গ্রেপ্তার  হন। গত ৯ সেপ্টেম্বর র‍্যাব সদরদপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র‍্যাব-২ এর অভিযানে রাজধানীর বসিলা থেকে জেএমবির একটি চক্রের কর্ণধার এমদাদুল হক ওরফে উজ্জ্বল মাস্টারকে (৫৫) গ্রেপ্তার  করা হয়। অভিযানে জব্দ করা হয় অস্ত্র, গুলি, নগদ অর্থ, রাসায়নিক দ্রব্য ও অভিনব পদ্ধতিতে তৈরি করা বুলেট প্রুফ জ্যাকেট।

গত ৪ ডিসেম্বর র‍্যাব সদরদপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র‍্যাব-১৩ এর অভিযানে নীলফামারী সদরের মাঝাপাড়া থেকে জেএমবির নীলফামারী ও রংপুর অঞ্চলের সামরিক শাখার প্রধান আহিদুল ইসলাম ওরফে আহিদ ওরফে পলাশ (২৬) এবং তার অন্যতম সহযোগী ওয়াহেদ আলী ওরফে আব্দুর রহমান (৩০), আব্দুল্লাহ আল মামুন ওরফে ডা. সুজা (২৬), জাহিদুল ইসলাম জোবায়ের (২৭) ও নূর আমিন ওরফে সবুজ (২৮) গ্রেপ্তার  হন। অভিযানে বোমা তৈরির সরঞ্জাম, বোমা তৈরিতে ব্যবহূত রাসায়নিক দ্রব্য, পিস্তল, ম্যাগাজিন ও গুলি উদ্ধার করা হয়।

এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পরামর্শে র‍্যাবই প্রথম জঙ্গিদের আত্মসমর্পণের উদ্যোগ নেয়। শুরু হয় বিপথগামী জঙ্গি সদস্যদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে তৎপরতা। র‍্যাব ডি-র‍্যাডিকালাইজেশন ও রিহ্যাবিলিটেশন কাউন্সিল (আরডিআরসি) সংগঠনের মাধ্যমে জঙ্গিদের সমাজের মূল স্রোতধারায় ফিরিয়ে আনতে চায়। র‍্যাবের আহ্বানে সাড়া দিয়ে বগুড়া, রংপুর, কুষ্টিয়াতে আত্মসমর্পণ করে সাত বিপথগামী তরুণ।

২০২১ সালের ১৪ জানুয়ারি ‘নবদিগন্তের পথে’ অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে ছয় জেএমবি ও তিন আনসার-আল ইসলামের সদস্যসহ মোট নয় জঙ্গি ‘বিনা শর্তে’ আত্মসমর্পণ করে। পুনর্বাসনের জন্য তাদের প্রত্যেককে র‍্যাবের নিজস্ব তহবিল থেকে পাঁচ লাখ টাকা করে আর্থিক অনুদানের পাশাপাশি ট্রাক্টর, গরুর খামার, বাইসাইকেল ইত্যাদি সহায়তা দেওয়া হয়।

সিটিটিসির অভিযানে ১০০ জঙ্গি গ্রেপ্তার  : উগ্র ও জঙ্গিবাদে সম্পৃক্ততার অভিযোগে ২০২১ সালে ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের অভিযানে ১০০ জনকে গ্রেপ্তার  করা হয়। তাদের মধ্যে আনসার-আল ইসলামের ৫০ জন, নব্য জেএমবির ১৫ জন, হরকাতুল জিহাদ আল-ইসলামী বাংলাদেশের চারজন, আল্লাহর দলের একজন, হিযবুত তাহরীরের ১১ জন, জেএমবির ছয়জনসহ সন্দিগ্ধ ও অন্য জঙ্গি সংগঠনে সম্পৃক্ততার অভিযোগে ১৩ জন গ্রেপ্তার  হন।

এ বিষয়ে সিটিটিসির ইন্টেলিজেন্স অ্যানালাইসিস বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মিশুক চাকমা বলেন, জঙ্গিবাদের প্রত্যক্ষ তৎপরতা কমেছে। তবে অনলাইন তৎপরতা রয়েছে। অনলাইন প্ল্যাটফরমগুলোর তৎপরতা সিটিটিসির বিভিন্ন ইউনিট মনিটরিং করছে। এটা আরো জোরদার করা হয়েছে।

ডি-র‍্যাডিকালাইজেশন ও রিহ্যাবিলিটেশন সম্পর্কে তিনি বলেন, এটা চলমান প্রক্রিয়া। প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে এটা সীমিতভাবে করা হচ্ছে। তবে যারা উগ্র ও জঙ্গিবাদের প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছেন তাদের কাউন্সিলিং করা হচ্ছে। বোঝানো হচ্ছে বিপথ থেকে ফিরে আসার জন্য।

‘যারা গ্রেপ্তার  হয়ে কারাগারে কিংবা জামিনে বের হয়ে আসছেন, তাদের নিয়মিত নজরদারি করা হচ্ছে। জেলা পর্যায়ে হলে সংশ্লিষ্ট জেলা পুলিশকে তাদের গতিবিধি মনিটরিংয়ের জন্য বলা হচ্ছে।’

এটিইউ-র ৩৫ অভিযানে ৫৬ উগ্রবাদী গ্রেপ্তার  : ২০২১ সালে উগ্র ও জঙ্গিবাদে জড়িত থাকার অভিযোগে পুলিশের অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিট (এটিইউ) ৩৫টি অভিযান পরিচালনা করে। অভিযানে মোট ৫৬ জনকে গ্রেপ্তার  করা হয়। তাদের মধ্যে জেএমবি সদস্য সাতজন, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের ২১ জন, আল্লাহর দলের পাঁচজন, হিযবুত তাহরীরের তিনজন, আনসার-আল ইসলামের ১০ জন, অনলাইন প্রতারক পাঁচজন এবং হেফাজতে ইসলামের চার সদস্য রয়েছেন।

এটিইউ-র পুলিশ সুপার (মিডিয়া অ্যান্ড অ্যাওয়ারনেস) মোহাম্মদ আসলাম খান বলেন, ‘ভুল বুঝে কিংবা ভুল পথে পা বাড়িয়ে জঙ্গি-উগ্রবাদে জড়ানো তরুণ-যুবকদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনাই আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর কাজের অংশ। কাজটা এটিইউ সুষ্ঠুভাবে করছে। তবে সরকারিভাবে অর্থায়ন না থাকায় যেভাবে করা দরকার সেভাবে সম্ভব হচ্ছে না। তারপরও আমরা চেষ্টা করছি। মনিটরিং, অভিযান, গ্রেপ্তারসহ নানা আইনি পদক্ষেপ বাড়ানো হয়েছে।’

জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি দেশের প্রধান আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ পুলিশ ঈদ-পূজা ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনসহ সব জাতীয় ও স্থানীয় ঘটনাসমূহের ক্ষেত্রে সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads