• মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪২৯
আরেক ভয়ঙ্কর মাদক ‘স্কোপোলামিন’

প্রতীকী ছবি

অপরাধ

আরেক ভয়ঙ্কর মাদক ‘স্কোপোলামিন’

  • ইমরান আলী
  • প্রকাশিত ৩১ জানুয়ারি ২০২২

ইয়াবার পর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বা মূল্যবান মাদক হিসেবে স্থান করে নিয়েছে ক্রিস্টাল ম্যাথ বা আইস। আইসের ক্ষতিকর দিক এখন অনেকেরই জানা।  মায়ানমার সীমান্তে এখন মাঝে মধ্যেই আইসের বড় চালান ধরা পড়ছে। আইসের পর এবার আরো ভয়ঙ্কর মাদকের সন্ধান মিলছে দেশে। যা নিয়ে ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রন অধিদপ্তর ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

নতুন এ মাদকের নাম ডেভিলস ব্রিদ বা শয়তানের শ্বাস নামে পরিচিত হলেও এর পুরো নাম স্কোপোলামিন (Scopolamine)|

সাধারণ মানুষকে লুটে নিতে স্কোপোলামিন নামের এই ভয়ঙ্কর ড্রাগটির ব্যবহার হচ্ছে। এটির বৈজ্ঞানিক নাম হায়োসিসিন ছড়াও আরো কয়েকটি নাম রয়েছে যার মধ্যে বুরুন্ডাঙ্গা, কলম্বিয়ান ডেভিলস ব্রিদ, রোবট ড্রাগ, বা জম্বি ড্রাগ উল্লেখযোগ্য।

অনুসন্ধানে জানা যায়, রাজধানীর মিরপুর এলাকার সনিয়া আক্তার মেয়েকে নিয়ে স্কুল থেকে বাসায় ফিরছিলেন। এ সময় পরিচিত কণ্ঠে পেছন থেকে এক নারী তাকে ডাক দিলেন। পেছনে ফিরতে হঠাৎ এক লোক তার মুখের সামনে একটি কাপড়ের রুমাল উড়ালেন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই একজন নারী তাকে একটি চিরটুক হাতে দেয়। এতে তিনি বোধশক্তি হারিয়ে ফেলেন। চক্রের সদস্যদের কথামতো সনিয়া স্বর্ণের বালা, গলার চেইন, কানের দুল ও মোবাইল দিয়ে দেন।

সানিয়ার মতই সম্প্রতি রাজধানীর বিভিন্ন রাস্তায় এমন প্রতারণার ফাঁদে পড়ে সর্বস্ব খুইয়েছেন অনেকে। এ চক্র এখন রাস্তা ছাড়িয়ে বিভিন্ন বাসাবাড়িতেও ঢুকে পরেছে। মিরপুর এলাকার মধ্যবয়সি জাহেদা খাতুন নামে এক নারীও পড়েন এমন চক্রের ফাঁদে। একজন তার গা-ঘেঁষে সামনের দিকে চলে যায়। আরেকজন তার কাছে এসে একটি চিরকুট ধরিয়ে এতে লেখা ঠিকানা জানতে চায়। ছোট অক্ষরে লেখা থাকায় জাহেদা একটু কাছে নিয়ে লেখা বোঝার চেষ্টা করেন। এর মধ্যে তিনজন তাকে ঘিরে দাঁড়ায়। এরপর প্রতারকরা তার কাছে থাকা টাকা-মোবাইল চাইলে তিনি সব কিছু দিয়ে দেন।

কিছুটা অজ্ঞান পার্টি বা মলম পার্টির মত মনে হলেও এটি সে রকম না। এটি আপনার শরীরের ভেতরে গিয়ে আপনার আর কোন জ্ঞান থাকবে না। তখন আপনাকে যা বলা হবে তাই করবেন। অর্থাৎ প্রকাশ্যই আপনি মোবাইল, মানিব্যাগ বা টাকা দিয়ে দেবেন। এতে করে আশপাশের মানুষও বুঝবে না আপনার কাছ থেকে সব লুটে নেওয়া হচ্ছে।

স্কোপোলামিন বা ডেভিলস ব্রিদকি : ডেভিলস ব্রিদের ক্ষতিকর যে সাবস্টেন্স সেটার নাম বুরানডাঙ্গা, তবে স্কোপোলামাইন বা হায়োসিসিন নামে এই সাবস্টেন্সের উপস্থিতি চিকিৎসা বিভাগে আগে থেকেই পরিচিত। স্কোপোলামিন ভয়ংকর একটি ড্রাগ যা মাদক হিসাবে ব্যবহার হয়। উৎপত্তি ল্যাটিন আমেরিকার কলম্বিয়ায় তবে ইকুয়েডর ও ভেনিজুয়েলাতেও এই মাদকটির যথেষ্ট বিস্তার রয়েছে। ড্রাগটি দেখতে হুবহু কোকেন পাউডারের মতই সাদা তবে এর ক্ষতির মাত্রা কোকেন থেকে বহুগুণে বেশি। মাত্র ১ গ্রাম স্কোপোলামিন দিয়ে প্রায় এক ডজনেরও বেশি মানুষকে হত্যা করা সম্ভব!

স্কোপোলামিন এর ব্যবহার : ১৯৯০ সালের দিকে এনেস্থেশিয়ার জন্য প্রথম স্কোপোলামিন ব্যবহার শুর হয়। এনস্থেশিয়ার জন্য প্রথমে এককভাবে স্কোপোলামিন ব্যবহারের প্রস্তাব করা হলেও পরে স্কোপোলামিন এবং মরফিনের সংমিশ্রণে রোগীর শরীরে ব্যবহার করা হয়। মুলত প্রসবেকালীন অ্যামনেসিয়া এবং সিনারজিস্টিক ব্যথা কমানোর জন্য এই ড্রাগটি বছরের পর বছর ব্যবহার করা হতো।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইনটারোগেশন সেলে শত্রুপক্ষের আটককৃত সৈন্যদের কাছ থেকে তথ্য আদায় করার জন্য স্কোপোলামিন ব্যবহার করা হতো। ড্রাগটি ব্যবহারের ফলে ভিকটিমের চিন্তাশক্তির নিয়ন্ত্রণ আর নিজের কাছে থাকে না। ফলে ব্রেন তখন কোন মিথ্যা বলতে পারে না। তবে কতটুকু সত্যি বলে তা নিয়ে কিছুটা দ্বিধাবিভক্তিও রয়েছে কারন এর একুরেসি রেট ৪৪ শতাংশ মাত্র।

ন্যাশনাল অ্যারোনটিক্স অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন নাসা তাদের নভোচারীদের মোশন সিকনেস কাটানোর জন্য ০.৩৩ মিলিগ্রাম স্কোপোলামিন ব্যবহার করে। এই ড্রাগটি যদি কোন সাধারণ মানুষের শরীরে ৫ থেকে ৭ মিলিগ্রাম ব্যবহার করা হয় সে তার চিন্তাশক্তির নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণরুপে হারিয়ে ফেলে জম্বি বা রোবটের মতো আচরণ করবে। আর ১০ মিলিগ্রাম স্কোপোলামিন বা তার বেশি পরিমানে কারো শরীরে প্রয়োগ করা হলে সে কোমায় চলে যাবে যেখান থেকে মৃত্যুও ঘটা স্বাভাববিক বিষয়।

স্কোপোলামিন কিভাবে কাজ করে : স্কোপোলামিন বা ডেভিলস ব্রিদ শরীরে প্রবেশ করার সাথে সাথে মানুষের মস্তিস্কের প্রাথমিক স্মৃতি বা যাকে বলে ‘ইনিশিয়াল স্টেইজ অব মেমোরি’ বলি সেটিকে ব্লক করে দেয়। ফলে আক্রান্ত ব্যক্তি আক্রমণকারীকে সমনে দেখতে পেলেও চিনতে পারেন না এবং কিছু মনে রাখতে পারে না।

একই সাথে এই ড্রাগটি মস্তিক্ষের চিন্তা করার ক্ষমতাকেও ব্লক করে দেয়। ফলে শরীরে কোন প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকে না বা বাইরের কোন আক্রমণে শরীর কোনো প্রতিক্রিয়া দেখানোর মতো অবস্থা থাকে না। এ অবস্থায় ভিক্টিমের আচরণ হয়ে যায় বশীভূত বা সুতায় বাঁধা পুতুলের মত!

স্কোপোলামিন কতক্ষন কার্যকারী থাকতে পারে : চামড়ার মাধ্যমে স্কোপোলামিন দেহে প্রবেশ করালে মাদকটির প্রতিক্রিয়া শরীরে শুরু হতে সাধারণত ২০ মিনিট সময় লাগে এবং তা ৮ ঘন্টা পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। এই সময়ের মধ্যে যিনি স্কোপোলামিন গ্রহণ করলেন তিনি থাকেন গোধুলী ঘুম বা টুইলাইট স্লিপে। আর এই সময়ের মধ্যে তাকে দিয়ে সব কিছুই করানো সম্ভব। ঠিক যেন হিপনোটাইজের ফলে, শরীর ও মনের উপরে সম্পূর্ণ দখল অন্য কারো হাতে চলে যাওয়া।

সতর্কতা : আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলেন, সবথেকে বেশি জরুরি নিজের সাবধানতা, তাই রাস্তাঘাটে অপরিচিত সকলের থেকে সবসময় সতর্ক থাকুন। বিশেষ করে জুয়েলারি ও ব্যাংক থেকে বের হবার সময় নারী ও পুরুষের সকলেই এই ঘটনাগুলো মনে রাখুন এবং সাবধান থাকুন। সাবধান থাকুন রিক্সার যাত্রী ও পথচারী হবার সময়েও।

কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের রেসিডেন্ট সাইকিয়াট্রিস্ট ডা. মো. রাহেনুল ইসলাম বলেন, স্কোপোলামিন মেডিসিন মানব দেহে ব্যবহার বেশ ভয়ঙ্কর বিষয়। নাসা তাদের অ্যাস্ট্রোনাটদের ওপর ০.৩৩ মিলিগ্রাম ইউজ করে, তাদের মোশন সিকনেস কাটানোর জন্য। আর যেকোনো সাধারণ মানুষের ওপর যদি এর ৫-৭ মিলিগ্রাম ইউজ করা হয় তবে সে হয়ে যাবে এমন হেল্প লেস। তাকে দিয়ে যা ইচ্ছা করানো যাবে! আর যদি ১০ মিলিগ্রাম বা তার বেশি হয় তবে রোগী কোমায় চলে যাবে এবং সেখান থেকে মারা যেতে পারে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (অপারেশন) বজলুর রহমান বলেন, খুলনায় এ ধরনের মাদক তারা জব্দ করেছিলেন। ঢাকায়ও এ ধরনের মাদকের অস্তিত্ব রয়েছে।

তিনি বলেন, আমরা এটি নিয়ে কাজও করছি। অন্যান্য মাদকের মত যেন এর বিস্তার না ঘটে সে ব্যাপারে আমরা সচেতন।

র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক খন্দকার আল মঈন বলেন, আমরা এ ধরনের মাদকের নাম শুনেছি। ইতিমধ্যে এর ব্যাবহারে ক্ষতিকর দিক সম্পর্কেও অবহিত। যারা এ ধরনের ঘটনার সম্মুখীন হয়েছেন তারা যেন র্যাব বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অবহিত করে সে বিষয়ে তিনি আহ্বান জানান।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads