• বুধবার, ১৫ মে ২০২৪, ১ জৈষ্ঠ ১৪২৯
মেরিন ড্রাইভে বন্দুকযুদ্ধে প্রাণ গেছে ৫৬ জনের

প্রতীকী ছবি

অপরাধ

মেরিন ড্রাইভে বন্দুকযুদ্ধে প্রাণ গেছে ৫৬ জনের

  • কক্সবাজার প্রতিনিধি
  • প্রকাশিত ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২২

কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভকে ডাকা হতো মরণ ড্রাইভ। বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহার মৃত্যুর আগের দুটি বছর ছিল রক্তাক্ত। এই সময়ে ১২০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সড়কে কথিত বন্দুকযুদ্ধে প্রাণ গেছে অন্তত ৫৬ জনের। ২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে সিনহার মৃত্যুর পর ওই সড়কে আর কোনো কথিত বন্দুকযুদ্ধ হয়নি।

পুলিশ বলছে, মাদককারবারিরা এখন তাদের গুলি করে না। ফলে তাদেরও পাল্টা গুলি করতে হচ্ছে না।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৮ সালে বিশেষ মাদকবিরোধী অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে ২০২০ সালের ৩০ জুলাই পর্যন্ত শুধু কক্সবাজার জেলায় পুলিশ, বিজিবি ও র্যাবের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন ২৮৭ জন। এর মধ্যে পুলিশের গুলিতে ১৭৪ জন, বিজিবির গুলিতে ৬২ ও র্যাবের গুলিতে ৫১ জন নিহত হন।

এই সময়ে কেবল কক্সবাজারের উপজেলা টেকনাফেই কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন ১৬১ জন। তার মধ্যে শুধু মেরিন ড্রাইভের বিভিন্ন অংশে যারা মারা যান, তাদের সিংহভাগই সিনহা হত্যা মামলার আসামি টেকনাফ থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা প্রদীপ কুমার দাশের নির্দেশে হয়েছে বলে অভিযোগ আছে।

সিনহা হত্যার আগে এত ‘বন্দুকযুদ্ধ’ আর হত্যার পর একটি ঘটনাও না ঘটার বিষয়ে জানতে চাইলে কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) রফিকুল ইসলাম বলেন, মাদককারবারিও এখন আর পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে না। তাই আমাদেরও আত্মরক্ষার্থে পাল্টা গুলি চালাতে হয় না। মূলত এখন তেমন প্রয়োজন হয় না তাই বন্দুকযুদ্ধ হচ্ছে না। সেটি ছাড়াও কিন্তু বড় ইয়াবার চালান উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে।

মানবাধিকার ও সুশাসন ইস্যুতে কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর কক্সবাজার শাখার সাধারণ সম্পাদক মাহাবুবুর রহমান বলেন, সিনহা হত্যার আগে কেন এমন ঘটনা ঘটত, সে প্রশ্ন জাগতেই পারে এখন। এই হত্যার পর যদি বন্দুকযুদ্ধ ছাড়াই ইয়াবার বড় চালান ধরা সম্ভব হয়, তাহলে বলতে হয়- এখানে আগে যে বন্দুকযুদ্ধ হয়েছে, আগে ব্যক্তিস্বার্থ বা কারও ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। আমরা বলতে চাই- এ দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কাম্য নয়।

কক্সবাজার থেকে বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেঁষে গাছের ছায়ায় মেরিন ড্রাইভ সড়কটি চলে গেছে টেকনাফ পর্যন্ত। এ সড়কে গাড়ি উঠলে মানুষের মন তার সঙ্গে ছুটে চলা পাশের নীল সাগরের ঢেউয়ের মতো উচ্ছল হয়ে উঠে। সেই স্বপ্নের মেরিন ড্রাইভ পরিণত হয় আতঙ্কের ‘ক্রসফায়ারের’ নিরাপদ এলাকা হিসেবে। পুলিশ ও র্যাবের হাতে মেরিন ড্রাইভে এত ব্যাপক হারে কথিত বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটেছে যে মেরিন ড্রাইভ যেন ‘রোড টু ডেথ’-এর সমার্থক হয়ে উঠে। কক্সবাজার এলাকায় কেউ কাউকে হুমকি দিতেও ‘মেরিন ড্রাইভ দেখিয়ে দেওয়ার’ কথা বলতো। শুরুর দিকে বড় বড় অপরাধী ও মাদককারবারিরা ক্রসফায়ারে নিহত হওয়ায় সাধারণ মানুষ কিছুটা অনুমোদনের মানসিকতায় বিষয়টি দেখেছে। এরপর মানুষের মনে ভয়ের কাঁপন ধরিয়েছে ক্রসফায়ারে হত্যার ভয় দেখিয়ে চাঁদাবাজি। পুলিশের কিছু অসাধু সদস্যের টাকার চাহিদা মেটাতে না পেরে অনেকের জীবনও গেছে এমন অভিযোগও আছে। টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ চালু করেন মেরিন ড্রাইভে ‘ক্রসফায়ারের’ ব্যাপক প্রচলন।

টেকনাফের সীমান্ত এলাকায় ইয়াবাবিরোধী সাঁড়াশি অভিযান শুরুর আগে থানার কিছু পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধেই ইয়াবাকারবারিদের কাছ থেকে নিয়মিত মাসোহারা আদায়ের অভিযোগ ছিল। চলছিল ‘গ্রেপ্তার বাণিজ্য।’ রাতবিরাতে ইয়াবাকারবারের অভিযোগ তুলে লোকজনকে আটক করে থানায় আনা হতো। এরপর তাদের ইয়াবার পুঁটলি দেখিয়ে চালান দেওয়ার নামে আদায় করা হতো টাকা। চাহিদা অনুযায়ী অর্থ আদায়ে ব্যর্থ হলে ক্রসফায়ারে হত্যা করা হতো।

সিনহা হত্যার পর কেবল কক্সবাজারের সেই সড়কেই নয়, সারা দেশেই কথিত বন্দুকযুদ্ধে প্রাণহানি কমেছে।

২০১৬ সালে দেশে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ১৭৭ জনের মৃত্যু হয় বলে মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে। ২০১৭ সালে এ সংখ্যা কমে ১৪১ জনে নেমে আসে। ২০১৮ সালে তা আবার বাড়ে। ওই বছরে নিহত হয় ৪২১ জন। ২০১৯ সালে নিহত হয় ৩৭৪ জন। ২০২০ সালে তা কমে হয় ১৮৮ জনে। এই মৃত্যুর বেশির ভাগই হয়েছিল সিনহা হত্যার আগে। আর সদ্যসমাপ্ত বছর ২০২১ সালে তা আরো কমে হয় ৫১ জন।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads