• রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ৫ জৈষ্ঠ ১৪২৯
বেটিং অ্যাপের ফাঁদে সর্বশান্ত

প্রতীকী ছবি

অপরাধ

বেটিং অ্যাপের ফাঁদে সর্বশান্ত

  • ইমরান আলী
  • প্রকাশিত ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২২

রাজধানীর বনশ্রী এলাকার বাসিন্দা আব্দুর রহমান। পেশায় ব্যবসায়ী ছিলেন। কিন্তু ক্রিকেট বেটিং অ্যাপের জুয়ার ফাঁদে পড়ে সর্বস্বান্ত। আব্দুর রহমান এখন ছোট চায়ের দোকান দিয়ে কোনমতে জীবন চালাচ্ছেন।

রহমানের মতো বনশ্রীর অন্তত শতাধিক ব্যক্তি জুয়ার ফাঁদে পড়ে সর্বস্বান্ত হয়েছে। আর এটি যদি পুরো রাজধানীজুড়ে হিসেবে করা যায় তবে কয়েক লাখে পৌঁছাবে। বেটিং অ্যাপে জুয়ার ফাঁদ যে শুধু শহরকেন্দ্রিক তা নয়, শহর ছাপিয়ে তা এখন দেশের আনাচে-কানাচে। জুয়ার এ ফাঁদে পড়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ।  

সূত্র মতে, বাংলাদেশে এখন আলোচিত শব্দ ক্রিকেট জুয়া। এই জুয়া এখন ছড়িয়ে পড়েছে শহর থেকে গ্রামে। একে কেউ কেউ বলে টাকা লাগানো। আবার কেউ বলেন বাজি। বিপিএল, আইপিএলসহ নানা খেলা চলার সময় চলে এই জুয়া বা বেটিং। বিপিএল, আইপিএল, বিশ্বকাপ, ওয়ানডে, এমনকি দেশ-বিদেশের টেস্ট খেলা ঘিরেও চলে বাজিকরদের রমরমা জুয়া। যেখানে জড়িয়ে পড়েছেন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী, যুবক ও ব্যবসায়ীসহ অনেকেই। এমনকি শ্রমজীবী মানুষেরা, যারা ‘দিন আনে দিনে খায়’ তারাও এই জুয়ার জালে পড়ে হারাচ্ছেন কষ্ট করে জমানো সামান্য পুঁজি। এছাড়া স্কুল-কলেজের কোমলমতি ছাত্ররা বিপথগামী হচ্ছে।

একইসঙ্গে জুয়ায় হার-জিতকে কেন্দ্র করে পারিবারিক ও সামাজিক অস্থিরতা দিন দিন বাড়ছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিভিন্ন ওয়েবসাইটের মাধ্যমেও চলে এই জুয়া বা বেটিং খেলা। ক্রিকেটবিষয়ক জনপ্রিয় ওয়েবসাইট ক্রিকইনফোতেও দেখা যায় বেটিং এর অপশন। বেটিং-এর দুটি জনপ্রিয় ওয়েবসাইট হলো বেট৩৬৫ এবং বেটওয়ে।

ক্রিকেট জুয়া হয় নানাভাবে। দলের হার-জিত, পরের বলে কত রান বা ছয়-চার হবে কি-না, পরের ওভারে ব্যাটসম্যান আউট হবেন কি-না, একজন বোলার কত উইকেট পাবেন, ব্যাটসম্যান কত রান করবেন, দলের কত রান হতে পারে, নির্দিষ্ট দল কত রান বা উইকেটের ব্যবধানে জিতবে ইত্যাদি ছোটখাটো নানা বিষয় নিয়েই চলছে বাজি ধরা। বাজির দরও ঠিক করেন নিজেরাই।

এই বেটিং বা জুয়া সাধারণত দুই দলের হার-জয়ের ওপর ধরা হয়। এই ক্ষেত্রে ভালো দল, যার জয়ের সুযোগ বেশি তার বাজির হার দুই আর অপেক্ষাকৃত দুর্বল দল এক। মনে করুন, অস্ট্রেলিয়া-বাংলাদেশ খেলা হচ্ছে। তখন বাংলাদেশের পক্ষে বাজির হার ১ এবং অজিদের পক্ষে ২। অস্ট্রেলিয়া যেহেতু ভালো দল, তাই যে বাজি ধরবে সে ২০০০ দিলে ১০০০ টাকা বেশি পাবে। আর বাংলাদেশ যেহেতু দুর্বল দল তাই বাংলাদেশ জিতলে যে বাজি ধরবে সে ১০০০ দিলে ২০০০ বেশি পাবে। অর্থাৎ আপনি যদি অজিদের হয়ে বাজি ধরেন তবে আপনাকে কমপক্ষে ২০০০ টাকা দিয়ে বাজি ধরতে হবে। আর বাংলাদেশ ধরলে ১০০০ টাকা। আপনি বাংলাদেশের হয়ে ধরলে বলতে হবে ১:২ আর অজিদের হয়ে ধরলে ২:১। যদিও এই হার প্রায়ই ওঠানামা করে। স্থানীয় বাজিকররা ২:৩, ৩:২, ৩:৫ এই হারেও বাজি ধরে থাকে। তবে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এটা খুব কমই দেখা যায়। এই বাজির ক্ষেত্রে বেশিরভাগ জুয়াড়িই দুর্বল দলের হয়ে বাজি ধরে থাকে। কেননা এতে বিনিয়োগ কম থাকে আর লাভ বেশি।

বল বাই বল বেটিং : বল বাই বল বাজির ক্ষেত্রে প্রতি বলে বলে একটা নির্দিষ্ট হারে বাজি ধরা হয়ে থাকে। যেমন, বলে ছয় হবে কিনা, হলে তা কোন বলে হবে, রান আউট হবে কিনা, চার হবে কিনা, কোনো আউট হবে কিনা, হলে তা কোন ধরনের আউট হবে ইত্যাদি।

প্রতি ওভারে বেটিং : এই বাজির ক্ষেত্রেও বলের মতো একই নিয়ম। তবে এখানে বলের জায়গায় এক ওভার হিসেব করা হয়। যেমন, ওভারে ছয় বা চার কয়টি হবে। আউট হবে কিনা, হলে তা কীভাবে হবে রান কত নেবে ইত্যাদি।

টসের ওপর : শুধু বল বা ওভারের ওপর নয় টসের ওপরেও বাজি ধরা হয়ে থাকে। অর্থাৎ কোন দল টস জিতবে বা হারবে তার ওপর। এমনকি ব্যাটিং নেবে না বোলিং নেবে তার ওপরও হয় বাজি।

খেলোয়াড়ের ওপর : এই বাজির ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট খেলোয়াড়ের ওপর বাজি ধরা হয়ে থাকে। যেমন, একজন খেলোয়াড় কত রান করবে, কত রানে আউট হবে, কীভাবে আউট হবে, ছয় বা চার কয়টি, ক্যাচ কয়টি নেবে ইত্যাদি।

দলের ওপর : এই ক্ষেত্রে দলের ওপর বাজি ধরা হয়। অর্থাৎ কোনো নির্দিষ্ট দল অলআউট হবে কত রানে। দল কত উইকেট শিকার করবে, কতটি চার বা ছয় মারতে পারবে, ক্যাচ কয়টি নেবে ইত্যাদি।

এদিকে ক্রিকেটবিশ্বে সবচেয়ে ধনী ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড (বিসিসিআই)। তাদের আয়োজন করা শতকোটি ডলারের লীগ আইপিএল খেলতে মুখিয়ে থাকেন খেলোয়াড়রা। ক্রিকেটবিশ্বে সবচেয়ে বেশি জুয়া হচ্ছে এই আইপিএল ঘিরে। প্রভাবশালী ভারতীয় দৈনিক টাইমস অব ইন্ডিয়া গত বছর জানিয়েছিল, ভারতে জুয়ার বাজার ছয় হাজার কোটি ডলার বা পাঁচ লাখ চার হাজার কোটি টাকার।

বাংলাদেশের ক্রিকেট ভারতের উচ্চতায় পৌঁছেনি। তবু বাংলাদেশের পাড়া-মহল্লা থেকে শুরু করে পাঁচতারা হোটেল পর্যন্ত ক্রিকেট নিয়ে বাজি চলে।

সিআইডির সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দারা বলছেন, দেশে ক্রিকেট জুয়ার বাজার আনুমানিক সাত হাজার কোটি টাকার। সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারের অতিরিক্ত ডিআইজি কামরুল আহসান বলেছেন, ‘আমরা বিভিন্ন সাইটে প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ কোটি টাকার লেনদেন হতে দেখি। আইপিএল, বিপিএল ও বিশ্বকাপের মতো আসর থাকলে এই লেনদেন বেড়ে যায়। বেশিরভাগ জুয়া হয় ক্রিকেট নিয়ে। ফুটবলের লা লিগা আর প্রিমিয়ার লীগ নিয়েও জুয়াড়িদের আগ্রহ বাড়ছে। পাশাপাশি আছে বিভিন্ন দোকান, ক্লাব ও হোটেলে বসা বাজির আসর। সেখানে কত টাকা লেনদেন হয় বলা কঠিন। তবে বছরে অনলাইন জুয়ায় পাচার হয়ে যায় এক হাজার থেকে এক হাজার ২০০ কোটি টাকার মতো। এটা ঠেকাতেই নিরলস কাজ করে চলেছি আমরা।’

সিআইডির হিসাব মতে, বাংলাদেশে দিনে ১০ থেকে ১৫ কোটি টাকা জুয়ার গড় ১২.৫ কোটি ধরলে অবৈধ জুয়ার সাইটে বছরে লেনদেন হয় চার হাজার ৫০০ কোটি টাকার বেশি। ক্রিকেট জুয়া তদন্তকারী গোয়েন্দাদের অনুমান, দোকান, ক্লাব, হোটেলেও এই অঙ্কের কাছাকাছি লেনদেন হয় বছরজুড়ে। তাহলে অন্তত ৯ হাজার কোটি টাকার জুয়ার বাজার আছে বাংলাদেশে।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার মশিউর রহমান বলেন, আমরা এটি নিয়ে কাজ করছি। দ্রুত এ বিষয়ে রেজাল্ট আসবে। জুয়ার মূলহোতাদের গ্রেপ্তারে কাজ করছে গোয়েন্দা বিভাগ।

র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন সায় দিলেন তাতে, মানি লন্ডারিং নিয়ে কাজ করে সিআইডি। তারা যদি বলে দিনে জুয়ার সাইটে ১০ থেকে ১৫ কোটি টাকা অনলাইনে অবৈধ লেনদেন হচ্ছে, তাহলে তথ্যটি ঠিকই আছে বলা যায়। তিনি আরো বলেন, আমরাও মনিটরিং করছি। এ চক্রকে গ্রেপ্তারে কাজ করা হচ্ছে। 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads