• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
অসুস্থকে সুস্থ করবে জিন!

প্রতীকী ছবি

অপরাধ

অসুস্থকে সুস্থ করবে জিন!

  • ইমরান আলী
  • প্রকাশিত ৩০ জুলাই ২০২২

প্রতারণার বিজ্ঞাপনে ভরে গেছে জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অমিল, অবাধ্য স্বামী বশে আনা, জিন-ভূতের আসর থেকে মুক্তি, লটারিতে টাকা জেতানোর দোয়া এ ধরনের প্রতারণার বিজ্ঞাপনে ভরে গেছে ফেসবুক। বিশেষ করে কাগজকে টাকায় আর অসুস্থ হলে সুস্থ করবে জিনসহ নানা চটকদার ধর্মীয় নানা বিষয় নিয়ে তৈরি করা এসব বিজ্ঞাপন। মূলত তারা ফেসবুকে এ ধরনের বিজ্ঞাপন দিয়ে সেখানে বুস্ট করছে। এ কারণে ফেসবুকের ভিডিও অপশনে সহজেই চোখে পড়ছে। এতে করেই আকৃষ্ট হচ্ছে লোকজন। আর তাতেই লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে এ চক্র। সম্প্রতি এ ধরনের একটি চক্রকে গ্রেপ্তারও করেছে র‍্যাব।

জানা যায়, সংঘবদ্ধ একটি চক্র জিন-ভূতের আসর থেকে মুক্তি, অবাধ্য স্বামী বাধ্য করা, মনের আশা পূরণ করাসহ নানা ধরনের চটকদার বিজ্ঞাপনের ভিডিও তৈরি করছে। বিজ্ঞাপনে বয়স্ক ব্যক্তিকে দাড়ি টুপি লাগিয়ে জিনের বাদশা সাজিয়ে তার দ্বারাই মনের সব আশা পূরণ হবে এমন বক্তব্য প্রচার করে। ভিডিওটি ফেসবুক এবং ইউটিউবে দিয়ে সেখানে বুষ্ট করা হচ্ছে। স্ক্রিনে দেখানো নম্বরে ফোন করতে বলা হয়। আর ফোন করলেই নানা কৌশলে টাকা চাওয়া হয়। তাদের দেয়া বিকাশে টাকা পাঠালেই পরে আর ফোন ধরে না। এমনভাবেই তারা প্রতারণা করে আসছে।

ভুক্তভোগী নারী আসমা আক্তার জানান, এ ধরনের ভিডিও দেখে তিনি স্ক্রিনে দেখানো নম্বরে ফোন করেন। জিন তাড়ানোর জন্য তিনি সহায়তাসহ আরো কয়েকটি বিষয়ে সহায়তা চান। এরপর তার কথা শুনে সেগুলোর সমাধানের আশ্বাসও দেয়া হয়। এরপর কয়েক দফায় তার কাছ থেকে প্রায় আড়াই লাখ টাকা নেয়া হয়। পরে তিনি যখন বুঝতে পারেন প্রতারণার শিকার হচ্ছেন তখন টাকা ফেরত চাইলে তাকে হুমকি দেয়া হয়।

আসমা আক্তারের মতো এরকম শত শত ব্যক্তি প্রতারিত হচ্ছেন। আর চক্রটি লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।

জাানা যায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চক্রটি দীর্ঘদিন ধরেই এ ধরনের প্রতারণা করে আসছে। তাদের বিজ্ঞাপনের ফাঁদে পড়ে সর্বস্ব হারাচ্ছে সাধারণ মানুষ। এ চক্রটি শুধু দেশে নয়, প্রবাসীদের সঙ্গেও একইভাবে প্রতারণা করে আসছে। বিদেশে বিভিন্ন লটারিতে জেতার আশ্বাস দিয়েও চক্রটি লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়।
এদিকে সম্প্রতি এ ধরনের এক সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্রকে গ্রেপ্তার করেছে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন র‍্যাব-১।

র‍্যাব-১ এর সহকারী পরিচালক (অপস অফিসার) সহকারী পুলিশ সুপার নোমান আহমদ বলেন, ‘কাগজ হয়ে যায় টাকা’ ও ‘অসুস্থ হলে সুস্থ করে দেবে জিন’ এমন বিভিন্ন অকৌশল অবলম্বন করে সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছিল একটি চক্র। এ চক্রের সদস্যরা সাধারণ নিরীহ মানুষকে রোগ থেকে মুক্তিদান, স্বল্প সময়ে স্বাবলম্বী করে তোলার প্রলোভন দেখিয়ে কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে।

রাজধানীর দক্ষিণখান থানাধীন ফায়দাবাদ কোর্টবাড়ী বাজারস্থ এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্রের মূলহোতাসহ তিনজনকে আটক করা হয়। আটককৃতরা হলেন- পঞ্চগড়ের মো. সারোয়ার হোসেন (২৭), পঞ্চগড়ের মো. লাজু পারভেজ (২৭) ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আব্দুর রহমান (২৪)।

এ সময় তাদের কাছ থেকে একটি পাসপোর্ট, একটি চেকবই, সাতটি এটিএম কার্ড, একটি জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি, একটি প্রেস আইডি কার্ড, একটি ল্যাপটপ, দুটি মাইক্রোফোন, একটি ইউটিউব ক্যামেরা, দুটি সিসি ক্যামেরা, ৯০০ টাকা মূল্যের বাংলাদেশি জালনোট, ৬টি মোবাইল ফোন, ৯টি সিমকার্ড ও নগদ ৯৮ হাজার ৪০০ টাকা জব্দ করা হয়।

তিনি বলেন, আটককৃতরা একটি সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্রের সদস্য। সারোয়ার হোসেন এই প্রতারক চক্রের মূলহোতা এবং অপর দুজন তার অন্যতম সহযোগী। তারা সাধারণত স্বল্প আয়ের মানুষদের টার্গেট করত। তারা বিভিন্ন জেলার হতদরিদ্র সাধারণ নিরীহ মানুষদের রোগ থেকে মুক্তিদান, স্বল্প সময়ে স্বাবলম্বী করে তোলার প্রলোভন দেখাতো। এতে স্বল্প আয়ের মানুষরা সহজেই প্রলুব্ধ হত। এই চক্রটি দরিদ্র রোগীদের চিকিৎসা বাবদ প্রথম সাক্ষাতে এক হাজার টাকা করে ফি গ্রহণ করত।
পরে গরিব অসহায় রোগীদের কাছে বিভিন্ন ধাপে ঝাড়ফুঁক, জিন তাড়ানোসহ ভুয়া কবিরাজি চিকিৎসার নামে ৫০-৬০ হাজার টাকা করে নিত। সাধারণ মানুষ তাদের প্রতারণা সম্পর্কে জানার আগেই চক্রটি তাদের অবস্থান পরিবর্তন করত এবং নতুন এলাকায় গিয়ে পুনরায় সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করত। এভাবে তারা শত শত সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে।

সারোয়ার হোসেনকে জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে র‍্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, সে একজন পোশাক শ্রমিক ছিল। তার শিক্ষাগত যোগ্যতা ৮ম শ্রেণি। সে কোনোদিন মাদ্রাসায় পড়ালেখা না করলেও কিংবা চিকিৎসা পেশায় কোনো প্রশিক্ষণ না থাকার পরেও নিজেকে চিকিৎসক ও মাওলানা পরিচয় দিয়ে সাধারণ মানুষকে প্রতারিত করত। সে তার সহযোগীদের সঙ্গে ২০১৯ সালে গাজীপুরের কাশিমপুরস্থ লতিফপুর এলাকায় ভুয়া কবিরাজীর মাধ্যমে অসহায় নিরীহ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা শুরু করে। পরে সাধারণ মানুষ তাদের প্রতারণা সম্পর্কে জানার আগেই তারা অবস্থান পরিবর্তন করে দক্ষিণখানস্থ ফায়দাবাদ এলাকায় এসে মানুষকে প্রতারিত করতে থাকে।

সারোয়ার হোসেন তার সহযোগীদের সঙ্গে পরস্পর যোগসাজশে দীর্ঘদিন ধরে নিজেদের জিনের বাদশা পরিচয় দিয়ে প্রতারণা করত। এই চক্রটি প্রতারণার ফাঁদ হিসেবে প্রথমে ফেসবুক ও ইউটিউবে ‘মুমিন মুসলমান’ নামের চ্যানেল খোলে। পরে জিন, জাদুটোনা, ব্ল্যাকমেইল, বদনজর, কুফরি কালাম, বান ও পোতে রাখার প্রভাবে মানুষের যে ক্ষতি হয় তার সমাধান করতে পারে বলে তাদের ফেসবুক ও ইউটিউব চ্যানেলে নিয়মিত প্রচার করে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের বিজ্ঞাপন দেখে আরোগ্য হওয়ার আশায় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে হতদরিদ্র শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ পুরুষ ও নারীরা তাদের কাছে চিকিৎসার জন্য আসত। সারোয়ার হোসেন এসকল সহজ সরল, হতদরিদ্র, অসহায়, শারীরিক অসুস্থ নারী ও পুরুষদের কাছে নিজেকে জিনের বাদশা পরিচয় দিয়ে কবিরাজী চিকিৎসার নামে প্রতারণা করে কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে।

ভুক্তভোগীরা বলছেন, চক্রের এ ধরনের বিজ্ঞাপন ফেসবুকে বা ইউটিউবে নজরদারির মাধ্যমে বন্ধ করা গেলে এ ধরনের প্রতারণা কমে আসতো। নতুবা চক্রটি দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে। আর প্রতিনিয়ত প্রতারিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ।

ডিএমপির কাউন্টার টেরোরিজমের সাইবার ক্রাইম ইউনিটের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (এডিসি) নাজমুল ইসলাম বলেন, ফেসবুক বা ইউটিউবে এসব বিজ্ঞাপন আমরা নজরদারি করে আসছি। কিছু চক্রকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে।

তিনি বলেন, আসলে আমাদের নিজেদের সচেতন হতে হবে। এসব বিজ্ঞাপন দেখলেই বোঝা যায় এরা প্রতারক। এটা জেনে শুনে সেখানে পা দেয় এক শ্রেণির লোকজন।

তিনি আরো বলেন, ফেসবুক কিংবা ইউটিউবে কিছু দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়া উচিত নয়।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads