• রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪২৯
বিদেশি সহায়তার পাইপলাইনে  জমেছে ৩ লাখ কোটি টাকা

বাংলাদেশ সরকারের সিল

অর্থ ও বাণিজ্য

বিদেশি সহায়তার পাইপলাইনে জমেছে ৩ লাখ কোটি টাকা

  • জাহিদুল ইসলাম
  • প্রকাশিত ২৮ মে ২০১৮

উপকূলীয় সাত জেলার ভূমি রক্ষায় ২০১৩ সালের ১ জুলাই ৩ হাজার ২৮০ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্প নেয় বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড। এর আওতায় ৬২৩ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ, ৭৯৪ কিলোমিটার ড্রেনেজ উন্নয়ন, ২৪৪টি স্লুইসগেট নির্মাণ করে ৩০০ হেক্টর ভূমি উদ্ধারের পাশাপাশি লাখ হেক্টর জমি রক্ষার পরিকল্পনা আছে। এতে শতভাগ অর্থায়নে একই বছরের নভেম্বরে ঋণচুক্তি করে বিশ্বব্যাংক। তবে কাজে গতি না আসায় অর্থছাড় করছে না সংস্থাটি। চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত দাতা সংস্থাটি দিয়েছে মাত্র ৭ কোটি ৩০ লাখ ডলার। প্রায় পাঁচ বছরে প্রকল্পের অগ্রগতি ১৮ দশমিক ২৪ শতাংশ। দ্রুত কাজ করতে পারলে ২০২০ সালের মধ্যে ৩২ কোটি ৭০ লাখ ডলার পাওয়া যাবে।

এভাবে বিদেশি সহায়তায় নেওয়া সরকারের প্রকল্পগুলোতে প্রতিবছর জমা বাড়ছে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬-১৭ অর্থবছর শেষে বিদেশি সহায়তার পাইপলাইনে ছিল ৩ হাজার ৫৭৪ কোটি ৯০ লাখ ডলার। বিভাগের সর্বশেষ প্রকাশনা ফ্লো অব এক্সটার্নাল রিসোর্সেস ইন বাংলাদেশ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, অর্থবছরের শুরুতে এর পরিমাণ ছিল ২ হাজার ২০৬ কোটি ৮০ লাখ ডলার। এ হিসাবে এক বছরে পাইপলাইনে জমেছে বাড়তি ১ হাজার ৩৬৮ কোটি ১০ লাখ ডলার।

এদিকে চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে ৮২৫ কোটি ৮০ লাখ ডলার সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থা। একই সময়ে তারা ছাড় করেছে ৩৯৯ কোটি ডলার। এ হিসাবে চলতি অর্থবছর পাইপলাইনে যোগ হয়েছে আরো ৪২৬ কোটি ৮০ লাখ ডলার। সব মিলে সহায়তার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ১ কোটি ৭০ লাখ ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৩ লাখ ২০ হাজার ১৩৬ কোটি টাকা।

প্রকল্প বাস্তবায়নে অদক্ষতা, অব্যবস্থাপনা ও কর্মকর্তাদের অনীহার কারণে বিদেশি সহায়তা জমে থাকছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, বছরের পর বছর কাজ ঝুলে থাকলে অনেক সময় দাতারা সহায়তা প্রত্যাহার করে নেয়। এর ফলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও মানব উন্নয়নের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাত স্থবির হয়ে পড়ে। অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ উৎসে চাপ বেড়ে যাওয়ায় বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান, উৎপাদন ও প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়। অবশ্য পাইপলাইনে বেশি অর্থ জমা থাকলে পরবর্তী সময়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন সহজ হয় বলে সরকারের দাবি।

পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য ড. শামসুল আলাম এ বিষয়ে বলেন, বিদেশি ঋণের চুক্তি সম্পন্ন হলে সাধারণত প্রকল্প বাস্তবায়নে গতি আসে। পাইপলাইনের আকারের ওপর নির্ভর করে কী পরিমাণ অর্থ ছাড় হবে। সহায়তার এ স্ফীতিকে সরকারের সক্ষমতা হিসেবে বিবেচনা করেন তিনি।

অবশ্য দাতাদের প্রতিশ্রুতি আদায়ের পাশাপাশি প্রকল্প বাস্তবায়নে জোর দিতে সরকারের প্রতি পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, কাজে গতি না এলে সহায়তা ছাড় বাড়বে না। উন্নয়নে স্থবিরতা বিরাজ করায় পাইপলাইনের আকার বাড়ছে। তিনি বলেন, বড় প্রকল্পে গতি বাড়ালে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হবে। আর দেশি অর্থায়নে প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসারও তাগিদ দেন এই অর্থনীতিবিদ।

ইআরডিতে দীর্ঘদিন অতিরিক্ত সচিবের দায়িত্ব পালন করেছেন পরিকল্পনা কমিশনের সাবেক সদস্য আরাস্তু খান। তিনি বলেন, কয়েক বছরে বিদেশি সহায়তার প্রতিশ্রুতি বেড়েছে ব্যাপক হারে। তবে অর্থছাড় বেড়েছে সামান্যই। এ কারণে পাইপলাইনের আকার বাড়ছে। তিনি বলেন, বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের পর্যায়ে আসতে কয়েক বছর সময় লাগে। এরই মধ্যে কয়েকটি প্রকল্প আলোর মুখ দেখছে। এগুলোর কাজ শুরু হলে পাইপলাইনের আকার ছোট হয়ে আসবে বলেও মনে করেন তিনি।

বিদেশি সহায়তা ব্যবহারে অনীহার বিষয়টি অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে প্রকল্প বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রতিবেদনে। তাতে বলা হয়েছে, গত অর্থবছর এডিপি বাস্তবায়নে বিদেশি সহায়তা ধরা হয়েছিল ৪০ হাজার কোটি টাকা। বাস্তবায়নে ধীরগতির কারণে তা ৩৫ হাজার ৭৯৭ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়। বছর শেষে এই তহবিল থেকে ব্যয় হয় ২৮ হাজার ২৬৯ কোটি টাকা। এ হিসাবে আরএডিপি বাস্তবায়নে বিদেশি সহায়তা বরাদ্দের ৭ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা কম ব্যবহার হয়। আর মূল এডিপির হিসাবে প্রকল্প সহায়তা ফেরত যায় ১১ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের এডিপি থেকেও প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা কেটে নেওয়া হয়েছে। ১ লাখ ৬৪ হাজার ৮৪ কোটি ৮৩ লাখ টাকার এডিপি নেমে এসেছে ১ লাখ ৫৭ হাজার ৫৯৪ কোটি ৩৯ লাখ টাকায়। এতে বিদেশি সহায়তা রাখা হয়েছে ৫২ হাজার ৫০ কোটি টাকা, অর্থবছরের শুরুতে যা ছিল ৫৭ হাজার কোটি টাকা।

ইআরডির আরেক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দাতা সংস্থাগুলোর প্রতিশ্রুতির বিপরীতে মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সক্ষমতা বাড়ছে না। এতে থমকে আছে অর্থ ছাড়। প্রকল্পে গতি আনতে ইআরডি, পরিকল্পনা কমিশন দফায় দফায় বৈঠক করে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সঙ্গে। এসব বৈঠকে অর্থ আটকে থাকার বিভিন্ন কারণ চিহ্নিতও করা হয়; নেওয়া হয় নানা ধরনের উদ্যোগ।

পাইপলাইনের আকার বেড়ে যাওয়ার কারণ অনুসন্ধানে ইআরডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিদেশি সহায়তার ব্যবহার পরিস্থিতি সঙ্কটময় অবস্থায় রয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতিই এর কারণ। এর ফলে লেনদেন ভারসাম্য চাপে পড়ছে।

সহায়তা ছাড়ে গতি না আসার ১৩টি কারণ উঠে এসেছে প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়েছে, অনেক সময় সঠিক পরিকল্পনা না করেই প্রকল্প তৈরি করা হয়। ফলে কাজ শুরুর আগেই প্রকল্পের প্রস্তাবনা (ডিপিপি) সংশোধন করতে হয়। অনুমোদনে দীর্ঘসূত্রতার কারণে সহায়তা ছাড়ে বাড়তি সময় লাগে। অনেক ক্ষেত্রে উপযুক্ত জনশক্তি নিয়োগ দেওয়া হয় না। আবার মাঝ পর্যায়ে জনশক্তির কর্মস্থল বদল করা হয়ে থাকে।

ক্রয় প্রক্রিয়া বিশেষ করে ভূমি অধিগ্রহণে বাড়তি সময় লাগায় কাজ আটকে থাকে বলে প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। বেশ কয়েকটি খাত নিয়ে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পে সমন্বয়ের অভাবও দেখা গেছে। দাতা সংস্থার পক্ষ থেকেও অনেক সময় ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন, চুক্তি সম্পাদন, ক্রয় প্রস্তাব ও ঠিকাদার অনুমোদন, পরামর্শক নিয়োগ ও অর্থছাড়ে সময়ক্ষেপণ করা হয় বলে প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এ ছাড়া কঠিন শর্ত ও দাতাদের নিয়মিত তদারকির কারণে বৈদেশিক সহায়তার ওপর আগ্রহ হারাচ্ছে বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলো।

এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, দাতা সংস্থাগুলোর স্থানীয় অফিসের কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন, অর্থছাড়সহ বিভিন্ন সিদ্ধান্ত আসে সংস্থার সদর দফতর থেকে। এ কারণে কিছুটা দেরি হয়। তবে ঋণচুক্তির পর বাস্তবায়নে অদক্ষতার কারণেই অর্থছাড়ে বিলম্ব হচ্ছে বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads