• বুধবার, ৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪২৯

ব্যবসার খবর

বিদেশি বিনিয়োগে পিছিয়ে

এশিয়ায় মিয়ানমারসহ প্রতিবেশীরা এগিয়ে

  • মোহসিন কবির
  • প্রকাশিত ১৮ জানুয়ারি ২০২১

কোনো দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) একটি শক্তিশালী চালিকাশক্তি হিসেবে ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর মূলধন বাড়ানো, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, উৎপাদন বৃদ্ধি, ব্যবস্থাপনাগত উন্নয়ন ও প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতায় বৈদেশিক বিনিয়োগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিদেশি বিনিয়োগ তেমন অবদান রাখতে পারছে না। করোনা মহামারীর আগে ৮ দশমিক ১ শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করলেও সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণে রীতিমতো লড়াই করতে হচ্ছে। ২০১৯ সালে জিডিপিতে বৈদেশিক বিনিয়োগের অবদান ছিল মাত্র শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ যা এশিয়ায় সর্বনিম্ন। অথচ ২০১৭ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে সে বছরই সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ আসে দেশে। বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের দৌড়ে  প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় গত এক দশকে অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছে বাংলাদেশ।

বিশ্বব্যাংকের সমীক্ষা বলছে, প্রতিবেশী মিয়ানমার, ভারত, শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনাম বিদেশি বিনিয়োগ পাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের তুলনায় অনেকদূর এগিয়েছে। এমনকি যে পাকিস্তান এতদিন বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে ছিল, ২০১৯ সালে তারাও বাংলাদেশকে টপকে গেছে। এসব দেশ বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্টের জন্য ট্যাক্স কমিয়ে আনা, নিয়ন্ত্রণমূলক নীতি থেকে সরে এসে সহজ শর্ত আরোপ এবং উন্নত প্রাতিষ্ঠানিক মান নিশ্চিত করাসহ অবকাঠামোগত নানা সুযোগ-সুবিধা প্রদান করেছে। বিপরীতে বাংলাদেশ বিদেশি বিনিয়োগকারীদের এসব সুযোগ-সুবিধা দিতে না পারায় ক্রমেই বৈদেশিক বিনিয়োগে উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি হয়নি।

বিশ্বব্যাংকের ২০১৯ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতিবেশী মিয়ানমারের অর্থনীতিতে বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে জিডিপিতে অবদান ৫ শতাংশের কাছাকাছি, যেখানে বাংলাদেশে মাত্র শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ। এছাড়া ভিয়েতনামের ৬ শতাংশ, ভারতের ২ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়ার ২ শতাংশের কিছুটা উপরে এবং শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান একটু উপরে অবস্থান করছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৭ সালে ২ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন, ২০১৮ সালে ২ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন, ২০১৯ সালে ৩ দশমিক ৮৯ বিলিয়ন এবং ২০২০ সালের জুন-জুলাই পর্যন্ত ২ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ আসে দেশে। করোনা মহামারীর কারণে শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের শিকার প্রায় প্রতিটি দেশই। সে হিসাবে বিগত বছরগুলোর তুলনায় ২০২০-এ বিনিয়োগের পরিমাণ বেড়েছে। তবে এর অন্যতম কারণ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের অর্থনৈতিক যুদ্ধ। যার ফল কিছুটা পেয়েছে বাংলাদেশ। ২০১৯ সালে বাংলাদেশে মোট বিনিয়োগের ৩০ শতাংশ বিনিয়োগ করে চীন। এর পরেই ইউরোপের দেশ নেদারল্যান্ডস ২১ শতাংশ এবং যুক্তরাজ্য ৯ শতাংশ বিনিয়োগ করে। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, চীন-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার বাণিজ্যযুদ্ধের সুবিধা আরো বেশি নিতে পারতো বাংলাদেশ। কিন্তু নানা কারণে সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে দেশ। তাদের মতে, বাংলাদেশ বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে পিছিয়ে থাকার পেছনে বেশকিছু মৌলিক কারণ রয়েছে। প্রথমত পলিসিগত জটিলতা অর্থাৎ ঘনঘন পলিসি পরিবর্তন করা। দ্বিতীয়ত আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, তৃতীয়ত উন্নত দেশগুলোর সাথে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি সুবিধা না থাকা, চতুর্থত জোটভুক্ত না থাকা। পাশাপাশি অবকাঠামোগত দুর্বলতাও এক্ষেত্রে অন্যতম কারণ। এসব কারণে বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে বাংলাদেশ।

অর্থনীতিবিদ এম এ মজিদ দৈনিক বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার রাখাইন প্রদেশসহ দেশটির বিভিন্ন অঞ্চলে চীনকে বিনিয়োগের ব্যাপক সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে। এছাড়া দেশটি আসিয়ানের সদস্য। ফলে তারা সদস্য দেশগুলো থেকে বিনিয়োগ পাচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশ সার্ক ছাড়া আর কোনো আঞ্চলিক কিংবা আন্তর্জাতিক জোটভুক্ত হতে পারেনি। ফলে জোটভুক্ত দেশগুলো থেকে বাণিজ্যিক একটা সুবিধা পাওয়ার যে সম্ভাবনা তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছি আমরা। আবদুল মজিদ বলেন, বিদেশি বিনিয়োগের অন্যতম বাধা হচ্ছে নীতি স্থিতিশীলতা। তিনি বলেন, আমাদের দেশে ঘনঘন পলিসি পরিবর্তন করা হয়। যে কারণে বিনিয়োগকারীরা আস্থা পান না বিনিয়োগে। ঘনঘন নীতি পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পারার শঙ্কায় অনেকে বিনিয়োগে ভরসা পান না। বাংলাদেশের সমসাময়িক অর্থনীতির দেশ ভিয়েতনামও বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্টে এগিয়ে গেছে অনেকদূর। আবদুল মজিদ বলেন, দেশটি ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) করার পাশাপাশি চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডসহ ১৫টি দেশ নিয়ে গঠিত বিশ্বের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য চুক্তি ‘রিজিওনাল কমপ্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ’-এর সদস্য হওয়ায় এসব দেশ থেকে বড় ধরনের বাণিজ্য সুবিধা পাচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশ একমাত্র সার্ক ছাড়া আর কোনো জোটের সদস্য হতে পারেনি। আর সার্ক থাকলেও ভারতের কারণে সেটি অচল। পাশাপাশি সার্কভুক্ত দেশগুলো থেকে বড় ধরনের বিনিয়োগ আশা করা যাবে না। কারণ এসব দেশের অর্থনীতি ততটা শক্তিশালী নয়। একমাত্র ভারত অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হলেও দেশটি বাংলাদেশে বিনিয়োগ সঙ্গত কারণেই করবে না।

অর্থনীতিবিদ আবদুল মজিদ বলেন, ‘বাংলাদেশকে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে হলে স্থায়ী পলিসি গ্রহণের পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দেশগুলোর সঙ্গে জোটভুক্ত হওয়া, বিভিন্ন দেশের সঙ্গে স্থায়ী সুসম্পর্ক গড়ে তোলা, অবকাঠামোগত উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা নিরসনসহ সর্বোপরি উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করার ওপর তাগিদ দেন।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads