• সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪২৯
ভালো থাকুন বাংলার বুলবুল

আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল

সংলক্ষিত ছবি

আনন্দ বিনোদন

ভালো থাকুন বাংলার বুলবুল

  • প্রকাশিত ২৩ জানুয়ারি ২০১৯

রোমানা মোর্শেদ কনক চাঁপা

আমাদের আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল আসলে বাংলার বুলবুল। একাধারে তিনি ছিলেন শক্তিমান লেখক, সুরস্রষ্টা এবং সঙ্গীত পরিচালক। গানের জগতে তিনি ছিলেন সব্যসাচী। সারা জীবন তিনি গান নিয়ে গবেষণা করেছেন। আঞ্চলিক সুর থেকে শুরু করে আরব্য পারস্য ভারতীয় স্পেনীয় সুর নিয়ে নাড়াচাড়া করে তার সঙ্গে নিজের ভালোবাসা মিশিয়ে সুরের আবহ তৈরি করেছেন। তার গানে প্রেম, বিরহ, কটাক্ষ, অনুরাগ, দেশপ্রেম, শিশুর সারল্য, সামাজিক নাটকীয়তা, বিদ্রোহ চাহিবামাত্রই পাওয়া যেত। তাই ছবির গানের ফরমায়েশি জগতে তার কদর ছিল আলাদা। তার সবচেয়ে বড় সুবিধা ছিল নিজেই গান লিখতেন। তাই সুর আরো সুন্দর করে বসে যেত। মনে হতো এই গানের সুর ও কথা একসঙ্গেই যমজ হয়ে জন্ম নিয়েছে! তিনি আসলে একজন স্বভাব-কবি ছিলেন। মুখে মুখে গান বানানোর অসম্ভব দক্ষতা তার ছিল। একই সঙ্গে নিজের সৃষ্টিকে অবহেলা করার দারুণ স্পর্ধাও ছিল। গান রেকর্ড হয়ে গেলে সে লেখা তিনি ছিঁড়ে ফেলতেন। আমরা আপত্তি জানালে বলতেন— আমার গান আমি কেন সংগ্রহ করব। গান ভালো হলে কালের প্রবাহেই তা জমা থাকবে।

ব্যক্তিগত জীবনে বোহেমিয়ান টাইপ মানুষটা নিজের জন্য কিছুই করেননি। গান গান গান করেই জীবন পার করলেন। জীবনের প্রথম দিকে বেহালা গিটার বাজাতেন, মাঝবয়সে এসে সেগুলোকেই আবার নতুন করে শেখার জন্য কী প্রচেষ্টাই না ছিল তার! কিন্তু নিজেকে আরো জ্ঞানের গভীরে নিতে নিজেই নিজের শিক্ষক ছিলেন।

অসম্ভব সাহসী কিশোর মুক্তিযোদ্ধা সারা জীবন তার গানে অপার দেশপ্রেম, দ্রোহ, প্রতিবাদ তুলে ধরেছেন। ছবির গানেও তিনি নিজে বায়না করে দেশের গান ঢোকাতেন। ভালো কণ্ঠের জন্য তিনি শিল্পী খুঁজে বেড়াতেন আজীবন। আমাকে তিনিই খুঁজে বের করেছিলেন। ’৯২ সালের কথা, একটা অনুষ্ঠানে কণ্ঠশিল্পী শাকিলা আপা বললেন, ‘কনক, বুলবুল ভাই তোকে খুঁজছেন, তাড়াতাড়ি যোগাযোগ কর।’ এরপর উনিই আবার ফোন দিলেন। পয়লা গান ছিল ‘সাদা কাগজ এই মনটাকে তোমার হাতে তুলে দিলাম’। মিলু ভাইয়ের সঙ্গে ডুয়েট। সেদিনই বুলবুল ভাই বললেন, ‘ভাবী, ইনশাল্লাহ অনেক গান হবে, আপনাকে এমন জায়গায় নিয়ে যাব যে কখনো পেছনে তাকাতে হবে না!’ সত্যিই সেদিন থেকে আমার আর অবসর ছিল না। বুলবুল ভাই মাসে গড়ে প্রায় দশটি ছবি হাতে নিতেন এবং তার বেশিরভাগের গান আমাকে দিয়েই গাওয়াতেন। নিজে অনেক গবেষণা করতেন কিন্তু গানের কণ্ঠের ব্যাপারে নির্ভরশীল হতে চাইতেন। এরপর আসলেই আমাকে পেছনে তাকাতে হয়নি। প্রায় প্রতিটি গানই মাইলফলক হয়ে যাচ্ছিল। তার গানেই প্রায় সব পুরস্কার পাওয়া আমার! তার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।

কদিন আগে তিনি যখন অসুস্থ হলেন, খোঁজ নিতে ফোন দিলাম। তখন গানপাগল মানুষটা সব কথা বাদ দিয়ে বললেন, ‘ভাবী, অনেক সাধনার পরে গানটি ধরেন তো!’ আমি ভ্যাবাচেকা খেতেই আমার হাজবেন্ড বললেন— গাও। আমি আরো বিপদে পড়তেই বুলবুল ভাই গানটি নিজেই শুরু করলেন। আমি তার সঙ্গে গলা মিলিয়ে পুরো গানটি গাইলাম! হঠাৎ উনি আমাকে অনেক দোয়া করলেন! আমি হকচকিয়ে গেলাম। এটাই আমার উনার সঙ্গে শেষ কথা। পরিচয়ের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত উনার দোয়া পেয়ে গেলাম, সঙ্গে পেলাম অসংখ্য অনবদ্য গান, যা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন। কী দিয়ে আমি তার ঋণ শোধ করি আমি আসলেই জানি না! আমার গান ‘প্রেমের তাজমহল’ উনাকে প্রথমবারের মতো জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্তির সম্মান এনে দিয়েছিল। এটা আমার একটি গর্বের অনুভব বটে।

আমি বিশ্বাস করি, আমরা পুরো জাতি ধন্য যে আমাদের একজন ‘আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল’ আছেন। আরেকটি কথা আমি উচ্চকণ্ঠে বলতে চাই, ‘সব কটা জানালা খুলে দাও না’ এই গানটি ছাড়া আর যদি কোনো গানই সুর না করতেন, তাহলেও বাংলাদেশ তার কাছে সমান কৃতজ্ঞ থাকত।

আমি এই সব্যসাচী সঙ্গীতজ্ঞের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের জন্য সমবেদনা জানাচ্ছি। আল্লাহ উনাকে ওপারে শান্তি দিন। আমিন।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads