ছোটবেলায় পাঠসূচিতে উপদেশমূলক এই বাক্য পড়েননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া সত্যিই কঠিন। স্বাস্থ্য ভালো থাকলে মানুষ আনন্দচিত্তেই তার নিত্যদিনের সব কাজ করতে পারে। কেননা শরীরের সঙ্গে মনের সম্পর্ক ওতপ্রোত। ফলে স্বাস্থ্য ভালো থাকা মানে মন ভালো থাকা। যে কোনো কিছুতে উৎসাহ বোধ করা।
স্বাস্থ্য নিয়ে এসব বলার পেছনে কারণটা এবার খোলাসা করা যাক। বিশ্বে স্বাস্থ্য সম্পর্কিত একটি দিবস রয়েছে। এটা হয়তো আমরা অনেকে জানি। একটু পেছনে তাকালে দেখা যাবে, ১৯৪৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাতিসংঘ অর্থনীতি ও সমাজ পরিষদ আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যক্ষেত্রের অগ্রগতি প্রসঙ্গে সম্মেলন আহ্বানের সিদ্ধান্ত নেয়। সে বছর জুন ও জুলাই মাসে আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সে সম্মেলনেই ওয়ার্ল্ড হেল্থ অরগানাইজেশন বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাংগঠনিক আইন গৃহীত হয়। এর দুই বছর পর ১৯৪৮ সালের ৭ এপ্রিল এই সংস্থার আইন আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যকর শুরু হয়। পাশাপাশি বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস হিসেবে পালনের জন্য ৭ এপ্রিলকে নির্ধারণ করা হয়। এরপর থেকে প্রতি বছর সারা বিশ্বে পালিত হয়ে আসছে বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস।
বাংলাদেশও ব্যতিক্রম নয়। আমাদের দেশেও প্রতি বছর নানা আয়োজনে দিবসটি পালন করা হয়; এবারো হচ্ছে। মূলত বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের উদ্দেশ্য হলো মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি করা। এখন প্রশ্ন, আমরা কতটা স্বাস্থ্যসচেতন। উচ্চশিক্ষিত কিছু মানুষ হয়তো স্বাস্থ্যসচেতন। কিন্তু আমরা অধিকাংশই স্বাস্থ্যসচেতন নই। এর নানা কারণ বিদ্যমান। প্রধান কারণ মূলত অশিক্ষা ও দারিদ্র্য। এ দুটি মৌলিক এবং অবশ্যই বাস্তবিক কারণ আমাদের সিংহভাগ জনসংখ্যার স্বাস্থ্য সচেতনতার অন্তরায় হয়েছে। কোন বয়সের পর কোন চিকিৎসাটা জরুরি তা আমরা অনেক সচেতন মানুষও হয়তো সেভাবে জানি না। এটা একাধারে আমাদের অজ্ঞতা এবং অবহেলাও। প্রতি বছর আমরা এই দিবস এলে আলোচনায় মেতে উঠি। অনুষ্ঠিত হয় সভা, সেমিনার ইত্যাদি। হয় অর্থের অপচয়। তারপর বেমালুম ভুলে যাই। অথচ আমরা জানিই না সুচিকিৎসা পাওয়া প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার, যা আমাদের সংবিধানের মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয়েছে।
এটা সত্য যে, বিগত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ স্বাস্থ্য খাতে অনেক সাফল্য দেখিয়েছে। বিশেষ করে সংক্রামক রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে সফলতা প্রভূত। এমন একটা সময় ছিল যখন হাম, বসন্ত, কলেরা, প্লেগে গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়েছে। সেই কঠিন সময় আমরা অনেক আগেই পার করে এসেছি। হাম, বসন্ত, কলেরা ও প্লেগ এখন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে। এমনকি পোলিও নির্মূল হয়েছে অনেক আগেই। ডায়রিয়ার ক্ষেত্রেও আমাদের ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখের দাবি রাখে। বলার অপেক্ষা রাখে না, ওরস্যালাইন এক যুগান্তকারী উদ্ভাবন; আর এর কৃতিত্ব বাংলাদেশের। উন্নত কোনো দেশে হলে নিশ্চিত নোবেল মিলত। অথচ আমরা ভেবেও দেখি না, অত্যন্ত সরল এক সমাধান সারা বিশ্বের প্রতিনিয়ত অযুত-নিযুত মানুষের জীবন বাঁচাচ্ছে। এ যেন এক জাদুকরী অবদান। এছাড়া সফলতা এসেছে মা ও শিশুর মৃত্যুর ক্ষেত্রেও। আগের তুলনায় মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার অনেকাংশে কমে এসেছে।
আবার বিপরীত চিত্রও রয়েছে। বতর্মান সময়ে আমাদের দেশে অসংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দিনকে দিন বেড়ে চলেছে; যা রীতিমতো আশঙ্কার, আতঙ্কের। বিশেষ করে ডায়াবেটিস, হূদরোগ, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ, পক্ষঘাতগ্রস্ততা, কিডনি রোগ, অটিজম ও মানসিক রোগীর সংখ্যা মাত্রাতিরিক্ত। এসব অসংক্রামক জটিল রোগের ক্ষেত্রে প্রয়োজন রোগ সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা। আর যেসব রোগ প্রতিরোধযোগ্য, সেসব রোগাক্রান্ত ব্যক্তিকে সমন্বিত চিকিৎসা প্রদানের মাধ্যমে সুস্থ করে তোলা; এজন্য প্রয়োজন সমন্বিত চিকিৎসাব্যবস্থা।
শুধু চিকিৎসকের দিকে তাকিয়ে না থেকে একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার জন্য কয়েকটি বিষয়ের ওপর নিবিড়ভাবে লক্ষ্য রাখার প্রয়োজনকে উপেক্ষা করা যাচ্ছে না। নিজে অবগত থাকা এবং অন্যকে সে সম্পর্কে অবগত করাও একজন সুনাগরিকের কর্তব্য। কারণ আমরা অস্বীকার করতে পারি না অসুস্থ নাগরিক কেবল নিজের পরিবারের নয়, দেশেরও বোঝা। এজন্য আত্মসচেতনতার পাশাপাশি সমাজ সচেতনতার মাধ্যমেই কেবল সম্ভব বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের মূল লক্ষ্যের বাস্তবায়ন। নাগরিক হিসেবে আমাদের যেমন দায়িত্ব রয়েছে, তেমনি সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়েরও রয়েছে কিছু বাড়তি দায়িত্ব। সরকার বিভিন্ন সময় মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নানা ধরনের পদক্ষেপ নিয়ে থাকে। সেসব সেবা মানুষের নাগালে পৌঁছে দেওয়ার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবার উন্নতি ও তা নিশ্চিত করার জন্য গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের উদ্যোগ মন্ত্রণালয়কেই নিতে হবে। বাস্তবতা হলো, আমরা এখনো সবাই অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী নই। অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা সুলভ করার বিকল্প নেই। চিকিৎসাসেবা এবং ওষুধ বিনামূল্যে প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে পারলে তা হবে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
তবে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে উন্নতির সঙ্গে চিকিৎসকদের ভূমিকা বিশেষভাবে জড়িত। কিন্তু তারা কতটা রোগীবান্ধব তা নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ থেকেই যায়। সময় নিয়ে রোগী না দেখা, অকারণে পরীক্ষা করানো এবং অপ্রয়োজনীয়ভাবে একগাদা ওষুধ দেওয়া নিয়ে নিয়ত সমালোচিত হলেও তারা ভ্রূক্ষেপহীন। পাশাপাশি রোগ নির্ণয়ে তাদের ব্যর্থতা, ভুল চিকিৎসা দিনকে দিন দেশের চিকিৎসকদের প্রতি মানুষকে বীতশ্রদ্ধ করে তুলছে। ফলে মানুষ বাধ্য হচ্ছে পরনির্ভরতায়।
ছুটছে ভিন দেশে। অথচ এর ফলে আমরা কেবল আমাদের চিকিৎসক, চিকিৎসাব্যবস্থা এবং দেশের ভাবমূর্তিকে অনুজ্জ্বল আর কলঙ্কিত করছি না; বরং প্রতিনিয়ত বিপুল পরিমাণ মুদ্রা হারাচ্ছি, যা চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে।
একটি দেশের উন্নয়নের সঙ্গে জড়িত নানা অনুষঙ্গ। এখানে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা খাত। যদিও আমরা ভেবেও দেখি না এটা আজ বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প খাত। এর বার্ষিক টার্নওভার মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো। এখানে কেবল দক্ষ এবং সুচিকিৎসকই নয়, প্রয়োজন বিভিন্ন পেশাদার কর্মী, যাদের থাকবে আধুনিক শিক্ষা আর কাজের মাধ্যমে অর্জিত দক্ষতা। পাশাপাশি প্রয়োজন নিয়মিত গবেষণা। আরো একটি পূর্বশর্ত থেকেই যায়, ওষুধের দাম ও মান নিয়ন্ত্রণ। প্রতিটি শর্ত সঠিকভাবে পূরণ করতে পারলে, কোনো সন্দেহ নেই চিকিৎসাসেবা শিল্প খাত অর্জন করবে যথার্থ স্বয়ংসম্পূর্ণতা।
সেরা প্রতিষ্ঠান, সেরা গবেষণা, সেরা চিকিৎসক এমনকি চিকিৎসাসেবা প্রদানকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রথা প্রচলনের মাধ্যমে উৎসাহিত করতে পারলে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন অসম্ভব হবে না। উপরন্তু বিশ্বব্যাপী পরিচিতি আর খ্যাতি। বিদেশি মুদ্রার সাশ্রয়ই কেবল হবে না; বরং অন্য দেশের মানুষকে বাংলাদেশে চিকিৎসাসেবা প্রদানের মাধ্যমে সম্ভব হবে বিদেশি মুদ্রা আয়। এসব বিষয় নিয়ে ভাবার, গঠনমূলক পদক্ষেপ গ্রহণের সময়, বলাই বাহুল্য, সমাগত। এবারের বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস থেকে হোক সেই নতুন দিনের সূচনা।
লেখক : সাংবাদিক
Shahadatrana31@gmail.com