• মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪২৯

ফিচার

স্মরণে মুর্তজা বশীর

  • সালেহীন বাবু
  • প্রকাশিত ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২০

এক মাস হলো তিনি আমাদের মাঝ থেকে বিদায় নিয়েছেন। তারপরও তার অভাব প্রতিনিয়ত অনুভূত হচ্ছে। যিনি নিজের খ্যাতির পেছনে কখনো ছোটেননি। নিজেকে বিখ্যাত করতেও চাননি। বরং নিজেকে সমৃদ্ধ করেছেন সম্মানের আসনে। তিনি মুর্তজা বশীর। বাংলাদেশের একজন মেধাবী এবং শক্তিমান চিত্রশিল্পী ছিলেন তিনি। দেশভাগের পরপরই শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, সফিউদ্দিন আহমেদ প্রমুখ মিলে আর্ট কলেজ প্রতিষ্ঠা সামনে রেখে চারুকলা আন্দোলন শুরু করেছিলেন। সেই সময় দ্বিতীয় ব্যাচের ছাত্র ছিলেন মুর্তজা বশীর।

সেই সময়ে শিল্পীদের জীবন একেবারে দুঃখে ভরা, হতাশায় ভারাক্রান্ত। শিল্পীদের পেশা, তাদের সামাজিক অবস্থান- সবকিছুই যেন অবহেলিত। সেই সময়ের মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে মুর্তজা বশীর একজন শিল্পানুরাগী ছাত্র আর্ট কলেজে ভর্তি হয়েছেন, এ ব্যাপারটা এখনকার দিনে কল্পনা করা অনেকটাই কঠিন।

মুর্তজা বশীরের বাবা বিখ্যাত ভাষাবিদ, বুদ্ধিজীবী ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌। তিনি বলেছিলেন, এমন একটি অনিশ্চয়তার জীবন কেন বেছে নিচ্ছ! আমরা তো একেবারে মধ্যবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার, একটা পেশা তো তোমাকে জোগাড় করতে হবে। ছবি এঁকে তো তুমি বাঁচতে পারবে না।

সেই সময় নানা প্রতিকূলতার মধ্যে কাজ করে সমাজে শিল্পী হিসেবে মুর্তজা বশীর নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন। এই শিল্প-সংগ্রামে তিনি ছিলেন একজন সাহসী যোদ্ধা।

ঢাকা আর্ট কলেজের চর্চা শেষ করে তিনি ছবি আঁকার ওপর উন্নততর অভিজ্ঞতার জন্য ইউরোপে গেলেন। ইতালিতে ছিলেন। কিছুদিন ফ্রান্সে ছিলেন। সেখান থেকে ফিরে এসে তিনি যে ধরনের ছবি আঁকলেন, এতে স্বাভাবিকভাবেই ইউরোপের চিত্রচর্চার প্রভাব তার কাজে প্রকাশ পেল।

মুর্তজা বশীর দেশকে প্রচণ্ড  ভালোবাসতেন। নিজের দেশের সংস্কৃতির প্রতি তার অগাধ ভালোবাসা ছিল। জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসানরা যে দেশকে নিয়ে ভাবছেন, ছবি আঁকছেন- সেগুলো মুর্তজা বশীরদের নানাভাবে প্রভাবিত করেছে।

মুর্তজা বশীর তার নিজের জীবন এবং চিত্রকলা চর্চায় দেশ ও মানুষকে নিয়ে ভাবতেন। মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধে শহীদদের স্মরণে তার আঁকা ‘এপিটাফ ফর মার্টার্স’ সিরিজের ছবিগুলো বাংলাদেশের শিল্পকলার ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবে। এ ছাড়া তার আঁকা বিখ্যাত ছবি সিরিজ ও চিত্রমালার মধ্যে ‘ট্রান্সপারেনসিজম’, ‘জ্যোতি’, ‘ডিজায়ার’, ‘ইটারনিটি’, ‘কান্তোজ’, ‘ওয়েভ’, ‘ইরাপশান’ সিরিজ অন্যতম।

পাঁচ বছর আগে নিজের জন্মদিন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে এই গুণী বলেছিলেন,‘হূদয়ের রক্তক্ষরণ বন্ধ হলে শিল্পী আর শিল্পী থাকে না। আমি এখন যখন কাজ করি, তখন আমি প্রাণমন ঢেলে দিয়ে কাজ করি। আমার মনে হয়, হয়তো এটিই আমার শেষ কাজ। মৃত্যুর পরে যদি আমাকে মনে রাখা হয়, তাহলে তা হবে আসল ভালোবাসা।’

ব্যক্তি ও শিল্পীজীবনে বর্ণাঢ্য এক সময় পার করেছেন মুর্তজা বশীর। বিমূর্ত চিত্রকলা নিয়ে ২০১৪ সালে এক সাক্ষাৎকারে বলছিলেন, সমাজের প্রতি আমার যে দায়বদ্ধতা, যে অঙ্গীকার তার ফলে সম্পূর্ণ বিমূর্ত ছবি আঁকার কোনো তাগিদ অনুভব করিনি। সম্পূর্ণ বিমূর্ত ছবি একজন শিল্পীর মনোজগৎ, তার চিন্তাভাবনা, তার আনন্দ, সেখানে যা সে সৃষ্টি করছে। কিন্তু যেহেতু সমাজের প্রতি আমার অঙ্গীকার রয়েছে, বিমূর্ত চিত্রকলা ভালো লাগলেও বিমূর্ত চিত্রকলা আঁকার জন্য কোনো তাগিদ বোধ করিনি।

এরপর অবশ্য বিমূর্ত চিত্রকলা নিয়ে বিস্তর ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাকে ধরা হয় বাংলাদেশে বিমূর্ত ধারার চিত্রকলার অন্যতম পথিকৃৎ। ‘দেয়াল’, ‘শহীদ শিরোনাম’, ‘পাখা’, ‘রক্তাক্ত ২১ শে’ শিরোনামের চিত্রকর্মগুলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। পেইন্টিং ছাড়াও ম্যুরাল, ছাপচিত্রসহ চিত্রকলার বিভিন্ন মাধ্যমে কাজ করেছেন তিনি। এ ছাড়া লিখেছেন বই এবং গবেষণা করেছেন মুদ্রা ও শিলালিপি নিয়েও। বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য দেয়ালচিত্রও করেছেন তিনি। ছোটগল্প, উপন্যাস লেখার পাশাপাশি চলচ্চিত্রেও তার অবদান রয়েছে।

২০১৪ সালের একই সাক্ষাৎকারে নিজেকে ‘সমাজসচেতন’ উল্লেখ করে বলেন, ‘আমি একজন সমাজসচেতন শিল্পী হিসেবে এবং মার্কসবাদে বিশ্বাসী হিসেবে আমি বিশ্বাস করি, আগামীর একটা সুন্দর দিন আছে। কিন্তু পত্রিকায় দেখা যাচ্ছে মানুষ হতাশায়, তাই একজন সমাজসচেতন শিল্পী হিসেবে আমার কর্তব্য দাঁড়াল মানুষকে এই হতাশা থেকে মুক্তি দেওয়া। তখন আমার মাথায় এলো প্রজাপতির খুব ক্ষণিকের জীবন, কিন্তু খুব ভাইব্রেন্ট, জীবন্ত, লাফাচ্ছে এবং তার ডানায় নানা রকম আলো। আমি প্রজাপতি, আমার এখানে আছে প্রজাপতির কালেকশন (ঘরে টাঙানো ছবিগুলোকে ইঙ্গিত করে), আমি প্রজাপতির পাখায় যা আছে, হুবহু আঁকলাম। এটার নাম হলো ‘দ্যা উইং’, পাখা, ডানা। এভাবেই আমার কাজ এখন পর্যন্ত করছি।

চিত্রকলায় গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ১৯৮০ সালে একুশে পদক পান মুর্তজা বশীর, স্বাধীনতা পুরস্কার পান ২০১৯ সালে। কর্মজীবনে তিনি দীর্ঘদিন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

মুর্তজা বশীরের গুণের কোনো শেষ নেই। তিনি মানুষ হিসেবে যেমন ছিলেন, তেমনি অসাধারণ ছিলেন সংগঠক হিসেবে। বাংলাদেশের চিত্রকলা চর্চা এবং সাহিত্যে তার কাজ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। সে সঙ্গে তার জীবনাচরণ ও কর্ম যুগ যুগ ধরে প্রেরণা জোগাবে বাংলাদেশের মানুষকে।

‘মৃত্যুর পরে যদি আমাকে মনে রাখা হয়, তাহলে তা হবে আসল ভালোবাসা, এমন কথা বললেও দেশের শিল্প সমঝদাররা মনে করেন একজীবনে এত এত কীর্তি রেখে গেছেন মুর্তজা বশীর, মহাকালে তার স্থান অনন্য হয়ে থাকবে। বিনম্র শৃদ্ধা হে গুণী। আপনার অভাব পুষিয়ে নেওয়ার নয়।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads