• শুক্রবার, ৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪২৯

সরকার

দু’পক্ষের অনড় অবস্থানে দ্বিধাবিভক্ত মুসল্লিরা

বিশ্ব ইজতেমা নিয়ে অস্বস্তি সরকারে

  • আজাদ হোসেন সুমন
  • প্রকাশিত ০৮ ডিসেম্বর ২০১৮

বাংলাদেশে তাবলিগ জামাত নিয়ে বিবদমান দুই পক্ষের অনড় অবস্থানের কারণে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ছেন সাধারণ মুসল্লিরা। অবস্থা দিন দিন প্রকট আকার ধারণ করছে। গত বছর শুরু হওয়া বিতর্কে মাওলানা সা’দ ও মাওলানা যোবায়ের গ্রুপ এ পর্যন্ত একাধিকবার সংর্ঘষে লিপ্ত হয়েছে। এ নিয়ে বিব্রত অবস্থায় পড়েছে ক্ষমতাসীন সরকারের নীতিনির্ধারক মহল। উভয়পক্ষের এ টানাপড়েনের গ্যাঁড়াকলে পড়ে সরকার টঙ্গীতে অনুষ্ঠিতব্য বিশ্ব ইজতেমা স্থগিত করেছে। স্পর্শকাতর বিষয় হওয়ায় নির্বাচনের আগ মুহূর্তে কোনো পক্ষকে ঘাঁটাতেও চাইছে না সরকার। সর্বশেষ গত ১ ডিসেম্বর টঙ্গিতে জোড় ইজতেমা আয়োজনকে কেন্দ্র করে সা’দ ও যোবায়েরপন্থিরা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। সংঘর্ষে ইসমাইল মণ্ডল (৬৫) নামে এক মুসল্লি নিহত হন। এর আগে কাকরাইলে সংঘর্ষে নিহত হন ২ জন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দুই-তিন বছর আগের দেওয়া সা’দ কান্দলভির বক্তব্যকে কেন্দ্র করে তাবলিগে এই বিভক্তি দেখা দেয়। ভারতে একটি অনুষ্ঠানে সা’দ কান্দলভি বলেন, তাবলিগ জামাতে কিছু সংস্কার হওয়া প্রয়োজন। ওয়াজ মাহফিল ও মিলাদসহ ধর্মীয় শিক্ষা বা ধর্মীয় প্রচারণা অর্থের বিনিময়ে করা উচিত নয়। মাদরাসাগুলোর শিক্ষকদের মাদরাসার ভেতরে নামাজ না পড়ে মসজিদে এসে নামাজ পড়া উচিত, যাতে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ে।

তার এ বক্তব্যের ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়ে মাওলানা যোবায়ের গ্রুপ অভিযোগ করে বলে, সা’দ কান্দলভি যা বলছেন তা তাবলিগ জামাতের প্রতিষ্ঠাতা নেতাদের নির্দেশিত পন্থার বিরোধী। তারা কান্দলভির কথাবার্তা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের বিশ্বাস ও আকিদার বাইরে।

পক্ষে-বিপক্ষে ব্যাখ্যা নিয়ে দুই পক্ষ বিতর্কে জড়িয়ে পড়লে গত বছরের ইজতেমায় নজিরবিহীন ঘটনা ঘটে। সা’দ কান্দলভি বিশ্ব ইজতেমায় যোগ দিতে ঢাকায় আসেন। বিরোধীরা সড়ক অবরোধ করে রাস্তাঘাট অচল করে দেয়। তীব্র প্রতিরোধের মুখে তিনি গত বছর এসেও ইজতেমা প্রাঙ্গণে যেতে পারেননি। তিনি কাকরাইল মসজিদে অবস্থান নেন এবং পরে কাকরাইল থেকেই দিল্লি ফিরে যান।

যেভাবে তাবলিগ জামাতের আমির হন মাওলানা সা’দ : খলিফা নির্বাচনের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর ফারুক (রা.) ছয়জনের এক শুরা বানিয়েছিলেন পরবর্তী খলিফা নির্বাচনের জন্য। সেই শুরাই পরামর্শ করে হজরত ওসমান গনিকে (রা.) তৃতীয় খলিফা নির্বাচন করে। ইনায়মুল হাসানও (রহ.) একইভাবে তাবলিগ জামাতের পরবর্তী আমির নির্ধারণ করার জন্য দশজনের শুরা বানিয়ে যান। ইনায়মুল হাসান (রহ.) ‘হজরতজি’ নামেও অভিহিত। তার ইন্তেকালের পর প্রায় ১৮ বছর তাবলিগের  মেহনত মোটামুটি সুষ্ঠুভাবে চলছিল। এ সময় হজরত যোবায়রুল হাসান ও হজরত সা’দ পালাক্রমে ফয়সালা দিতে থাকেন। যারা হজরত যোবায়রুল হাসানের জীবদ্দশায় বিশ্ব ইজতেমার সময়ে মুশাওয়ারায় উপস্থিত ছিলেন তারা দেখেছেন সেখানে কীভাবে ফয়সালা হতো।

তাবলিগ জামাত সূত্রে জানা যায়, পরামর্শের সময় দু’জন দুদিকে বসতেন। হজরত সা’দ সাহেব ‘তাকাজা’ ঢালতেন, সাথীরা রায় দিতেন। হজরত যোবায়রুল হাসান ফয়সালা দিতেন। এরপর হজরত যোবায়ের (রহ.) তাকাজা ঢালতেন, সাথীরা রায় দিতেন। এ প্রান্ত থেকে মাওলানা সা’দ ফায়সালা দিতেন। দিল্লির নিজামুদ্দীন মারকাজে পুরো রমজান মাস হজরত যোবায়রুল হাসানের অনুপস্থিতিতে হজরত মাওলানা সা’দ ফয়সালা করতেন। হজরত যোবায়রুল হাসানের ইন্তেকালের পর থেকে শুধু একজনই আমিরে ফয়সাল বেঁচে আছেন, তিনি মাওলানা সা’দ। তিনি নিজে নিজে আমির হননি। বরং ইনায়মুল হাসানে (রহ.) বানানো শুরার নির্ধারিত তিন ফয়সালের একজন। পরামর্শক্রমে বানানো ফয়সাল বর্তমান থাকায় তিনিই বর্তমান আমির।

সরকারের অবস্থান : সম্প্রতি দুই পক্ষের সঙ্গে বৈঠক করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল আগামী ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য বিশ্ব ইজতেমা স্থগিত ঘোষণা করেছেন। এ নিয়ে ঢাকা রেঞ্জ ডিআইজি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, টঙ্গি ইজতেমা মাঠের সমস্ত আয়োজন সরকারের পরবর্তী ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত স্থগিত রাখা হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ইজতেমা মাঠে সার্বক্ষণিক অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রাখা হয়েছে।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, টঙ্গির বিশ্ব ইজতেমাকে দ্বিতীয় হজ হিসেবে মনে করে দেশের সাধারণ ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা। তাদের বেশিরভাগই দূরদেশ সৌদি আরবে যেতে পারেন না শারীরিক ও আর্থিক কারণে। ফলে বছরজুড়ে প্রতীক্ষার প্রহর গোনেন টঙ্গির বিশ্ব ইজতেমার। কিন্তু সেটা না হওয়ায় এখন তারা হতাশ। আর এর দায়ভার কমবেশি সরকারের আছে বলে মনে করে তারা। সরকারও তাই মনে করছে। নির্বাচনের আগে এ বিষয়ে সরকারের কোনোপক্ষই কথা বলতে নারাজ। সূত্রমতে, সরকারের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক মহল এ নিয়ে উদ্বিগ্ন, বিব্রতও। ফলে তারা কোনো পক্ষকে ঘাটাতে চাইছে না। কারণ স্পর্শকাতর এ বিষয়ে পান থেকে চুন খসলে আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

অবশ্য পর্যবেক্ষরা বলছেন, সা’দ কান্দলভির বক্তব্যকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশেই বাড়াবাড়ি হচ্ছে বেশি। তার এ বক্তব্য নিয়ে  ব্রিটেন, আমেরিকা এবং ইউরোপের দেশগুলোতে তাবলিগ জামাতের নেতৃত্বে বিভক্তি দেখা দিয়েছে অনেক দিন আগেই। বিরোধ মেটানোর চেষ্টা থাকলেও তাতে এখনো ইতিবাচক ফল দেখা যায়নি।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads