নতুন বছরের প্রথম সূর্য উঠেছে আজ পুব আকাশে। আজ নতুন দিন। মহাকালের চিরন্তন গতি প্রবাহে বিগত হয়ে গেল আরো একটি বছর। শুরু হলো ইংরেজি নতুন বছর-২০২০। নতুনের প্রতি মানুষের সব সময় থাকে বিশেষ আগ্রহ। থাকে উদ্দীপনা। আর নতুনের মধ্যেই তো নিহিত থাকে অমিত সম্ভাবনা। আর সেই সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে সুযোগ করে দেবে নতুন বছর। তবে সম্ভাবনার আলোয় আলোকিত বাংলাদেশে রয়েছে অনেক চ্যালেঞ্জ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনায় অগ্রাধিকার দিতে হবে নতুন চ্যালেঞ্জগুলোকে। এর মধ্যে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো এবং দুর্নীতি দমন বড় দুই চ্যালেঞ্জ বাংলাদেশের সামনে। রয়েছে অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে আরো এগিয়ে নেওয়া এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অব্যাহত রাখা। তাদের মতে, বছরটা নতুন। তবে অনেক চ্যালেঞ্জই পুরনো।
২০১৯ সাল শেষ হয়েছে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরাতে ব্যর্থতা আর আলোচনা-সমালোচনার মধ্য দিয়ে। বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০২০ সালেও বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে সামনে থাকবে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো। তবে রোহিঙ্গাদের শরণার্থী জীবন দীর্ঘ হওয়ার মধ্যে কূটনৈতিক পাওয়া, আন্তর্জাতিক আদালতে মিয়ানমারের বিচারের মুখোমুখি হওয়া। আর মিয়ানমারের প্রতি জাতিসংঘের নিন্দা। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের বিষয়টি বিদায়ী বছরে প্রায়ই আলোচনায় এসেছে। কয়েক দফা চেষ্টা চললেও রোহিঙ্গাদের অনাগ্রহের কারণে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া কার্যত ভেস্তে যায়। তাদেরকে ভাসানচরে স্থানান্তরের উদ্যোগও সফল করা যায়নি বেসরকারি সংস্থাগুলোর অনাগ্রহে। এমন অবস্থায় রোহিঙ্গা সংকট দীর্ঘতর হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, রোহিঙ্গাদের ফেরত বলব না, বিষয়টি প্রত্যাবাসন। কিন্তু সেটি কখন হবে সেটি বলা কঠিন। এটি সরকার ও রাষ্ট্রের জন্য বড় কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ। সরকারকে অগ্রাধিকার দিতে হবে নতুন বছরে। আমাদের চেষ্টা থাকতে হবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন নিয়ে মিয়ানমারের ওপর চাপ বাড়ানো।
জানা গেছে, রোহিঙ্গাদের তাদের দেশে ফেরাতে ইউরোপীয় বিভিন্ন দেশ, ভারত এবং বিশেষ করে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের বন্ধুপ্রতিম চীনকে এ ক্ষেত্রে উদ্যোগী করতে সরকারকে আরো জোরালো পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। ২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইনে সেনাবাহিনীর দমন অভিযান শুরুর পর থেকে বিপুল রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন। এর আগে থেকেই কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোতে অবস্থান করছিল প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী। শিবিরে জন্ম নিচ্ছে রোহিঙ্গা শিশু।
আশ্রয় নিয়ে এখন দেশের জন্য হুমকি হয়ে উঠছে রোহিঙ্গারা। সর্বশেষ গত সোমবার কক্সবাজারের টেকনাফে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে সংঘর্ষে দুজন র্যাব সদস্য আহত হয়েছেন। রোহিঙ্গারা নিজেদের পরিচয় গোপন করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ছে। এমনিক তারা বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে দেশের বাইরে যাচ্ছে বলে তথ্য বেরিয়ে আসছে।
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর রোহিঙ্গাদের ওপর পরিচালিত অভিযানকে জাতিসংঘ বর্ণনা করে আসছে জাতিগত নির্মূল অভিযান হিসেবে। তবে সেখানে গণহত্যা-ধর্ষণ-জ্বালাও পোড়াওয়ের অভিযোগ মিয়ানমার সব সময় অস্বীকার করে আসছে। মিয়ানমার বলে আসছে, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে তারা প্রস্তুত। কিন্তু তাদের কথায় রোহিঙ্গারা আস্থা রাখতে না পারায় গত আগস্টে প্রত্যাবাসনের দ্বিতীয় দফা চেষ্টাও ব্যর্থ হয়। অবশ্য আন্তর্জাতিক আদালতে নিজেদের পক্ষেই সাফাই গাইছে দেশটি।
বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা এবং বন্ধুপ্রতিম দেশগুলোর প্রতি সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে এলেও কারো উদ্যোগ এখন পর্যন্ত প্রত্যাবাসনে সফলতা বয়ে আনেনি। দুই বছর আগে রোহিঙ্গাদের গ্রামে গ্রামে সেনাবাহিনীর অভিযানে যে বর্বরতা চালানো হয়েছে, তার মধ্য দিয়ে মিয়ানমার ১৯৮৪ সালের আন্তর্জাতিক গণহত্যা কনভেনশন ভঙ্গ করেছে বলে নভেম্বরে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) অভিযোগ করে পশ্চিম আফ্রিকার ছোট্ট দেশ গাম্বিয়া। ১০ ডিসেম্বর মঙ্গলবার দ্য হেগের পিস প্যালেসে গাম্বিয়ার পক্ষে বক্তব্য উপস্থাপন করতে এসে দেশটির আইনমন্ত্রী আবুবকর তামবাদু মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর বর্বরতার চিত্র তুলে ধরেন এবং গণহত্যা বন্ধের দাবি জানান। পরদিন ১১ ডিসেম্বর মিয়ানমারের পক্ষে বক্তব্য দিতে এসে দেশটির স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চি গণহত্যার অভিযোগ অস্বীকার করে দাবি করেন, রাখাইনের পরিস্থিতি সম্পর্কে গাম্বিয়া যে চিত্র আদালতে উপস্থাপন করেছে তা ‘অসম্পূর্ণ ও বিভ্রান্তিকর’।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অভ্যন্তরীণও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে দেশের। বিশেষ করে দুর্নীতির লাগাম টেনে উন্নয়নকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। যদিও সরকার বিদায়ী বছরের শেষ দিকে শুদ্ধি অভিযান শুরু করে। নতুন বছরে সেটি অব্যাহত থাকবে। দুর্নীতি না হলে দেশের চেহারা পাল্টে যেত মন্তব্য করে খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ফাঁকফোকর কোথায় এবং কারা উন্নয়ন প্রকল্প ক্ষতিগ্রস্ত করছে, তাদের খুঁজে বের করতে হবে। গত সেপ্টেম্বরে নিউ ইয়র্কের ম্যারিয়ট মারকুইজ হোটেলে যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ আয়োজিত এক নাগরিক সংবর্ধনায় প্রধানমন্ত্রী এই বক্তব্য দেন।
তিনি বলেন, আমি একটা কথা স্পষ্ট বলতে চাই, এই অসৎ পথ ধরে কেউ উপার্জন করলে, অনিয়ম, উচ্ছৃঙ্খলতা বা অসৎ কাজে যদি ধরা পড়ে, তবে সে যেই হোক না কেন, আমার দলের হলেও ছাড় হবে না, এর বিরুদ্ধে আমাদের ব্যবস্থা অব্যহত থাকবে। আমরা ব্যাপকভাবে উন্নয়ন প্রকল্প নিচ্ছি। যে পরিমাণ উন্নয়ন প্রকল্প আমরা নিচ্ছি, তার প্রতিটি টাকা যদি সঠিকভাবে ব্যয় হতো, ব্যবহার হতো, আজকে বাংলাদেশ আরো অনেক বেশি উন্নত হতে পারত।