• সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪২৯

মহানগর

রাজধানীতে ডিজে পার্টির ওপর গোয়েন্দা নজরদারি

গুলশান, বনানী, নিকেতন ও উত্তরার শতাধিক বাড়ি চিহ্নিত

  • ইমরান আলী
  • প্রকাশিত ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১

রাজধানীর বনানীর ব্লক এফের ৫২ নম্বর বাড়ি। বাইরের দিকটা পুরাতন হলেও ৬ তলা বাড়িটির ভেতরে কয়েকটি কর্পোরেট অফিস বেশ চাকচিক্যময়। বাড়িটি লিফটের ৪ এ আছে অখ্যাত এক প্রোডাকশন হাউজ। আসলে প্রোডাকশন হাউজের আড়ালেই এখানেই প্রাইভেট ডিজে পার্টি। যেখানে উঠতি মডেল থেকে শুরু করে আনা হয় নায়িকাদের। আর আসেন বিত্তবানদের সন্তান থেকে শুরু করে সমাজের নামিদামি ব্যক্তিরা। সপ্তাহের প্রায় ৩/৪ দিন ডিজে পার্টির পাশাপাশি চলে অনৈতিক কর্মকাণ্ড।  আবার অতিথিদের ভিডিও ধারণ করে ব্ল্যাকমেইলও করা হয়।

শুধু এই বাড়িটিই নয়, বনানী গুলশান, নিকেতনের প্রায় শতাধিক বাড়িকে ঘিরে প্রাইভেট ডিজের জমজমাট পার্টি হচ্ছে প্রতিনিয়ত। একটি চক্র ডিজের আড়ালে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।

সম্প্রতি ইউল্যাব বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীর মৃত্যুর পর সক্রিয় হয়ে উঠেছে পুলিশ। গুলশান, বনানী, নিকেতন, উত্তরা এলাকায় পুলিশ এ সব ডিজের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করছে। বিশেষ করে এ রকম প্রাইভেট ডিজের বিরুদ্ধে বেশি সক্রিয় পুলিশ। পোশাকে ও সাদাপোশাকে নজরদারি করে চলেছে।

গুলশান বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী বলেন, এ এলাকাগুলোতে এ ধরনের অনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধে পুলিশ বদ্ধপরিকর। আমরা ইতোমধ্যে নজরদারি শুরু করেছি। অনেক স্থানে অভিযানও হয়েছে।

উত্তরা বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার শহিদুল্লাহ বলেন, উত্তরার বিভিন্ন এলাকায় এ রকম প্রাইভেট ডিজে বন্ধে অভিযান চলছে। যেখানেই এ ধরনের অনৈতিক কর্মকাণ্ডের খবর পাওয়া যাবে সেখানেই আমরা অভিযান চালাবো।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলার পর অভিজাত এলাকা কেন্দ্রিক এ ধরনের পার্টি বন্ধ হয়ে যায়। হামলার আগে বেশকিছু অভিজাত হোটেলে ডিজে পার্টি হতো। কিন্তু হামলার ঘটনার পর থেকে নিরাপত্তার স্বার্থে এগুলো বন্ধ হয়ে যায়। এরপর থেকে এচক্র প্রাইভেট আয়োজন শুরু করে। স্বল্পপরিসরে লোকজন আমন্ত্রণ জানিয়ে এ পার্টি চলছে। পার্টিগুলোতে মূলত বিত্তবানদের ছেলে-মেয়ে ও সমাজের টাকাওয়ালা শ্রেণির লোকজনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। পার্টিকে ঘিরে মদ ও ডিজেদের দ্বারা উদ্যম নৃত্যের ব্যবস্থা থাকে। অতিথিদের মনোরঞ্জনের জন্য সব ব্যবস্থা করতো আয়োজকরা।

জানা যায়, করোনাকালীন সময়ে মদ আমদানিতে কিছুটা ভাটা পড়লে অসাধু ব্যবসায়ীরা ভেজাল মদ তৈরি করতে শুরু করে। আর এসব মদ রাজধানী ছাড়িয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। ভেজাল মদপানে একেক করে মৃত্যুর খবর আসতে থাকে। গত এক মানে রাজধানীসহ সারা দেশে অর্ধশতাধিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। সর্বশেষ পার্টিতে গিয়ে ইউল্যাব বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীর মৃত্যুর ঘটনায় টনক নড়ে যায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। একদিকে যেমন ভেজাল মদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হয়, শুরু হয় ডিজের নামে অনৈতিক পার্টিরও বিরুদ্ধে। এরই মধ্যে ইউল্যাবের ছাত্রীর মৃত্যুর ঘটনায় আটক হয় ডিজে নেহা নামের এক তরুণী। রিমান্ডে আনার পর অনৈতিক এ পার্টি সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর তথ্য আসে। কীভাবে পার্টি আয়োজনের মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা হাতানো যায়।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ডিজে নেহা আটকের পরও পুলিশি অভিযানে রাজধানীর অধিকাংশই স্থানে এখন এ প্রাইভেট ডিজে বন্ধ হয়ে গেছে। আগামি ১৪ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রিক এ ধরনের চক্রের বড় আয়োজন থাকলেও সেটি করতে পারবে কি-না সেটি নিয়ে তার সন্দিহান।

জানা যায়, ডিজে নেহার মতোই আরো এ রকম শতাধিক তরুণী বা ডিজের অন্ধকার জীবন রয়েছে। যারা রাতের বেলায় এ রকম পার্টিতে মত্ত থাকে আর দিনের বেলায় ঘুমায়। এদের কাজই হলো বিত্তবানদের টার্গেট করে পার্টিতে গেস্ট করা। নানা কলাকৌশলে এ ধরনের গেস্টের কাছ থেকে টাকা হাতানোই মূল কৌশল। এজন্য নিজের দেহ বিলাতেও তারা কার্পণ্য করেনা। আবার অনেক সময় পার্টিতে ডেকে এনে গোপনে ভিডিও ধারণ করে পরবর্তীতে ব্ল্যাক মেইলও তারা করে থাকে।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মিডিয়া সেন্টারের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার ইফতেখায়েরুল ইসলাম বলেন, এ ধরনের অনৈতিক পার্টির বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে অভিযান শুরু হয়েছে। আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এ ব্যাপারে বিভিন্ন বিভাগের উপ-কমিশনারদের নির্দেশ দিয়েছেন। সেই মোতাবেক অভিযানও শুরু হয়েছে। 

এদিকে ডিজে নেহাকে জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশ বিভিন্ন তথ্য জানতে পারছে। ডিজে নেহার অন্ধকার জীবন : ডিজে পার্টি, মদপার্টি কিংবা শিশা লাউঞ্জের রঙিন জগতের আলো-আঁধারে ডিজে নেহা এই ঘটনায় দায়ের করা মামলার আসামি নেহা ওরফে ডিজে নেহা। তার অন্যতম টার্গেট ছিল শিল্পপতি কিংবা তাদের সন্তানরা। হাতের নাগালে কোনো শিল্পপতি পেয়ে গেলেই যেনো কপাল খুলে যেতো তার। কলাকৌশলে বিভিন্ন রকমের অসহায়ত্ব প্রকাশ করেই জায়গা করে নিতো টার্গেটকৃতদের মনে।

নেহার ব্লাকমেইলিংয়ের কবলে পড়েছেন দেশের শীর্ষ পর্যায়ের শিল্পপতিও। এছাড়া রয়েছেন ঢাকা এবং চট্টগ্রামের শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক গাড়ি ব্যবসায়ী। যারা গাড়ি আমদানিকারক এবং গাড়ির বিক্রেতা।

শিল্পপতিদের মনের গভীরে জায়গা করে নিতে প্রয়োজনে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সুন্দরী তরুণীদের ম্যানেজ করে ওই শিল্পপতিদের সঙ্গে একান্তে সময় কাটানোর সুযোগ করে দিতো এই নেহা। এর বিনিময়ে হাতিয়ে নিতো মোটা অংকের টাকা কিংবা দামি গিফট। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ-তরুণীদের সন্তুষ্ট রাখতো ডিজে, মদ এবং শিশা পার্টিতে দাওয়াত দিয়ে। এদিকে শিল্পপতিদের সঙ্গে ওইসব একান্তের ছবি কিংবা ভিডিও গোপনে ধারণ করে নিজ সংরক্ষণে রাখতো নেহা।

একই সময়ে সংগ্রহ করে ফেলতো ওইসব শিল্পপতির মুঠোফোন নম্বর, যে প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়ে যেতো তাদের ফেসবুকসহ অন্যান্য অনলাইন মাধ্যমে। ওই শিল্পপতিদের ফেসুবকসহ অন্যান্য অনলাইন মাধ্যম ঘেঁটে একে একে যোগাড় করতো তাদের বাবা-মা, স্ত্রী কিংবা নিকটাত্মীয়দের সঙ্গে যোগাযোগের উসিলা। আবার এই তালিকা থেকেই অনলাইনে আরো শিকার খুঁজে বেড়াতো সে। এসব কুকর্মে তার ডান হাত হিসেবে কাজ করতো তারই খালাতো ভাই শাফায়াত জামিল বিশাল।

কে এই বিশাল?

তার পুরো নাম শাফায়াত জামিল বিশাল। এই তরুণ অপকর্মের মহারাণী খ্যাত ডিজে নেহা ওরফে কুইন নেহার সম্পর্কে খালাতো ভাই। বিশাল নেহার ডান হাত হিসেবে দায়িত্ব পালন করতো। ইউল্যাবের শিক্ষার্থী মাধুরীর মৃত্যুর পরই বেরিয়ে পড়ে সুন্দরী নেহার সব খবর। বিশাল নামের তরুণ প্রায় সার্বক্ষণিকই নেহার সঙ্গেই থাকতো বলে জানা গেছে। শিশা লাউঞ্জে নেহা ও বিশালের গোপন ভিডিও ইতোমধ্যে ভাইরাল হয়েছে। নেহা তার মুঠোফোনে টার্গেটকৃতদের নাম সংরক্ষণ করতে বিশেষ কৌশল অবলম্বন করতো। তথ্য পাওয়া গেছে, উত্তরার ব্যাম্বু স্যুট রেস্টুরেন্টে ইউল্যাব শিক্ষার্থীদের মদপান করাতে নেহা ও তার খুব কাছের বন্ধু আরাফাত ভূমিকা পালন করে। মদপানের পর ওই আরাফাতও মারা গেছে। নেহার ফোনেই তার খালাতো ভাই শাফায়াত জামিল বিশাল এয়ারপোর্ট এলাকা থেকে মদ কিনে নিয়ে যায় ওই রেস্টুরেন্টে। বিশাল নেহার ক্লায়েন্টদের তালিকা সংরক্ষণ করতো।

জানা যায়, ২০২০ সালের মার্চে নেহার সাথে ইংরেজি চট্টগ্রামের এক গাড়ি ব্যবসায়ীর পরিচয় ঘটে। এর এক পর্যায়ে ওই ব্যবসায়ীকে একান্ত সম্পর্কে জড়িয়ে ইমোশনাল ব্লাকমেইলিং করতে থাকে। ওই ব্যবসায়ীর কাছ থেকে গত মার্চ থেকে আগস্ট পর্যন্ত, ৬ মাসে কয়েক লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়।

চট্টগ্রামের ওই গাড়ি ব্যবসায়ীর ফেসবুক থেকে নেহার পরিচয় হয় ইংরেজি ঢাকার এক গাড়ি ব্যবসায়ীর সঙ্গে। এই দুই গাড়ি ব্যবসায়ী একে অপরের বন্ধু। চট্টগ্রামের বন্ধুকে নেহা যে ব্লাইমেইলিং করেছে তা ঢাকার এই বন্ধু পরে টের পায়। তবে ইতোমধ্যে গত সেপ্টেম্বর পর থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত ঢাকার এই গাড়ি ব্যবসায়ীকেও একই রকমের ফাঁদে ফেলে ৪ মাসে ১৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। এসব টাকা বিকাশসহ বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় হাতিয়ে নেয় ডিজে নেহা।

আন্তর্জাতিক ইয়াবা কারবারিদের মধ্যে কার্লোস অন্যতম। তার পুরো নাম আবু জাফর মোহাম্মদ কার্লোস। সে ইয়াবা ডন কার্লোস নামেও পরিচিত। ২০১৭ সালের মাঝামাঝিতে ঢাকায় গ্রেপ্তার হয়েছিল ‘আবু জাফর মোহাম্মদ কার্লোস’ নামের আন্তর্জাতিক ইয়াবা ব্যবসায়ী। তার সঙ্গে জড়িয়ে মিডিয়ায় আলোচনায় উঠে আসে বেশ কজন মডেল অভিনেত্রীর নাম। অনন্য মামুন পরিচালিত ‘অস্তিত্ব’ চলচ্চিত্রের প্রযোজক কার্লোস। অস্তিত্ব সিনেমা বানানোর পর কার্লোস ঢাকার সিনেমা পাড়ার নামি-দামি নায়িকাদের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। এসব নায়িকার অনেককে নিয়ে তিনি থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় যাতায়াত শুরু করেন। এই কার্লোসও ডিজে নেহার খুব কাছের এবং ঘনিষ্ঠ একজন ছিল বলে জানা গেছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads