• রবিবার, ৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪২৯
রাজধানীজুড়ে মানুষ-মশা লড়াই

সংগৃহীত ছবি

মহানগর

রাজধানীজুড়ে মানুষ-মশা লড়াই

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ১৫ মার্চ ২০২১

রাজধানী ঢাকায় বস্তি থেকে অভিজাত এলাকার কেউ মশার উৎপাত থেকে রেহাই পাচ্ছেন না। জনজীবন বিপর্যস্ত করে তুলছে মশা। ঘরে কিংবা বাইরে কোথাও মশা থেকে মুক্তি মিলছে না। দিনে মশার উপদ্রব কিছুটা কম থাকলেও সন্ধ্যার পর তা বাড়ে কয়েকগুণ। ওষুধ ছিটিয়ে, কয়েল জ্বালিয়ে কোনো কাজ হচ্ছে না। এ যেন এক অদৃশ্য শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই। 

গত মৌসুমের তুলনায় চলতি মৌসুমে কিউলেক্স মশার ঘনত্ব বেড়েছে প্রায় চারগুণ। রাজধানীর উত্তরা, খিলগাঁও, শনির আখড়া, শাঁখারীবাজার, মোহাম্মদপুর ও পরীবাগে গড় ঘনত্ব প্রতি ডিপে মশা মিলেছে ৬০টিরও বেশি, যেখানে বছরের এ সময় পাওয়া যায় ১৫ থেকে ২০টি। যদিও ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা বলছেন, মশা নিয়ন্ত্রণে নগরজুড়ে নিয়মিত ওষুধ ছিটানো হচ্ছে। পাশাপাশি নগরবাসীকেও সচেতন হতে হচ্ছে। বাড়ির আঙিনা পরিষ্কারসহ যে-কোনো জায়গায় আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকতে হবে।

রাজধানীর উত্তরখান এলাকার বাসিন্দারা জানান, মশার ভয়ে সারাক্ষণই দরজা-জানালা বন্ধ করে রাখতে হয়। যদি কখনো আলো বাতাসের জন্য কিছু সময় জানালা খোলা রাখা হয়, তাহলে মশায় সারা রুম ভরে যায়। এর জের কয়েকদিন ধরে টানতে হয়। রাজধানীর কালশী এলাকার বাসিন্দা সাবরিন রুমি বলেন, পড়তে বসলে মশার কামড়ে হাত-পা, মুখে রক্ত বিন্দু জমে থাকে। রান্নাঘরে কাজ করতে গেলে কানের কাছে প্যান প্যান করে মশা। মশা মারতে কয়েল, স্প্রে, বৈদ্যুতিক ব্যাট সবই কিনেছি। কিন্তু কিছুতেই কাজ হচ্ছে না। পল্লবীর বাসিন্দারা বলেন, সন্ধ্যার আগেই বাসার দরজা-জানালা বন্ধ করা হয়। তারপরও মশার কামড় থেকে রক্ষা নেই। সাত তলায় মশার উপদ্রব। সিটি করপোরেশন কাজ করেছে বললেও তার ফল আমরা পাচ্ছি না।

গুলশান সোসাইটির মহাসচিব শুক্লা সারওয়াত সিরাজ বলেন, মশার সাংঘাতিক উপদ্রব। এটি একটি অভিজাত এলাকা। সে হিসেবে আশা করেছিলাম হয়তো মশার উপদ্রব থেকে স্বস্তি পাবো। কিন্তু ঠিক উল্টোটা হচ্ছে। এ এলাকায় সিটি করপোরেশনের নিয়মিত কাজ করছে। কিন্তু মশার উপদ্রব ঠেকাতে পারছে না।

মশা বাড়ার বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক ড. কবিরুল বাশার বলেন, বৃষ্টি না হওয়ার কারণে ও পানি বহমান না থাকার কারণে কিউলেক্স মশার জন্মানোর হার বেড়ে গেছে। বৃষ্টি হলে কিউলেক্সের লার্ভা ভেসে গেলে হয়তো মশার ঘনত্ব কমে আসবে।

মশা নিয়ে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন একে ওপরকে দোষারোপ করলেও ইতোমধ্যে নেওয়া হয়েছে বেশ কিছু পদক্ষেপ। এতে টার্মিনালের ভেতরে মশার উপদ্রব কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসলেও, টার্মিনালের বাইরের মশারা আছে বহাল তবিয়তে। এই ভোগান্তিতে সবচেয়ে বেশি আছেন বিমানবন্দরের বে-এরিয়ায় কর্মরত বিমানবন্দরের বিভিন্ন সংস্থার কর্মীরা। সন্ধ্যা নামলেও সবার মধ্যে দেখা দেয় মশার আতঙ্ক। যাত্রীসহ বিমানবন্দরে আসা হাজার হাজার মানুষ পড়েন মশার বিড়ম্বনায়।

গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সোয়া ৬টায় বিমানবন্দরের ২ নম্বর টার্মিনালে গিয়ে দেখা যায়, অপেক্ষারত যাত্রীর স্বজনরা মশা তাড়াতে হাত-পা নাড়ছেন।  টার্মিনালের দ্বিতীয় তলায় বিদেশগামী যাত্রীদেরও টার্মিনালে প্রবেশের আগে সহ্য করতে হচ্ছে মশার কামড়। প্রবাসী ভাইকে নিতে নোয়াখালী থেকে এসেছিলেন আমজাদ হোসেন, সঙ্গে তার দুই শিশু সন্তান। শিশুদের মশার উৎপাত থেকে রক্ষা করতে অনবরত গামছা নাড়ছেন তিনি। অতিষ্ঠ আমজাদ বলেন, দেশে মশা আছে সব জায়গায়ই। কিন্তু বিমানবন্দরেও এত মশা থাকতে পারে ধারণা ছিল না। এখানে মশা মারতে ভালো ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

বিমানবন্দরে কর্মরতরা বলছেন, নভেম্বর থেকে বিমানবন্দরে মশার উৎপাত বাড়ে। শীতকালে মশার উপদ্রব থাকে সবচেয়ে বেশি। এই সময়ে দিনের বেলায়ও মশার কামড় সহ্য করতে হয়। শীত কমতে থাকলে মশার উপদ্রবও কমে। বর্ষা মৌসুমে সহনীয় হয় মশার উৎপাত।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিমানবন্দরে কর্মরত একটি এয়ারলাইন্সের কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে মশার ওষুধ দিচ্ছে নিয়মিত। এতে উপদ্রব কিছুটা কমেছে। সন্ধ্যায় একবার ফগার মেশিন দিয়ে ওষুধ দেওয়া হয়। কিন্তু এটা রাতে কয়েকবার হলে বিমানবন্দরে আগত যাত্রী ও কর্মীদের জন্যই ভালো হয়। বিমানবন্দরে গ্রাউন্ড হ্যান্ডিলিংয়ে কর্মীরা বলছেন, এপ্রোন এলাকায় মশার উৎপাত এখনও অসহনীয়। রাতের বেলায় ডিউটি করা দুরূহ হয়ে পড়ে। এপ্রোন এলাকায়  বিমান থাকায়, যেখানে-সেখানে মশার কয়েলও জালানো সম্ভব হয় না। ফলে মশার কামড় সহ্য করেই কাজ করতে হচ্ছে। 

বিমানবন্দরের বাইরের এলাকা থেকে মশা আসছে এমন অভিযোগ তুলে ডিএনসিসিকে দুষছে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ। অন্যদিকে বিমাননবন্দরে পরিচ্ছন্নতার অভাব, মশার প্রজনন ক্ষেত্র আছে বলে অভিযোগ  ডিএনসিসির। এর প্রেক্ষিতে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে মশার উৎপাত নিয়ন্ত্রণে ৭ সদস্যের কমিটি গঠন করে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। কমিটিতে বিমান মন্ত্রণালয়, বিমানবন্দর, সিটি করপোরেশন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, বেবিচকের প্রতিনিধি অন্তভূক্ত করা হয়। বৈঠকে সিটি করপোরেশন, সিডিসি ও বেবিচকের সমন্বয়ে বিমানবন্দরের ভেতরে ও বাইরে তিন মাইলের মধ্যে পরিচ্ছন্নতা, মশা নিধনে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে বলা হয়।

পরবর্তীসময়ে ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) পক্ষ থেকে একটি ভেহিকল মাউনটেড ফগার মেশিন বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়। সরেজমিনে দেখা গেছে, অ্যাভিয়েশন কিউরিটির (অ্যাভসেক) একটি ফগার মেশিন পিক-আপ গাড়িতে স্থাপন করা হয়েছে। সন্ধ্যার পর একবার বিমানবন্দর এলাকায় কীটনাশক প্রয়োগ করা হয়। এছাড়া বিমানবন্দরের প্রবেশের গেটগুলোতে মশার কয়েল জ্বলানো হয়। টার্মিনালের ভেতরে ও বাহিরে কীটনাশকও ছিটানো হয়।

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন এএইচএম তৌহিদ-উল আহসান বলেন, মশা নিধনে ক্র্যাশ পোগ্রাম নিয়েছি। জলাশয়, বিমানবন্দরের বিভিন্ন স্থান পরিষ্কার করা হচ্ছে নিয়মিত। কীটনাশক ছিটানো হয় নিয়মিত। ফলে মশার উপদ্রব কমেছে। গত মাসে সিডিসি একটি সার্ভে করে, যেখানে দেখা যায় বিমানবন্দর এলাকায় কোথাও মাশার লার্ভা পাওয়া যায়নি। এখন মশার উপদ্রব সহনশীল আছে।

তিনি আরো বলেন, মশা ৩ থেকে ৫ কিলোমিটার পর্যন্ত উড়ে যেত পারে। আশপাশের এলাক থেকেও মশা উড়ে আসতে পারে। এজন্য পদক্ষেপ নিতে আমরা সিটি করপোরেশনকে জানিয়েছি। শুধু বিমানবন্দর নয়, আশেপাশের এলাকা মশামুক্ত না হলে বিমানবন্দরকে পুরোপুরি মশামুক্ত করা সম্ভব না। বিমানবন্দরকে একেবারে মশামুক্ত করতে হলে আশেপাশের ৪ থেকে ৫ কিলোমিটার এলাকাও মশা মুক্ত করতে হবে। না হলে শুধু বিমানবন্দরে ব্যবস্থা নিয়ে মশামুক্ত করা সম্ভব হবে না।

ডিএনসিসি প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জোবায়দুর রহমান বলেন, কিউলেক্স মশার বংশবিস্তার রোধে লার্ভিসাইডিং করা হচ্ছে, ফগিংও চলছে। মশা নিয়ন্ত্রণে চতুর্থ প্রজন্মের নোভালিউরন ওষুধ প্রয়োগ করা হচ্ছে। খুব দ্রুত মশক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসবে। আমরা প্রায় ১১ লাখ টাকা দামের ভেহিকল মাউনটেড ফগার মেশিন বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকে ক্রুসহ দিয়েছি। ফলে অল্প সময়ে বিমানবন্দরে পুরো এলাকায় ওষুধ ছেটানো সম্ভব হচ্ছে। এছাড়া, আমরা তাদের মশার উৎপত্তিস্থলগুলো চিহ্নিত করে দিয়েছি। বিমানবন্দরের ঝোপ পরিষ্কার করতে জনবল দিয়েও সহায়তা করেছি। ফলে সামগ্রিকভাবে মশার উপদ্রব কমছে। তবে বিমানবন্দরে ভেতর ও বাহিরের জলাশয়গুলো সব সময় পরিষ্কার রাখতে হবে। না হলে মশার বংশবৃদ্ধি হবে, উপদ্রব ছড়িয়ে পড়বে। 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads