• সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪২৯

মহানগর

উদ্যোগ নেই রাজধানী থেকে বিহারি ক্যাম্প সরানোর

  • সালাহ উদ্দিন চৌধুরী
  • প্রকাশিত ০৯ এপ্রিল ২০২২

নিরাপত্তা ঝুঁকিসহ বিভিন্ন দিক বিবেচনায় বিহারি ক্যাম্প স্থানান্তরের জন্য প্রাথমিকভাবে গাজীপুর ও কেরানীগঞ্জের দুটি স্থান চিহ্নিত করা হয়েছিল। যদিও তা চূড়ান্ত করা হয়নি। আট বছর আগে রাজধানী ঢাকা থেকে বিহারি ক্যাম্পগুলো সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত হলেও বাস্তবে এর কোনো কার্যক্রম নেই।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, স্বাধীনতার পর থেকেই রাজধানীর মোহাম্মদপুর ও  মিরপুরের বিহারি ক্যাম্পগুলো নানা অপরাধের ঘাঁটি এবং আশপাশের এলাকার পরিবেশ নষ্ট করছে। এমন পরিস্থিতিতে রাজধানীর বিহারি ক্যাম্পগুলো ঢাকার পাশের কোনো সুবিধাজনক এলাকায় স্থানান্তরের কথা ভাবে সরকার। ২০১৪ সালে মিরপুর বিহারি ক্যাম্পে অগ্নিকাণ্ডে কয়েকজনের প্রাণহানির ঘটনার পর এ বিষয়ে জোর আলোচনা শুরু হয়। ২০১৫ সালে এক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এ বিষয়ে নির্দেশনা দেন। ঢাকার আশপাশের সুবিধাজনক স্থানে তাদের স্থানান্তরে তিনি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বলেন। এ সংক্রান্ত কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও স্থানীয় সরকার বিভাগকেও বলা হয়। এরপর থেকেই মূলত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের একাধিক সমন্বয় সভায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। বিষয়টি সমন্বয়ের জন্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবকে (ত্রাণ প্রশাসন) এ কার্যক্রম বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসন ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ এবং সমন্বয় সাধনের দায়িত্ব দেয়া হয়। কিন্তু দীর্ঘ সময়েও বিষয়টি বেশিদূর এগোয়নি।

সর্বশেষ ২০১৮ সালের ৫ জুন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি ও নির্দেশনাসমূহ বাস্তবায়নসংক্রান্ত এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে ক্যাম্প স্থানান্তরের বিষয়ে আলোচনা হয়। এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতি নেই বলে বৈঠকে জানানো হয়। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা দ্রুত বাস্তবায়নের তাগিদ দিয়ে বৈঠকের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালক-১ মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিন বলেন, ঢাকা শহরের মধ্যস্থলে বসবাসকারী বিহারিদের অন্য কোনো সুবিধাজনক স্থানে স্থানান্তরের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। জেলা প্রশাসকের সহযোগিতায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে খাসজমি চিহ্নিত করে বিহারিদের স্থানান্তরের কার্যক্রম গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়।

জানা যায়, রাজধানীর মিরপুর এবং মোহাম্মদপুরের বিহারি ক্যাম্পগুলো থেকেই পরিচালিত হয় ভয়ংকর অপরাধ কর্মকাণ্ড। দেশে বিভিন্ন সময়ে চলা রাজনৈতিক কর্মসূচিতে এসব ক্যাম্পগুলো ছিল পেট্রোলবোমা এবং বিস্ফোরকসহ বিভিন্ন উপকরণ জোগানের অন্যতম উৎসস্থল।

কয়েক বছর আগে একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, দীর্ঘদিন ধরে স্বাধীনতাবিরোধী একটি চক্র এসব বিহারি ক্যাম্পের অনেক বাসিন্দাকে রাষ্ট্রবিরোধী কাজে ব্যবহার করছে। রাজনৈতিক মেরুকরণের অংশ হিসেবে নিজেদের অবস্থানগত সুবিধার জন্য এই বিহারিরা বিভিন্ন অনৈতিক ও আইনবহির্ভূত কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হতে দ্বিধাবোধ করে না। 

মূলত বিহারিদের চরম দরিদ্রতার সুযোগ নিয়ে তাদের ব্যবহার করছে রাজনৈতিক দুর্বৃত্ত এবং সন্ত্রাসীরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মিরপুর ক্যাম্পের কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, আমরা কোথায় যামু? আমাগো তো সব লোকই ব্যবহার করে। শুনলেও দোষ, না শুনলেও দোষ। জানা গেছে, সারা দেশে আটকেপড়া পাকিস্তানিদের ৭৬টি ক্যাম্পের মধ্যে রাজধানীতে আছে ১১টি। এর মধ্যে সবচেয়ে অপরাধপ্রবণ মোহাম্মদপুরের জেনেভা এবং মিরপুরের ক্যাম্পগুলো। প্রতিটি ক্যাম্পেই আস্তানা গেড়েছে অপরাধীরা। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা বিহারিদের ব্যবহার করে ফায়দা নিচ্ছেন। রয়েছে সন্ত্রাসীদের সার্বক্ষণিক আনাগোনা। আর এমন পরিবেশে থেকেই বড় হয়ে ওঠা বিহারি তরুণ-যুবকরাও জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধ কর্মকাণ্ডে। প্রতিটি বিহারি ক্যাম্পেই মাদক, আগ্নেয়াস্ত্র ও বিস্ফোরক কেনাবেচা হয়।

ডিএমপি’র মিরপুর বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, মানবাধিকারের দোহাই দিয়ে বিহারি ক্যাম্পগুলোর অনেকে অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়ে পড়েছে। তবে এর মধ্যে বেশির ভাগেরই হয় মা বিহারি বাবা বাঙালি। আবার কারও কারও বাবা বিহারি মা বাঙালি। এরা মাদকসহ অস্ত্র ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েছে। আবার তাদের কাছে মাঝে মাঝেই আশ্রয় নেয় দেশের বিভিন্ন এলাকার পলাতক সন্ত্রাসীরা। তবে তিনি স্বীকার করেন, ক্যাম্পের লোকজন মানবেতর জীবনযাপন করছে।

জানা গেছে, ঢাকার ১১টি বিহারি ক্যাম্পের মধ্যে মোহাম্মদপুরে রয়েছে ছয়টি। এগুলো হলো- জেনেভা ক্যাম্প, টাউন হল ক্যাম্প, সিআরও ক্যাম্প, মার্কেট ক্যাম্প, কমিউনিটি সেন্টার এবং স্টাফ কোয়ার্টার ক্যাম্প। আর মিরপুরের কালশীতে রয়েছে বাকি পাঁচটি- মিল্লাত ক্যাম্প, কুর্মিটোলা ক্যাম্প, বেনারসি ক্যাম্প, ১২ নম্বর পানির ট্যাংকি ক্যাম্প ও কালাপানির ক্যাম্প। ঢাকার বাইরে সৈয়দপুরে ক্যাম্পের সংখ্যা বেশি।

সূত্র জানায়, রাজধানী ঢাকায় ৪৫টি বিহারি ক্যাম্পে প্রায় ৬ লাখ লোক বাস করে। এছাড়া দেশের কয়েকটি জেলায় ক্যাম্পগুলোতে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে বিহারিরা। তাদের অন্যত্র স্থানান্তর না করা পর্যন্ত ক্যাম্পের বাসিন্দাদের প্রয়োজনীয় সব সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে সরকারের নজরদারি রয়েছে।

বিহারি ক্যাম্পের বিদ্যুৎ ও পানির বিল পরিশোধের ব্যাপারে হাইকোর্টের আদেশ রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এ সংক্রান্ত আইনগত বিষয়াদি পর্যালোচনা করে দেখছে। এছাড়া ক্যাম্পের বাসিন্দাদের নাগরিকত্ব দেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার জন্য ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, খুলনা, চট্টগ্রাম, বগুড়া, রাজশাহী, যশোর, জামালপুর, পাবনা, ময়মনসিংহ, রংপুর, নীলফামারী, গাইবান্ধা- এ ১৩টি জেলার জেলা প্রশাসককে চিঠি দেয়া হয়েছে।

আন্তর্জাতিক রেডক্রস সোসাইটি (আইসিআরসি) ১৯৭৩ সালে বিদায় নেওয়ার পর বাংলাদেশ সরকার ও বিডিআরএস এসব বিহারি ক্যাম্পের দায়িত্ব নেয়। ১৯৭৬ সাল থেকে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকরা অ্যাডহক ভিত্তিতে রিলিফ কমিটি বা অবাঙালি ক্যাম্প ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করে ক্যাম্পগুলো নিয়ন্ত্রণ করছেন। ২০০৮ সালে ক্যাম্পের লোকজনকে জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়া হয়। তারা ভোটাধিকার প্রয়োগের অধিকার রাখেন।

উল্লেখ্য, ১৯৭৪ সালে ভারত ও বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের ত্রিপক্ষীয় চুক্তি সম্পাদনের পর পাকিস্তান সে সময়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আটকে পড়া পাকিস্তানিদের গ্রহণ করে। ১৯৯২ সালে আটকে পড়া পাকিস্তানিদের ফিরিয়ে নিতে অরগানাইজেশন অব ইসলামিক কনফারেন্সের (ওআইসি) অঙ্গ প্রতিষ্ঠান রাবিতা আলম আল ইসলামি একটি জরিপ পরিচালনা করে। যারা সে সময়ে পাকিস্তানে ফিরে যেতে চায় তাদের ফরম পূরণ করতে দেয়া হয়। তাদের সহযোগিতা করেছিল স্ট্র্যান্ডেড পাকিস্তানি জেনারেল রিপার্টিশন কমিটি (এসপিজিআরসি)। সেসময় ৪০ হাজার ২০৮টি পরিবারের দুই লাখ ৩৭ হাজার ৪৪০ জন উর্দুভাষী পাকিস্তানে ফিরে যেতে ফরম পূরণ করেছিল। তবে তাদের মধ্যে মাত্র ৩২৩ জনকে পাকিস্তান গ্রহণ করেছিল। এরপর থেকে আটকেপড়া পাকিস্তানিদের ফিরিয়ে নেয়া বন্ধ হয়ে যায়। এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার বারবার তাগাদা দিলেও পাকিস্তান সরকার আগ্রহ দেখায়নি।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads