• শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ৩ জৈষ্ঠ ১৪২৯

মতামত

জঙ্গিবাদ ধর্মের নামে অধর্ম

  • প্রকাশিত ১৬ জানুয়ারি ২০১৮

জঙ্গিবাদ শুধু বাংলাদেশের সমস্যা নয়, বৈশ্বিক সমস্যা। এ সমস্যার শেষ কোথায় আমরা কেউ জানি না। সম্প্রতি সিরিয়ার একটি ঘটনা বিশ্বমানবকে আরো বেশি ভাবিয়ে তুলেছে। বাবা-মা তাদের আদরের ছোট্ট দুই সন্তানের গায়ে সুইসাইড বোম জড়িয়ে বললেন, যাও পুলিশ লাইনে ঢুকে বোতাম টিপে দেবে। বেহেশতে আবার দেখা হবে। এরা কি মানুষ? ধর্মান্ধতা মানুষকে কীভাবে অমানুষে পরিণত করে এটা তার একটি নমুনা। আজ পৃথিবীতে যে জঙ্গিবাদ সৃষ্টি হয়েছে তার প্রেরণা বা মূল উৎস ধর্ম নয়, ধর্মান্ধতা। পবিত্র ধর্ম কখনোই জঙ্গিবাদ, হত্যা কিংবা আত্মহত্যাকে সমর্থন করে না। অথচ বর্তমান জঙ্গিবাদের সঙ্গে এই তিনটি বিষয়ই ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
প্রকৃত অর্থে ইসলাম সর্বস্তরের জনগণের শান্তি ও নিরাপত্তা বিধানে গুরুত্বারোপ করে। মুসলিম অমুসলিমের মাঝে কোনো বিভাজন সৃষ্টি করে না। সবার অধিকার রক্ষায় বদ্ধপরিকর। জানমাল ইজ্জত আব্রু রক্ষায় আপসহীন। বিদায় হজের ভাষণেও রাসুলপাক (সা.) বলেন, তোমাদের ওপর একে অপরের জানমাল রোজ কিয়ামত পর্যন্ত হারাম। আত্মহত্যা আর এক মহাপাপ। সুইসাইডাল স্কোয়াড নামের মধ্যেই এর পরিচয় নিহিত। আত্মহত্যা ছাড়া আত্মঘাতী হওয়া যায় না। আত্মহত্যাকারী জাহান্নামি এটা পবিত্র কোরআনে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। বোখারি এবং মুসলিম শরিফেও আত্মহত্যাকারীর পরিণাম জাহান্নাম একথা স্পষ্টভাবে বলা আছে।
এই জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসের সঙ্গে আর একটি বিষয় জড়িত, তা হলো তথাকথিত জিহাদ। প্রকৃত অর্থে জিহাদের নামে জঙ্গিবাদ এবং ইসলাম বিপরীতমুখী দুটি জিনিস। এ ধরনের জিহাদের সঙ্গে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই। এই ভ্রান্ত মতবাদীরা জিহাদের প্রকৃত অর্থই জানে না। জিহাদ একটি আরবি শব্দ, এর অর্থ হলো কোনো কিছুর জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করা। প্রথম হলো নিজের নফসের বিরুদ্ধে জিহাদ করা। খারাপ চিন্তা-চেতনা এবং খারাপ কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখা। দ্বিতীয় হলো ভালো কাজের আদেশ করা, মন্দ কাজে নিষেধ করা। তৃতীয় জিহ্বার দ্বারা জিহাদ করা অর্থাৎ হিকমত ও উত্তম পন্থায় যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করা, মানুষকে আল্লাহর রাস্তায় আহ্বান করা এবং সর্বশেষ ধাপ হলো সশস্ত্র জিহাদ। সশস্ত্র জিহাদের চারটি শর্ত আছে। তা হলো (১) একজন মানুষ মুসলমান, শুধু এই কারণে যদি তার সম্পদ কেড়ে নেওয়া হয়, বসতবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়, দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়; (২) ইবাদত করতে মসজিদে যেতে বাধা দেওয়া হয়; (৩) তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য যদি মুশরিকরা যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয় এবং সৈন্য সমাবেশ ঘটায়; (৪) জিহাদ ঘোষণা করতে পারবেন শুধু একজন রাষ্ট্রনায়ক, কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর জিহাদ ঘোষণার অধিকার নেই। ইসলামের ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদের (সা.) ওপর মুশরিকরা অত্যাচার করেছে, ধর্ম ত্যাগ করার জন্য চাপ দিয়েছে, তাঁকে হত্যার পরিকল্পনা করেছে। এমতাবস্থায় রাসুল পাক (সা.) আল্লাহতায়ালার কাছে সত্তরবার জিহাদের অনুমতি চেয়েছেন কিন্তু আল্লাহতায়ালা জিহাদের অনুমতি দেননি। শেষ পর্যন্ত তিনি আল্লাহর নির্দেশে নিজ জন্মভূমি ত্যাগ করে মদিনায় হিজরত করেছেন। মক্কা মুসলমানদের তীর্থস্থান। হোদাইবিয়ার সন্ধির আগ পর্যন্ত মুশরিকরা কাবা শরিফে হজ পালনে বাধা দিয়েছে। যখন মদিনা থেকেও মুসলমানদের চিরতরে নিশ্চিহ্ন করার জন্য যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছে, সৈন্য সমাবেশ ঘটিয়েছে, তখনই আল্লাহপাক রাসুলপাককে (সা.) শর্তসাপেক্ষে মুশরিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ করার অনুমতি দিয়েছেন। আল্লাহপাক পবিত্র কোরআনে বলেছেন, ‘যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তোমরাও আল্লাহর পথে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর; কিন্তু সীমা লঙ্ঘন করো না। আল্লাহ সীমা লঙ্ঘনকারীকে ভালোবাসেন না (সুরা বাকারা, আয়াত-১৯০)।’
এ আয়াতে তোমরা সীমা লঙ্ঘন করো না- এ কথার মাধ্যমে আল্লাহপাক জিহাদে কোনো শিশু, নারী, বৃদ্ধ, ধর্মযাজককে হত্যা করতে নিষেধ করেছেন। সন্ধিভুক্ত অর্থাৎ যাদের সঙ্গে ইতোপূর্বে মুসলমানদের সন্ধিচুক্তি হয়েছে এবং চুক্তির কোনো শর্ত লঙ্ঘন করেনি তাদের বিরুদ্ধেও জিহাদ করতে নিষেধ করেছেন। যুদ্ধকালীন সময়ে কোনো ফলবান বৃক্ষ নষ্ট করা যাবে না। মুশরিকরা পরাজিত হয়ে যুুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়নরত অবস্থায় পেছন থেকে আঘাত করা যাবে না। পিতা-মাতার অনুমতি ব্যতীত জিহাদে অংশগ্রহণ করা যাবে না। কেউ যদি পিতা-মাতার অনুমতি ব্যতীত জিহাদে অংশগ্রহণ করেন এবং শহীদ হন তার জন্য পিতা-মাতার অনুমতি না নেওয়ার জন্য জান্নাত হারাম এবং জিহাদে শহীদ হওয়ার জন্য জাহান্নাম হারাম। এমতাবস্থায় তাদের স্থান হবে জান্নাত এবং জাহান্নামের মাঝামাঝি আরাফ নামক স্থানে।


আল্লাহতায়ালার প্রকৃত বান্দা তারাই যারা

একমাত্র আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি লাভের জন্য

ইবাদত করে থাকেন। আল্লাহপাক সন্তুষ্ট হলে

জান্নাত নসিব করবেন আর অসন্তুষ্ট হলে

দোজখে নিক্ষেপ করবেন, এটাই নিয়ম

বর্তমানে পুলিশ অভিযানে ধৃত জঙ্গিদের বেশ-ভূষা, ডিগ্রি দেখে মনে হয় তারা কেউ আলেম নয়। তাদেরকে ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে মগজ ধোলাই করা হয়েছে। জঙ্গিদের কথোপকথন থেকে জানা যায়, মারা গেলেই বেহেশতের দারোয়ান ও হুরপরীরা তাদেরকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য দাঁড়িয়ে আছে। পুলিশের আইজি মহোদয়ের বক্তব্য থেকেও জানা যায়, তারা বলছে আমাদের মেরে ফেলুন, তাড়াতাড়ি বেহেশতে চলে যাব। জঙ্গি হামলায় নিহত হলে সে শহীদের মর্যাদা পাবে, বেহেশতে যাবে এবং সবসময় বিরিয়ানি খেতে পারবে। এ আশায় সে জঙ্গির খাতায় নাম লিখিয়েছে।
বিরিয়ানি আর হুরপরীর আশায় ইবাদত করলে বেহেশত পাওয়া যায় না। এ প্রসঙ্গে ইমাম গাজ্জালী (রহ.) তার কিমিআয়ে সাদআত গ্রন্থে বলেছেন, যে ব্যক্তি বেহেশতের আশায় আল্লাহর ইবাদত করে সে ব্যক্তি উদর এবং কামপ্রবৃত্তির দাস। কেননা, সে এমন স্থানে যাওয়ার অভিলাষী হয়ে ইবাদত করে থাকে সেখানে উদরপূর্তি ও কামপ্রবৃত্তি চরিতার্থকরণের প্রচুর উপকরণ বিদ্যমান। আর যারা দোজখের শাস্তির ভয়ে ইবাদত করে তারা দুষ্ট প্রকৃতির গোলামসদৃশ্য। লাঠি উঁচিয়ে ধমক না দিলে কাজ করতে চায় না। এ দুই শ্রেণির আবেদগণের সঙ্গে আল্লাহর কোনো সংস্রব নেই। কারণ তারা নিজেদের সুখ-শান্তির জন্য আল্লাহর ইবাদত করে থাকে। আল্লাহপাকের দর্শন লাভের চিন্তা তাদের মাঝে নেই। আল্লাহতায়ালার প্রকৃত বান্দা তারাই যারা একমাত্র আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি লাভের জন্য ইবাদত করে থাকে। আল্লাহপাক সন্তুষ্ট হলে জান্নাত নসিব করবেন আর অসন্তুষ্ট হলে দোজখে নিক্ষেপ করবেন, এটাই নিয়ম।
কোরআন হাদিসের আলোকে একথা দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে, হত্যা এবং আত্মহত্যাকারীদের দুনিয়া এবং আখিরাত দুটোই বরবাদ। এই জঘন্য পাপ কাজকে যারা পুণ্যের কাজ মনে করছে, তাদের জন্য সুরা রুম আয়াত-৩২-এর তাফসিরের অংশবিশেষ উদ্ধৃত করতে চাই। উক্ত আয়াতের তাফসিরের এক জায়গায় বলা হয়েছে, ‘একদিন ইবলিশ তার সাঙ্গোপাঙ্গদের ডেকে বলল, তোমরা আদম সন্তানদের বিভ্রান্ত করার জন্য কিরূপ প্রচেষ্টা চালাও? সাঙ্গোপাঙ্গরা বলল, আমরা যথারীতি প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু সমস্যা হলো একাত্মবাদের সঙ্গে মার্জনার মতো একটি বিষয় জড়িত আছে। আমরা সারাদিন পরিশ্রম করে আদম সন্তানদের দু’চারজনকে পাপ কাজে নিয়োজিত করি। কিন্তু তারা যখন আল্লাহর কাছে মার্জনা প্রার্থনা করে আল্লাহতায়ালা তখন তাদেরকে মাফ করে দেন। একথা শুনে ইবলিশ বলল, ঠিক আছে আমি এমন এক প্রথার প্রচলন ঘটাব যাতে আদম সন্তানরা পাপকে পাপই মনে করবে না বরং পাপকে পুণ্যের কাজ মনে করবে।’ বর্তমানে জঙ্গিরা হত্যা এবং আত্মহত্যাকে সেভাবে পুণ্যের কাজ মনে করছে, তাতে মনে হয় ইবলিশ কামিয়াব হচ্ছে।
এতে মনে হয় শুধু নীতিবাক্য, কোরআন হাদিসের ব্যাখ্যা করে তাদেরকে সঠিক পথে আনা যাবে না। এখন নতুন করে যাতে জঙ্গি সৃষ্টি হতে না পারে সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে মানুষের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। প্রশাসনকে নজরদারি বাড়াতে হবে। বিশেষ করে আলেম সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে।

লেখক : ধর্মচিন্তাবিদ

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads