• রবিবার, ৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪২৯

১৯৭১ সালের ২৩ শে মার্চ ঢাকার রাস্তায় স্বাধীনতার দাবিতে হারপুন হাতে বিক্ষোভ মিছিল

সংবাদ সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস

মতামত

মহান মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো

  • প্রকাশিত ২৬ মার্চ ২০১৮

১৯৭১-এর ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি হানাদারবাহিনী নির্বিচারে হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করে।  ঢাকার পিলখানার ইপিআর ও রাজারবাগের পুলিশ সদস্যরা প্রথমেই প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি এলাকায় হানাদারবাহিনী ধ্বংসযজ্ঞ চালায়।  ওই রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকেও আটক করা হয়।  অবশ্য গ্রেফতার হওয়ার পূর্বেই তিনি মহান স্বাধীনতা ঘোষণার সংক্ষিপ্ত মেসেজ পাঠান বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায়।  ১৯৭১-এর ২৬ মার্চ, স্বাধীনতা ঘোষণা ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয়।  তাই ২৬ মার্চ আমাদের মহান স্বাধীনতা দিবস।  সংগ্রাম কমিটির চালু করা কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে আওয়ামী লীগ নেতা এমএ হান্নান ওই ঘোষণা বার বার পাঠ করেন।  ২৭ মার্চ আওয়ামী লীগ নেতাদের অনুরোধে বাঙালি সেনা কর্মকর্তা মেজর জিয়াও কয়েকবার ঘোষণাটি পাঠ করেন।  হানাদারবাহিনীর অপারেশন সার্চলাইট ছিল অবাধ্য বাঙালিদের চিরতরে স্তব্ধ করার এক ঘৃণ্য নীলনকশা বাস্তবায়নের অপচেষ্টা।  হানাদারবাহিনীর গতিরোধ এবং প্রতিরোধ করার জন্য দেশের প্রধান প্রধান সড়কে ব্যারিকেডসহ অবরোধ সৃষ্টি করা হয়।  কোনো কোনো জায়গায় স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাসহ সাধারণ মানুষ ব্যূহ রচনা এবং গতিরোধ ও প্রতিরোধ যুদ্ধও শুরু করেন।  তবে দেশের যেসব এলাকায় হানাদারবাহিনীর অভিযান চলেছিল, সেখানে তারা জ্বালাও-পোড়াও নীতি অবলম্বন করে।  এ-সময় পাকিস্তানপ্রেমী জামায়াতে ইসলামী ও মুসলিম লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীরা ধর্মীয় ফতোয়া দিয়ে শান্তি কমিটির ব্যানারে মুক্তিকামী জনতার ঘরবাড়ি, মালপত্র লুটপাট করতে থাকে।  সে সঙ্গে গণিমতের মাল আখ্যা দিয়ে নারীদের ওপর নির্যাতন করতে থাকে।  বিশেষ করে হিন্দু ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ঘরবাড়ি, মালপত্র ও নারীরা ছিল তাদের টার্গেট।  পরিস্থিতি এমন ভয়ঙ্কর ও জটিল আকার ধারণ করে যে, লাখ লাখ মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে বউ-ছেলেমেয়ে নিয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।  হানাদারবাহিনীর এদেশীয় দোসরদের ভয়ে পালিয়ে বেড়ানোও নিরাপদ ছিল না। তাই গৃহত্যাগী ভীতসন্ত্রস্ত মানুষগুলো প্রতিবেশী দেশ ভারতে পাড়ি জমায়।

 

মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক প্রতিরোধগুলো ভেঙে পড়ার পর অনেক মুক্তিযোদ্ধা অস্ত্রের সন্ধানে ভারতে পাড়ি জমাতে থাকেন। এমতাবস্থায় একসময় আসে ১৯৭১-এর ১৭ এপ্রিল।  ওই বিশেষ দিনটি মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।  ওই দিন মেহেরপুরের তদানীন্তন বৈদ্যনাথতলার আমবাগানে স্বাধীন বাংলার বিপ্লবী সরকার শপথ গ্রহণ করে।  এ কারণে ওই জায়গাটির নাম রাখা হয় মুজিবনগর।  অতঃপর ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্ব পায় জায়গাটি।  বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি।  তার অনুপস্থিতিতে উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী, এম মনসুর আলী অর্থমন্ত্রী এবং মো. কামরুজ্জামান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন।  পরে কিছুদিন খন্দকার মোশতাক আহম্মদ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।  স্বাধীন বাংলার বিপ্লবী সরকার ভারত সরকারের সাহায্য সহযোগিতা কামনা করে। ইতোমধ্যে প্রায় কোটির ওপর শরণার্থীর বিরাট বোঝা ভারত সরকারের ঘাড়ে চেপে বসে।  বাংলাদেশের সীমান্তঘেঁষা ভারতের জেলাগুলোতে অসংখ্য শরণার্থী শিবিরে তারা মানবেতর জীবনযাপন করতে থাকে।  অনির্দিষ্টকাল ওই বিরাট বোঝা বহন করা ভারত সরকারের পক্ষে সম্ভব ছিল না।  তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারত সহায়তার হাত বাড়াতে সম্মত হয়।

 

এরপর ভারতীয় সেনাবাহিনীর সরাসরি তত্ত্বাবধানে গড়ে উঠতে থাকে মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ ক্যাম্প।  এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে বাংলাদেশের সীমান্তঘেঁষা উল্লেখযোগ্য স্থানগুলোতে অসংখ্য প্রশিক্ষণ ইয়ুথক্যাম্প গড়ে ওঠে।  ওইসব ক্যাম্পে প্রাথমিক প্রশিক্ষণের পর হাজার হাজার ছাত্র-যুবা-ইপিআর জোয়ান-পুলিশ ও রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যান।  সেসব স্থানে মাত্র ২৮ হতে ৪২ দিনের ট্রেনিং শেষে হালকা অস্ত্রসহ তাদের বাংলাদেশে পাঠানো হয়। গেরিলা যুদ্ধের সাধারণ নিয়মানুসারে 'হিট অ্যান্ড রান' পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়।  প্রথমে পাকিস্তানিবাহিনীর বিভিন্ন ক্যাম্পে অতি গোপনে গ্রেনেড ছুড়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করা হয়।  তাই প্রাথমিক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে গ্রেনেড ও স্টেনগানের মতো হালকা অস্ত্র ছিল।  বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ চলছে, এটা বিশ্ববাসীকে অবহিত করাই ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাথমিক উদ্দেশ্য।

 

মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুনানিকালে বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি এস. কে সিনহার মন্তব্য, এই জাতিবিরোধী নৃশংস অপরাধীরা সহযোগিতা না করলে হানাদার পাকিস্তানিবাহিনীর পক্ষে এ দেশে তিন মাসের বেশি টিকে থাকা সম্ভব ছিল না।  এ কথা সত্য, ভয়ঙ্কর ওই পিশাচদের ভয়ে দিনের বেলায় মুক্তিযোদ্ধারা চলাফেরা করতে পারতেন না। গোপন শেল্টারে সময় কাটাতে হতো।  এভাবেই দীর্ঘ নয় মাস চলে মহান মুক্তিযুদ্ধ।  সীমান্ত এলাকায় পাকিস্তানিবাহিনীর ঘাঁটিগুলোর আশপাশে রাতের আঁধারে অ্যামবুশ পদ্ধতির হিট অ্যান্ড রান কৌশলে যুদ্ধ চলে প্রথম পর্যায়ে।  এ ধরনের যুদ্ধের প্রয়োজনে জুলাই মাসের মধ্যভাগ হতে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে এলএমজি, এসএলআর ও দুই ইঞ্চি মর্টারও চলে আসে। সম্মুখযুদ্ধগুলোর জন্য ভারী অস্ত্রের ব্যবহার ছিল অবধারিত।  ভেতর এলাকায় গেরিলা পদ্ধতির যুদ্ধেও শেষের দিকে ভারী অস্ত্রের জোগান দেয় ভারতীয়বাহিনী।  বিএলএফ নামক স্পেশালবাহিনীর ওপর একটি বাড়তি রাজনৈতিক দায়িত্ব অর্পণ করা হয়।  তাহলো দেশের অভ্যন্তরের স্থানীয় যুবকদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করা, সংগঠিত করা এবং ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করে হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া।

 

১৯৭১-এর ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে ভারত সরাসরি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয়বাহিনীর যৌথ অভিযান শুরু হয় ৩ ডিসেম্বর হতে।  সে সঙ্গে ভারতীয় বিমানবাহিনী পাকি-সেনাক্যাম্পগুলোর ওপর বার বার বোমাবর্ষণ করে।  ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় ৬ ডিসেম্বর।  ইতোমধ্যে বিভিন্ন দিক দিয়ে অগ্রসর হয়ে যৌথবাহিনী ঢাকা অবরোধ করে ফেলে।  ভারতীয় বিমানবাহিনীর প্রথম আঘাতেই পাকি-বিমানগুলো ধ্বংস হয়ে যায়।  তারপর ভারতীয় কার্গোবিমান হতে ছত্রীসেনা ঢাকাসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে অবতরণ করতে থাকে।  সে সঙ্গে ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল শ্যাম মানিক শাহ পাকিস্তানিবাহিনীকে আত্মসমর্পণের জন্য আকাশবাণী থেকে বার বার আহ্বান জানান এবং বিমান হতে লিফলেট ছড়ানোর ব্যবস্থা করেন।  ফলে পাকিবাহিনী দিশাহারা হয়ে পড়ে।

 

অবশেষে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১।  ৯৩ হাজার সৈন্যসহ পাকিবাহিনীর অধিনায়ক আত্মসমর্পণে বাধ্য হন। বাংলাদেশ বহিঃশত্রুমুক্ত হয়। এ কারণে ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস হিসেবে যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে প্রতিবছর জাতীয়ভাবে পালিত হয়ে আসছে।  পাকিবাহিনীর এদেশীয় দোসরদের অনেকে ধরা পড়ে।  আবার অনেকে আত্মগোপন করে। যৌথবাহিনী বা মিত্রবাহিনীর সর্বাধিনায়ক ভারতীয়বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লে. জে. জগজিৎ সিং অরোরার নিকট হানাদার পাকিবাহিনীর অধিনায়ক লে. জে. আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজী অস্ত্রসমর্পণ ও আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করেন। জে. নিয়াজী কোমর হতে একটি রিভলভার বের করে দু’হাতে তুলে ধরে অবনত মস্তকে জে. অরোরার হাতে তুলে দেন। এই আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর মানচিত্রে জন্ম হয় বাংলাদেশের।  বাঙালি জাতিকে এক সাগর রক্তসহ অনেক বেশি মূল্য দিয়েই বাংলাদেশ স্বাধীন করতে হয়।  এই স্বাধীনতা সমুন্নত রাখা আজ আমাদের প্রদান দায়িত্ব।

 

লেখক : আব্দুল খালেক মন্টু (মুক্তিযোদ্ধা ও প্রাবন্ধিক)

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads