• শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ৪ জৈষ্ঠ ১৪২৯

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

মতামত

পুঁজিবাদ এগুচ্ছে বৈকি

  • প্রকাশিত ২৭ মার্চ ২০১৮

পুঁজিবাদের নির্লজ্জ বর্বরতার প্রমাণ এখন যত্রতত্র পাওয়া যাচ্ছে। মিয়ানমারে যেমন প্যালেস্টাইনেও তেমনি। ইহুদিরা একদা নাৎসিদের হাতে ভয়াবহ গণহত্যার এক কর্মসূচির শিকার হয়েছিল। স্মরণ করলে গা শিউরে ওঠে। পুঁজিবাদী বিশ্ব ইচ্ছা করলে ইহুদিদের নিজেদের বিস্তৃত সাম্রাজ্যের যে কোনো একটা এলাকায় পুনর্বাসিত করতে পারতো। ইহুদিরা কোনো এক জায়গাতে ছিল না, ছড়িয়ে ছিটিয়েই ছিল। কিন্তু পুঁজিবাদী বিশ্ব ঠিক করলো তাদের এনে রাখবে আরবভূমিতে। সেজন্য প্যালেস্টাইনের নিরীহ মানুষ উৎখাত হলো এবং ইসরায়েল সেখানে আস্ত একটি রাষ্ট্র কায়েম করে ফেললো। প্যালেস্টাইনবাসী কোনো অপরাধ করেনি, কিন্তু তারা যে তাদের ভূমিতে আছে সেটাই হয়ে দাঁড়াল তাদের জন্য মস্তবড় অপরাধ; অবিকল সেই অপরাধ যা মেষশাবকটি করেছিল। অভাগা প্যালেস্টাইনবাসী দখলদার ইসরায়েলকে প্রথমটায় রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকার করতে চায়নি, না-চাওয়াটা ছিল খুবই স্বাভাবিক। তারা যুদ্ধ করেছে। কিন্তু পুঁজিবাদীরা সবাই ইসরায়েলের পক্ষে; বেচারা প্যালেস্টাইনবাসী পারবে কেন? নিরুপায় হয়ে ইসরায়েলকে তারা মেনে নিয়েছে; বলেছে, ঠিক আছে, তোমরাও থাকো, আমরাও থাকি। দুটো রাষ্ট্রই থাক। মনের ভেতরে যা-ই থাকুক না কেন, আমেরিকাও মুখে ওই ব্যবস্থাকেই সমাধান বলে জানিয়েছিল। কিন্তু ইসরায়েল তা মানবে কেন? সে কম কিসে? পুঁজিবাদী তো! সবসময়েই তার ইচ্ছা ছিল একচ্ছত্র রাষ্ট্র কায়েম করা, প্রয়োজনে প্যালেস্টাইনীয়দের নিজ ভূমিতে দাসে পরিণত করা। এখন ডোনাল্ড ট্রাম্পকে সে পেয়ে গেছে বন্ধু হিসেবে। বন্ধু বলেছেন তেলআবিব নয়, জেরুজালেমই হবে ইসরায়েলের রাজধানী। অন্য কোনো আমেরিকান প্রেসিডেন্টই এতদূর অগ্রসর হননি। পুঁজিবাদ এগুচ্ছে বৈকি। মধ্যপ্রাচ্য কতটা উত্তপ্ত হবে, তার তাপে মানুষের কতটা ক্ষতি হবে, বর্ণবাদ ও ধর্মীয় মৌলবাদ কতটা উৎসাহ পাবে পুঁজিবাদের জন্য এসব কোনো বিবেচনার বিষয়ই নয়। ওদিকে পুঁজিবাদী ইসরায়েলিরা যে কতটুকু পূতপবিত্র বোঝা যায় তাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বেনজামিন নেতানিয়াহুর আচরণ থেকে। দুর্নীতির দায়ে তার বিচার হচ্ছে, তার দেশীয় আদালতেই।

ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন এলেন তখন মনে হয়েছিল নতুন পাগলের আগমন; পরে বোঝা গেল পাগল বটে, তবে সেয়ানা। জাত ব্যবসায়ী, কোথা থেকে কতটা মুনাফা আসবে ঠিকই বোঝেন। মধ্যপ্রাচ্যে জর্জ বুশের তৎপরতা দেখে লোকে বলাবলি করেছিল যে হিটলার ফিরে এসেছে, নতুন বেশে; তবে শেষ পর্যন্ত এটাও প্রমাণিত হয়েছিল যে ইতিহাসে এক বীর দুইবার আসে না, দ্বিতীয়বার আসতে চাইলে তাকে আসতে হয় ভাঁড় হিসেবে।

পুঁজিবাদের এই পতনকালে দেখা যাচ্ছে তাদের এই নতুন কর্তা আগেরজনদের নানাভাবে লজ্জায় ফেলে দিচ্ছেন। বুশ অধোবদন হয়েছেন ট্রাম্পের লম্ফঝম্প হম্বিতম্বির কাছে। তিনিও বলছেন, না, বাড়াবাড়ি হচ্ছে। হোয়াইট হাউজে ঢুকেই ট্রাম্প ঘোষণা দিয়ে ফেলেছেন মুসলমানদের ওপর চোখ রাখতে হবে এবং তাদের সহজে আমেরিকায় ঢুকতে দেওয়া যাবে না। ঘোষণা শেষ করেই প্রথম যে দেশে তিনি ছুটলেন সেটি হচ্ছে মুসলমানদের খাস ভূমি বলে চিহ্নিত সৌদি আরব। সেখানে গিয়ে বাদশাহর সাথে কোলাকুলি করতে তার আটকালো না। আসল উদ্দেশ্য ছিল অস্ত্র বিক্রি। কোলাকুলির ফাঁকে অস্ত্র বিক্রির ব্যাপারে এমন বড় একটা চুক্তি সই করিয়ে নিলেন যেমনটা নাকি আগে কখনো সই হয়নি। বাদশাহ ভাবলেন মস্ত উপকার হলো। প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারবেন। কার বিরুদ্ধে ব্যবহার করবেন? শত্রু কে? বিধর্মী, মুসলমান-বিদ্বেষী ইসরায়েল কি শত্রু? বালাই ষাট। ইসরাইল তো খাঁটি দোস্ত। খাঁটি পুঁজিবাদী। শত্রু হচ্ছে ইরান; বশ্যতা মানে না, বেয়াদবি করে!

ট্রাম্পের সৌদি আরব সফর সফল, সম্পূর্ণ সফল হয়েছে। মুনাফার গন্ধ পেয়েছিলেন, মুনাফার ব্যবস্থা হয়েছে। আমেরিকার অস্ত্র ব্যবসায়ীরা ভালো ব্যবসা পাবে। এটা এমন এক ব্যবসা যাতে মুনাফার কোনো অবধি নেই। টাকা আসবে, অস্ত্র কারখানায় লোকে কাজ পাবে। বুশ যে ইরাক দখল করেছিলেন তার পেছনে একাধিক অনুপ্রেরণা ক্রিয়াশীল ছিল। ইরাকের তেলের ওপর কর্তৃত্ব অর্জন, মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে অবস্থান শক্ত করা; নতুন ঘাঁটি স্থাপন, এসব ছিল; কিন্তু সবচেয়ে বড় প্রেরণাটা এসেছিল ব্যবসার লোভ থেকেই। যুদ্ধ বাধাতে পারলে অস্ত্র বিক্রি হবে, তাতে অর্থনীতি চাঙ্গা হবে। আবার ইরাককে যদি ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা যায় তাহলে পুনর্নির্মাণ কাজও শুরু করতে হবে, বলাবাহুল্য ইরাকের টাকাতেই এবং সে কাজ আমেরিকানরাই করবে, তাদের শর্তে। এমনকি জাদুঘরে-রাখা সভ্যতার নিদর্শনগুলোই বা কম কিসে, বিক্রি হবে দু পয়সা আসবে। যা যা পাওয়া গেছে সবই হাতিয়ে নেবে ঠিক করেছিল। নিয়েছেও।

বুশ আওয়াজ দিয়েছিলেন যে সাদ্দাম হোসেনের হাতে ওয়েপনস অব মাস ডেস্ট্রাকশন আছে; তাই অবিলম্বে ওই হাত ভেঙে দেওয়া চাই, তা না হলে সে মানুষ মেরে শেষ করবে। বুশ বিলক্ষণ জানতেন যে ওরকম অস্ত্রশস্ত্র ইরাকের কাছে মোটেই ছিল না। অজুহাত তো একটা চাই, তাই দাঁড় করানো। মনে নেই, গল্পের নেকড়ে মেষশাবককে কী বলেছিল? বলেছিল, তুই আমার খাবার পানি ঘোলা করছিস কেন? মেষশাবক জানিয়েছিল, ‘আমি তো ঝর্ণার নিচের দিকে আছি, উপরের পানি ঘোলা করবো কী করে?’ নেকড়ে বলেছিল, ‘গত বছর তুই আমার বাবাকে অপমান করেছিলি।’ মেষশাবকটি জানিয়েছিল যে তখন তার জন্মই হয়নি। নেকড়ে বলেছিল, ‘ভারি তর্ক শিখেছিস। ওতে কাজ হবে না। আমি তোকে খাবো।’ বুশেরও একই কথা, মানববিধ্বংসী অস্ত্র নেই বলছিস। বললেই হলো? আমার গোয়েন্দারা বলছে লুকিয়ে রেখেছিস, আমার বিশ্বস্ত বন্ধু প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারও অতি গোপন সূত্রে খবর পেয়েছেন অস্ত্র আছে; এসব নিয়ে এত তর্ক কিসের? এরপর গল্পের নেকড়েটির যা করার কথা বাস্তবের বুশ সাহেব হুবহু তা-ই করেছেন। গল্পের নেকড়েটি একাই ছিল, সঙ্গীর দরকার পড়েনি, ইতিহাসে বুশের সাঙ্গপাঙ্গোরা ছিলেন, তারা আহ্লাদিত হয়েছেন, সবচেয়ে কাছে ছিলেন যিনি তিনি তো মনে হয় লাঙলই নেড়েছেন। ইতিহাস এমনটাই বলছে।

ইতিহাস অবশ্য এও বলে যে, ওই তৎপরতার পরিণতিতে একটি অত্যন্ত সমৃদ্ধ জনপদ সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে, হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, লক্ষ লক্ষ মানুষ উৎপাটিত হয়ে উদ্বাস্তুদের দলে নাম লিখিয়েছে। মুনাফাখোরদের কোনো ক্ষতি হয়নি, লাভ ছাড়া। সাদ্দাম হোসেনকে হত্যা করতে গিয়ে যে শিয়া-সুন্নি-কুর্দি বিরোধকে চাঙ্গা করা হয়েছে, ইসলামিক স্টেট বাহিনী তৈরি করা হয়েছে তাতেও মুনাফা আছে, বিরোধে-লিপ্ত সকলপক্ষের কাছেই অস্ত্র বিক্রি করা গেছে। বাজার খুঁজতে হয়নি, বাজার পড়ি-তো-মরি দৌড়ে এসে হাজির হয়েছে।

পুঁজিবাদের মুনাফালিপ্সাতে দুই দুইটি বিশ্বযুদ্ধ হয়েছে। ভাগবাঁটোয়ারার টানাহেঁচড়াতে পুঁজিওয়ালারাই বাধিয়েছে যুদ্ধ। মারা পড়েছে নিরীহ মানুষ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে পুঁজিবাদী হিসেবে আমেরিকার আবির্ভাব। জয় দেখাতে পারেনি, তবে ভয় দেখাতে ছাড়েনি। যুদ্ধ যখন শেষ হয় গেছে, জার্মানরা পর্যুদস্ত, জাপানিরা বিপর্যস্ত, সেই সময়ে আমেরিকা নিজের সদ্য-উদ্ভাবিত আণবিক বোমা ফেললো জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে গিয়ে। লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা গেল, জীবিতরা পঙ্গু হয়ে পড়ল, ধ্বংস হলো প্রকৃতি, নগর ও পরিবেশ। বর্বরতা জাপানি সৈন্যরাও অবশ্য কম করেনি। কিন্তু আমেরিকার রাষ্ট্রশাসকদের কাছে তা হার মেনেছে। আকাশপথে উড়ে এসে নিরপরাধ মানুষ হত্যার অমন কাজ জাপানিরা করতে পারেনি। কেন ফেললো ওই বোমা? ভুল করে? মোটেই না, ফেললো স্থির সিদ্ধান্ত নিয়েই। সিদ্ধান্তের পেছনে অনুপ্রেরণা ছিল। প্রথম অনুপ্রেরণা ভয় দেখানোর। জাপান পরাজিত হয়েছে, কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন তো আছে। ভয় দেখানো চাই সোভিয়েত ইউনিয়ন ও তার মিত্র সমাজতন্ত্রীদের। আমেরিকা অস্থির; নেতৃত্ব কেড়ে নেবে পুঁজিবাদী বিশ্বের; তার প্রতি চ্যালেঞ্জ অন্য কোথাও থেকে আসবে না, আসবে শুধু সমাজতন্ত্রী সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে, যে নাকি বুকেপিঠে লড়াই করে হিটলারকে রুখে দিয়েছে, মহাপ্রলয় থেকে রক্ষা করেছে বিশ্বকে। জাপানিদের মেরে আমেরিকা ভয় দেখালো সমাজতন্ত্রীদের, বলে দিলো আমার হাতে যে অস্ত্র আছে অন্য কারো হাতে তা নেই। বোমা ফেলার দ্বিতীয় অনুপ্রেরণা, নতুন মারণাস্ত্রটির ক্ষমতা পরীক্ষা করে দেখা। সেটাও দরকার ছিল; শত্রুকে ভয় পাইয়ে দেওয়ার জন্য যেমন তেমনি নিজের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করার জন্যও বৈকি। সাফল্যের সঙ্গে বোমা ফাটিয়ে আমেরিকা জানিয়ে দিল পুরনো পুঁজিবাদী জার্মানি ও জাপানকে হটিয়ে দিয়ে এসেছে এখন নতুন এই পুঁজিবাদী, যে কি না অনেক বেশি সুসজ্জিত—মারণাস্ত্রে। পুঁজিবাদের জন্য ভয়ের কিছু নেই, সমাজতন্ত্র তাকে কাবু করতে পারবে না। কাজটা করতে গিয়ে অসংখ্য নিরীহ নিরপরাধ মানুষের যে প্রাণ গেল, ক্ষতি হলো অপরিমেয়, তাতে কি আসে যায়?

 

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী 

লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় 

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads