মানি লন্ডারিং চলছে উন্নয়নশীল কয়েকটি দেশ থেকে। বিদেশে অর্থ পাচার রোধে চীন, ভারত, ফ্রান্সসহ কয়েকটি দেশ কঠোর আইন প্রণয়ন করলেও পরিস্থিতি যে তিমিরে ছিল সেখানেই আছে। গত তিন বছরে ভারত থেকে প্রায় ২৩ হাজার ধনবান ব্যক্তি দেশ ছেড়েছেন। সবচেয়ে বেশি মিলিওনিয়ার নিজ নিজ দেশ ছেড়ে নিরাপদ দেশে আশ্রয় নিয়েছেন গত বছর।
এখানে উল্লেখ্য, ধনাঢ্য ব্যক্তি (মিলিওনিয়ার) তারাই যাদের দশ লাখ ডলার সমমূল্যের সম্পদ আছে। গত চার বছরে এমন প্রায় এক লাখ ধনাঢ্য ব্যক্তি চীন ছেড়ে নিরাপদ দেশে পাড়ি জমিয়েছেন। গত বছর ভারত ছেড়ে পালিয়েছেন ৭ হাজার মিলিওনিয়ার। অর্থ পাচার রোধে ভারত এবং চীনে কঠোর আইন তৈরি করায় মানি লন্ডারিং এবং ধনাঢ্যদের দেশ ত্যাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। ‘অর্গান স্টেইনলি’ নামের একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সাম্প্রতিক জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে। বাংলাদেশের বহু কালো টাকার মালিক টাকা পাচার করে বিদেশে পাড়ি জামিয়েছেন। সুইজারল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, হংকং, আমেরিকা, ব্রিটেন, থাইল্যান্ডের ব্যাংকে বাংলার টাকা ডলারে রূপান্তরিত হয়ে জমা হয়েছে এমন খবর আমরা সংবাদমাধ্যমে অবহিত হলাম। এমন ধনাঢ্য ‘অভিবাসী’ বিশ্বে প্রায় পাঁচ লাখ। সবচেয়ে বেশি অভিবাসী চীনের। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ভারত, তৃতীয় অবস্থান ফ্রান্সের। চীন এবং ভারত থেকে পালিয়ে যাওয়া অভিবাসীর সংখ্যা ইদানীং বাড়ার কারণ দেশ দুটিতে দুর্নীতির বিচার কঠোর ও জোরদার করা হয়েছে। ‘মানি লন্ডারিং প্রিভেনশন’ আইন কঠোর করার সিদ্ধান্তে দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ, আমলা, ব্যবসায়ীরা তাদের সম্পদ বিদেশে পাচার করাকেই নিরাপদ মনে করছেন। একই সঙ্গে তারা সপরিবারে দেশ ত্যাগ করে নিরাপদ দেশে চলে যাচ্ছেন।
অর্থ পাচারে বাংলাদেশের অবস্থান ৪৪তম। চীন প্রথম নম্বরে। ভারত-পাকিস্তানের অবস্থান দশের মধ্যে। বাংলাদেশ, ভারত, চীন প্রভৃতি দেশের বড় বড় ব্যবসায়ী এবং রাজনীতিবিদ দেশ থেকে অর্থ পাচার করে বিদেশে সেকেন্ড হোম করেছেন। কেউ অর্থ পাচার করে সপরিবারে দেশত্যাগ করেছেন, কেউ আবার নিজে অথবা সন্তানের মাধ্যমে দেশের ব্যবসা ও সম্পদ দেখভাল করছেন। সারা বিশ্বের ডলার মিলিওনিয়াররা ২০১৪ সাল থেকে স্ব-স্ব দেশ ত্যাগ করে নিরাপদ দেশে বসতি গড়েছেন। আমেরিকার একটি সংস্থার জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
বাংলাদেশে মানি লন্ডারিং আইন সংশোধন করার পরও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। কারণ আইনের যথাযথ প্রয়োগ নেই। ১৯১৫ সালে করা এই আইনে (মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন) অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, দুর্নীতি, ঘুষ, মুদ্রা ও দলিল-দস্তাবেজ জালকরণ, চাঁদাবাজি, প্রতারণা, জালিয়াতি, অবৈধ অস্ত্র ব্যবসা, চোরাই অন্যান্য অবৈধ ব্যবসাসহ ২৮টি অপরাধ। মুদ্রা পাচার আইনে ৪ থেকে ১২ বছর কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। সংশোধিত আইনে জরিমানার পরিমাণ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। হতাশার কথা হলো, বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন ব্যাংক-বীমা প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতির তদন্ত করতে পারবে না, এমন আইন করা হয়েছে। যা দুর্নীতি প্রতিরোধে বা অর্থ পাচার রোধে অন্যতম প্রতিবন্ধকতা। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে হ্যাকাররা চুরি করেছে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার। যা পাওয়া যায়নি বা উদ্ধার করা যায়নি।
চীন এবং ভারতে দুর্নীতির বিচার জোরদার করায় ‘অভিবাসী’র সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থ পাচারকারীদের গ্রেফতারের জন্য চীন সরকার শুরু করেছে ‘অপারেশন ফক্স হান্ট’ অভিযান। যারা চীন থেকে অর্থ পাচার বা স্থানান্তর করে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন তাদেরকে চীন সরকার ‘পলাতক’ চিহ্নিত করে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য অভিযান শুরু করেছে। অর্থ পাচারকারীদের চীন সরকার ধূর্ত হিংস্র খেঁকশিয়ালের সঙ্গে তুলনা করেছে। চীন বিভিন্ন দেশে অভিবাসীদের বিষয়ে গোপন অভিযান শুরু করে তথ্য সংগ্রহ করছে। আমেরিকা এ ব্যাপারে গোপন তৎপরতা না চালানোর জন্য চীনকে সতর্ক করে দিয়েছে।
চীন এবং ভারত সরকার মনে করে, এভাবে যদি দেশের ধনপতিরা দেশ ত্যাগ করে চলে যেতে থাকে, তা হলে দেশ একসময় অর্থনৈতিক ঝুঁকিতে পতিত হবে। এ কারণে দু’দেশের সরকার বিষয়টিকে খুবই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে।
ভারতে সরকার আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে কঠোরতা অবলম্বন করছে। ‘মানি লন্ডারিং প্রিভেনশন’ আইনটি আরো শক্ত করা হয়েছে। আইনের প্রয়োগও হচ্ছে। সম্প্রতি একজন ডায়মন্ড ব্যবসায়ী কয়েক হাজার কোটি রুপি নিয়ে বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন। মুম্বাইয়ের এক ডায়মন্ড ব্যবসায়ী প্রায় ১২ হাজার কোটি ভারতীয় রুপি নিয়ে দেশ ছেড়েছেন। আইন জোরদার করার পরও ভারত থেকে অর্থ নিয়ে পালাচ্ছেন বড় বড় ব্যবসায়ীরা। চীন, বাংলাদেশ, ফ্রান্স এবং ভারতের ধনকুবেরদের পছন্দের দেশ আমেরিকা, জার্মান, অকল্যান্ড, ইংল্যান্ড, মন্ট্রিল, ইজরাইল, ক্যানাডা, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, দুবাই এবং সুইজারল্যান্ড।
ভারতে দুর্নীতির দায়ে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী লালু প্রসাদ যাদবের জেল হয়েছে, উত্তর প্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জয় ললিতাকেও দুর্নীতির মামলায় জেল খাটতে হয়েছিল। প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী চিদাম্বরমের পুত্র কার্তিক চিদাম্বরমের বিচার হচ্ছে, কংগ্রেসের সাবেক সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধীর বিরুদ্ধে ‘ন্যাশনাল হেরাল্ড’ মামলা চলছে।
বিশ্ব অর্থনীতির দুই উদীয়মান শক্তি চীন এবং ভারত চিন্তিত ও শঙ্কিত, যে হারে এবং যে কায়দায় ধনাঢ্য ব্যবসায়ীরা দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছেন তাতে দেশের সুনাম নষ্ট তো হচ্ছেই; সেই সঙ্গে দেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়ছে।
চট্টগ্রামের একজন বড় ব্যবসায়ী সম্প্রতি ব্যাংকের প্রায় শত কোটি টাকা ঋণ রেখে এবং বিভিন্ন ব্যবসায়ীর প্রায় ৭০ কোটি টাকা মেরে দিয়ে মালয়েশিয়া পাড়ি জমিয়েছেন সপরিবারে। সম্প্রতি নাটোরের বনপাড়া বাজারের একজন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী প্রায় শত কোটি টাকার সম্পদ নিয়ে বিদেশ পাড়ি দিয়েছেন সপরিবারে। ঋণ খেলাপি এবং কালো টাকার মালিকরাই এভাবে দেশ ত্যাগ করছে কোটি কোটি টাকা নিয়ে। এর আগেও এমন খবর সংবাদপত্রে পড়েছি।
বিদেশি ব্যাংকে টাকা রাখা খুবই সহজ বিষয়। বিশেষ করে, কিছু দেশ বিদেশি ধনকুবের বা মিলিওনিয়ারদের টানতে সে দেশে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট করার সহজ পদ্ধতির উদ্ভব করে সুযোগ করে দিয়েছে। এভাবে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা ওইসব সংশ্লিষ্ট দেশে জমা হওয়ায় তাদের অর্থনীতি চাঙ্গা থাকছে। অভিবাসী ব্যাংক অ্যাকাউন্ট হোল্ডারদের বিষয়টিও সযত্নে গোপন রাখা হচ্ছে। এতে লন্ডারিংকারীরা নিরাপদ বোধ করে থাকেন।
আমদানিতে ওভার ইনভয়েসিং করে বা কারচুপি করে এবং রফতানিতে আনডার ইনভয়েসিং কারচুপি করে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা পাচার হচ্ছে। জনতা ব্যাংকের দুটি শাখা থেকে আমদানি ঋণকে রফতানি ঋণে পরিণত করে প্রায় চারশ’ কোটি টাকা পাচারের খবর আমরা সংবাদপত্রে পড়েছি। এভাবে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে শত শত কোটি টাকা পাচার হয়ে গেছে। যার তদন্ত অব্যাহত আছে। জানি না এইসব তদন্তের নথিপত্র আলোর মুখ দেখবে কি না!
বাংলাদেশের দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ, ঘুষখোর আমলা, অসৎ ব্যবসায়ী টাকার চালান পাঠাচ্ছে বিদেশে। যাকে বলা হয় লন্ডারিং। বিদেশে সেকেন্ড হোম আছে এ দেশের বহু দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ আমলা ও ব্যবসায়ীর। বিদেশি ব্যাংকে অর্থ আছে এ দেশের বহু ধনপতির। আমরা জানি, সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে অর্থ জমা রাখা সবচেয়ে নিরাপদ। সেখানে অর্থ রাখা শতভাগ গ্যারান্টি। এ ছাড়াও সুইস ব্যাংকসমূহ অ্যাকাউন্ট হোল্ডারের নাম-ঠিকানা কঠোরভাবে গোপন রাখে। এমনকি কোনো দেশের সরকার চাইলেও তা দেওয়া হয় না। এ কারণেই সারা বিশ্বের অবৈধ অর্থ-বিত্ত আয়কারীরা নির্বিঘ্নে তাদের অর্থ সুইস ব্যাংকে জমা রাখতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। বাংলাদেশিদের প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা সুইস ব্যাংকে জমা রয়েছে- এই মর্মে বিদেশি সংবাদপত্রে খবর প্রকাশিত হয়। দুদক এ ব্যাপারে তদন্ত শুরু করেছে। ভারতীয় নাগরিকদের কয়েক লাখ কোটি রুপি সুইস ব্যাংকসমূহে গচ্ছিত আছে- এমন খবরে ভারত সরকার নড়ে-চড়ে বসেছে। তদন্ত শুরু হয়েছে।
‘পানামা পেপারস কেলেঙ্কারি’তে বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন ধনকুবেরের নাম প্রকাশিত হয়েছে যারা বিদেশে অর্থ পাচার করেছেন। শুধু তাই নয়, এ দেশের সাবেক মন্ত্রী, আমলারাও আছেন ওই তালিকায়। দুদক নাকি এসব বিষয়ে নাক গলাতে পারবে না। এমনই বিধান করা হয়েছে!
আমাদের চেনা-জানা অনেকের সম্পর্কেই এমন অভিযোগ আছে যে, তারা বিদেশে বাড়ি করেছেন। এ দেশে উপার্জিত অর্থ বিদেশে পাচার করে যে দেশে অভিবাসী হয়েছেন সেখানে চুটিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন। সন্তানদের বিদেশের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে এ দেশে ব্যবসা করছেন, রাজনীতি করছেন, চাকরি করছেন এমন ব্যক্তির সংখ্যা কয়েক লাখ।
এই লেখাটি যখন শেষ করছি তখন আজকের সংবাদপত্রে খবর পড়ে জানলাম, বাংলাদেশের গোয়েন্দা সূত্রের তথ্য মতে দেশে চোরাকারবারী এবং টাকা পাচারকারীর সংখ্যা ছয় শতাধিক। চিহ্নিত ৬শ’ ২০ জন এমন দুষ্কর্মকারীকে আইনের আওতায় আনার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
আমরা আশায় বুক বাঁধছি। কারণ সোনার বাংলা গড়তে বঙ্গবন্ধু বহু চেষ্টা করেছেন, দুর্নীতিবাজ, অসৎ ব্যক্তি এবং চোরদের বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার ছিলেন। তার পরেও এ দেশে থেকে দুর্বৃত্তরা এখন লুটপাটে ব্যস্ত। তাদের না রুখতে পারলে দেশ-জাতি মহাবিপর্যয়ে পড়বে।
হাবিবুর রহমান স্বপন
লেখক : সাংবাদিক
hrahman.swapon@gmail.com