• শুক্রবার, ৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪২৯

রাজনীতি

‘পথিক, তুমি পথ হারাইয়াছ?’

  • আফজাল বারী
  • প্রকাশিত ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাসটি পড়া থাকুক বা না থাকুক, উপন্যাসের একটি লাইন অনেকেরই জানা। ‘পথিক, তুমি পথ হারাইয়াছ?’ এমনই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপির বর্তমান কান্ডারির ক্ষেত্রে। সে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না, কোন পথে এগোবে, আগামী দিনের রাজনীতি কী হবে— তা স্থির করতে পারছে না বিএনপি। দায়সারা কর্মসূচি দিয়ে ঢিলেঢালাভাবে এগিয়ে চলছে দলটি। সময়ক্ষেপণ করছে। অতীতের একাধিক নির্বাচনে ভরাডুবি, আগামীতে নির্বাচন-আন্দোলন প্রশ্নে নীতি ঠিক করতে সর্বশেষ বুধবার রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেছেন নীতিনির্ধারকরা। বৈঠকে স্কাইপিতে যুক্ত ছিলেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান।

গত ১৪ বছর ধরে কর্মীদের প্রশ্নের জবাবে নেতারা বলে আসছেন— ‘অন্ধকারের পরে আলো আসে, অপেক্ষা করতে হবে। ইংরেজ গেছে, পাকিস্তান গেছে, স্বৈরাচার গেছে— এখন যারা আছে তারাও ২২ বছর রাস্তায় ছিল। আমাদের এত সময় লাগবে না, ইনশাআল্লাহ।’

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামের দাবি, রাজনীতি থাকলেই শুধু নীতিনির্ধারণের প্রশ্ন থাকে। দেশে তো রাজনীতিই নেই, কর্তৃত্ববাদী শাসন চলছে। এ পরিস্থিতিতে রাজনীতি করার সুযোগই নেই। তার মতে, বিএনপি একটি উদারপন্থি দল। এর কাছে কেউ বিপ্লব আশা করলে হবে না। এই দল তার নিজস্ব চরিত্র নিয়ে এগিয়ে যাবে। প্রতি মুহূর্তে আন্দোলনের মধ্যে আছি। আমরা কোর্টে যাই, আলোচনা করি, নির্বাচনে যাই সবই আন্দোলনের অংশ।

এদিকে রাষ্ট্রক্ষমতার আশা আপাতত বাদ। একমাত্র চাওয়া মৃত্যুর সঙ্গে লড়াইরত দলীয় প্রধান কারাবন্দি খালেদা জিয়ার মুক্তি। ‘সরকার পতন আন্দোলন’-এর কঠোর সিদ্ধান্ত থেকে দল সরে এসে যখন নমনীয় হয়, নির্বাচন বর্জন করে আবার দলের এমপিরা যখন সংসদে যোগ দেন, বিদেশিদের সঙ্গে ঘন ঘন বৈঠক করে তখন নেতাকর্মীরা খালেদা মুক্তির বিষয়ে আশাবাদী হয়ে ওঠেন। দলের অভ্যন্তরে চাউর হয়— শর্তসাপেক্ষে হয়তো একটা কিছু হচ্ছে। কিন্তু গত দুই বছরই আশা পরিণত হয়েছে হতাশায়। সুড়ঙ্গের কোনায় আলো খুঁজতে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে হাতেগোনা নেতাকর্মী নিয়ে ঝটিকা মিছিল করেন। তবে তাতে অংশ নেন না দলের সিনিয়র নেতারা। এ নিয়েও আছে আলোচনা-সমালোচনা। কেউ কেউ প্রশ্ন করেন— এই মিছিলে কি খালেদার মুক্তি বা সরকার পতন হবে? আবার কারো কারো মতে, অন্তত কিছু একটা তো হচ্ছে। নয়তো খালেদা জিয়া যে কারাবন্দি তা মানুষ ভুলেই যাবে। খালেদা জিয়া কারাবন্দি হওয়ার দুই বছর পূর্তি হবে আগামীকাল।

দলের নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলোর মতে, নীতিনির্ধারণ বিষয়ে বিএনপির মধ্যে যেমন এখনো অনৈক্য বিদ্যমান, তেমনি দলের গতিপথ নির্ধারণ ও চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়েও আছে দ্বিধা। কারণ পরস্পরবিরোধী নেতারা ভিন্ন উদ্দেশ্যে হাঁটছেন। দলের ধনকুবের নেতারা চলছেন শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে সমঝোতা করে, দায়িত্বপ্রাপ্তরা চলছেন গা বাঁচিয়ে, সাধারণ নেতাকর্মীরা ঘুরছেন দিগ্বিদিক। দলীয় কর্মসূচি নির্ধারিত হয় সরকার-আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মর্জি মোতাবেক। তাতে শুধু দৃশ্যমান শোডাউন ছাড়া কোনো ফল মেলে না। গত ১৪ বছরে সরকারের ভিত নাড়ানোর মতো কোনো কর্মসূচি পালন করতে পারেনি দলটি। ছোট জোট বড় করেছে, দেশি-বিদেশি সমালোচনা নিজের কাঁধে নিয়েছে; কিন্তু বিপরীতে কোনো ফল পায়নি। বরং মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে দেশি-বিদেশি মিত্ররা। রাজনৈতিক অর্জনের তহবিল শূন্য হচ্ছে। সরকারের প্রতি সাধারণ মানুষের ক্ষোভ বাড়লেও বিএনপির প্রতি দরদ বাড়ছে না। বরং জনবিচ্ছিন্নতা বাড়ছে। বিএনপি ছাড়াও দলটির ১১টি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়নি একযুগেও। এমন পরিস্থিতিতে অনেকটা লক্ষ্যহীনভাবে চলছে দলের কর্মকাণ্ড। এ চলার শেষ জানা নেই কারোই।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের দৃষ্টিতে, খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য আইনি লড়াই, রাজপথে আন্দোলন এবং রাজনৈতিক সমঝোতা নামের তিনটি দরজা খোলা ছিল। ইতোমধ্যে আদালতের মাধ্যমে মুক্তির কপাট বন্ধ, কার্যকর করতে না পারায় ভোঁতা হয়েছে সরকারকে চাপে ফেলার দ্বিতীয় পথ— আন্দোলন। শিগগিরই যে কার্যকর আন্দোলন হবে না তার প্রমাণ মিলেছে দলীয় মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বক্তব্যে। তিনি বলেছেন, বিএনপির মতো দলের কাছে বিপ্লব আশা করা যাবে না। দল তার ধারায় চলবে। খালেদার মুক্তির তৃতীয় ও শেষ পথ আছে সরকারের অনুকম্পা ‘রাজনৈতিক সমঝোতা’— এটিও নির্ভর করছে খালেদা জিয়া ও সরকারপ্রধানের সিদ্ধান্তের ওপর।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী নুরুল আমিন বেপারি এ প্রতিবেদককে বলেন, বিএনপির রাজনৈতিক লক্ষ্য ঠিক করতে হবে। তাদের অসংখ্য কর্মী-সমর্থক আছে; কিন্তু এই শক্তি কাজে লাগাতে পারছে না। ফলে সক্ষমতা দিন দিন কমে যাচ্ছে। বৈদেশিক সমর্থন (সরকারের প্রতি চাপ সৃষ্টি করা) আদায়েও সফল হচ্ছে না বিএনপি। তাই সরকার এখন নির্ভার। তারা চাপে না পড়লে কেন নমনীয় হবে— পাল্টা এমন প্রশ্ন রাখেন নুরুল আমিন বেপারি।

দলীয় সূত্রের তথ্য, রাষ্ট্রপক্ষ প্যারোলে মুক্তির আভাস-ইঙ্গিত দিচ্ছে। গত দুই বছরে বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতা ও পরিবারের সদস্যরা খালেদা জিয়ার সঙ্গে কয়েক দফায় সাক্ষাৎ করেছেন। সরকারের কাছে ‘সমঝোতা’ প্রস্তাব দেওয়া হবে কি না তা আলোচনা করার সাহসই পাননি সাক্ষাৎকারীরা। প্যারোলের সুযোগ নিতে হলে খালেদা জিয়ার সম্মতি বা স্বাক্ষর লাগবে, যা আদায় করতে দলীয় নেতা বা পরিবারের সদস্য কেউ সাহস পাচ্ছে না। এ কারণে দলের মহাসচিবসহ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা বলছেন, ‘প্যারোল’ বিষয়টি একান্তই খালেদা জিয়ার সিদ্ধান্ত।

কারাবন্দি খালেদা জিয়ার সম্মতি মিলবে না, তার শারীরিক অবস্থাও বেগতিক— বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে পরিবারের সদস্যরা ভিন্ন পথে ‘বিশেষ’ আবেদনের কথা জানিয়েছেন গণমাধ্যমকে। 

সে বিশেষ আবেদনের জন্য কোনো উদ্যোগ এখন পর্যন্ত নেওয়া হয়নি। ফলে খালেদা জিয়ার মুক্তি অনিশ্চিত তা দলের টপ টু বটম সবারই জানা।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ এ প্রতিবেদককে বলেন, বিএনপির চেয়ারপারসন কারাগারে এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বিদেশে থাকায় কৌশল নির্ধারণের ব্যাপারে সমন্বয় হচ্ছে না। স্কাইপিতে তো সবকিছু হয় না। খালেদা জিয়ার মুক্তি আইনগত প্রক্রিয়ার মধ্যেই হবে। তবে সেই প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে অবশ্যই পর্দার আড়ালে সমঝোতা হতে হবে। এইসব কিছুর জন্য বিএনপিতে ঐকমত্য দরকার, যাতে কিছুটা ঘাটতি আছে বলে মনে হচ্ছে ড. এমাজউদ্দীন আহমদের কাছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads