• সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪২৯

রাজনীতি

সংকটে নির্বাচনমুখী রাজনীতি

  • এম এ বাবর
  • প্রকাশিত ১১ সেপ্টেম্বর ২০২১

আবারো ঘূর্ণিপাকের আবর্তে বাংলাদেশের অস্থির রাজনীতি। আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তৃণমূল গুছিয়ে নিতে শুরু করেছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু বিএনপিসহ বিরোধী শিবিরে নতুন করে ধরপাকড়ে তৈরি হচ্ছে অস্থিরতা। বিরোধী দলগুলোর নেতারা মনে করছেন, নির্বাচন কমিশন গঠনকে সামনে রেখে বিএনপি আন্দোলনের পরিকল্পনা করছে। তা ব্যর্থ করতেই নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। আবার কোনো কোনো নেতা মনে করেন, সরকারের দুর্বলতা ঢাকতেই বিরোধী নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। আর নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া কোনোভাবে আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না বিএনপি।  

এদিকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে তৈরি হয়ে গেছে নতুন ভোটার তালিকা। এরই মধ্যে জাতীয় সংসদে পাস হয়ে গেল জাতীয় সংসদের নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ বিল ২০২১। আওয়ামী লীগের অধীনেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পুরো ভোটগ্রহণ ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) সম্পন্ন করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে ইসি। আর পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এ বছরই কেনা হচ্ছে আরো প্রায় ৩৫ হাজার ইভিএম মেশিন। অন্যদিকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ব্যবস্থাপনা নিয়ে নানা ধরনের অজানা আশঙ্কা সাধারণ মানুষের মনে দানা বাঁধছে। দেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন রাজনীতির ভবিষ্যৎ গতিপথ নিয়ে। রাজনীতির গতিপথ তার স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় থাকবে এ কথাটি বিশ্বাস করতে পারছেন না কেউই। ইতোমধ্যে বিভিন্ন টক শোতে এবং সভা সেমিনারে অংশ নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সুশীলসমাজের প্রতিনিধিরা দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আগামী নির্বাচন যথাযথভাবে অনুষ্ঠানের বিষয়ে নানা ধরনের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও আশঙ্কা প্রকাশ করে চলেছেন।

সংবিধান অনুযায়ী আগামী ২০২৩ সালের শেষের দিকে কিংবা ২০২৪ সালের শুরুর দিকে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। এ নির্বাচনের জন্য হালনাগাদ ভোটার তালিকাও তৈরি করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। নতুন এ হালনাগাদ ভোটার তালিকায় ভোটার বেড়েছে। নির্বাচন কমিশনের হিসেবে, গত বছর মার্চে ভোটার ছিল ১০ কোটি ৯৮ লাখ ১৯ হাজার ১১২ জন। আর নতুন ভোটার তালিকার হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ হয়েছে তাতে মোট ভোটার এখন ১১ কোটি ১৭ লাখ ২০ হাজার ৬৬৯ জন।

ইসির কর্মকর্তারা জানান, আগামীতে সব নির্বাচনেই ইভিএম ব্যবহারের নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। বর্তমানে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে এই যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ানো হচ্ছে। ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে পরীক্ষামূলকভাবে ছয়টি আসনে এই ভোটযন্ত্রে ভোটগ্রহণ করে বেশ সফলতা পায় ইসি। এরপর উপেজলা ও পৌরসভা নির্বাচনে ব্যাপক ব্যবহারে যায় ইসি। মাঝে বেশ কয়েকটি সংসদীয় আসনের উপনির্বাচন, সিটি নির্বাচনেও ইভিএমে ভোট নেওয়া হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানান, ভোট পড়ার হার ইভিএমে কম। এ বিষয়টি ছাড়া এ যন্ত্রে ভোট নেওয়ার ক্ষেত্রে তেমন কোনো অভিযোগ নেই। এছাড়া ইভিএমে কারচুপি রোধ, দ্রুত ফলাফল প্রকাশ, ব্যয় সংকোচনসহ নানা কারণেই এর ইতিবাচক দিক রয়েছে। আবার সরকারও চায় ডিজিটাল বাংলাদেশের ভোট ব্যবস্থাপনাতেও প্রযুক্তির উপযুক্ত ব্যবহার হোক। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়েই সম্প্রতি অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে ভবিষ্যতে একযোগে সব নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এজন্য নীতিমালা প্রণয়নের ওপরও জোর দেওয়া হয়েছে।

অন্যদিকে ইভিএম পদ্ধতিতে ভোট কারচুপির অভিযোগ রয়েছে বিএনপি’সহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীদের। এ বিষয়ে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, মানুষের ভোটাধিকার রক্ষায় ইভিএমে ভোটের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনকে প্রশ্নবিদ্ধ। এতে কারচুপি নিয়ে চ্যালেঞ্জের সুযোগ থাকবে না বলে মন্তব্য করেন তিনি। আর গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি সুব্রত চৌধুরী বলেন, ইভিএমে ভোট নিলে ভুয়া ভোট কাউন্টিংয়ে চ্যালেঞ্জের সুযোগ নেই। প্রিসাইডিং অফিসারদের নিয়ন্ত্রণ করে ইচ্ছেমতো ভোট কারচুপি করবে ক্ষমতাসীনরা। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, নির্বাচন কমিশন ইভিএমের মাধ্যমে ডিজিটাল পদ্ধতিতে নিঃশব্দ ভোট কারচুপির ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে। এটা ভোটধিকার হত্যার নিঃশব্দ প্রকল্প। তা ছাড়া, সারা বিশ্বের নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় ‘ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম)’ বিতর্কিত। কিন্তু নির্বাচন কমিশন সেই ইভিএম ব্যবহারের একতরফা ব্যবস্থা নিয়ে ডিজিটাল কারচুপির এক নতুন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজাীবী শাহদীন মালিক বলেন, নির্বাচন কমিশন ও সরকারের একক ইচ্ছেতে ইভিএমে ভোট নেওয়ার পরিকল্পনা। কারচুপির নতুন পদ্ধতি হিসেবে ইভিএমকে বেছে নিয়েছে ক্ষমতাসীনরা। সরকার নিজেরা বিতর্ক তৈরি করে জনমনে বিভ্রান্তির মাধ্যমে আগামীতেও ভোট কেন্দ্রে ভোটারদের উপস্থিতি কম করতে চায়।

এদিকে সেক্রেটারি জেনারেলসহ শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন নেতা গ্রেপ্তার হওয়ার পর চাপে পড়েছে জামায়াতে ইসলামী। দুই মাস ধরে সারাদেশে ছাত্র, যুব ও শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে একাধিক বৈঠক করে যখন সংগঠন গুছিয়ে এনেছে তখনই নেতাদের গ্রেপ্তারে বড় ধাক্কা খেল দলটি। এরই মধ্যে ছাত্রদলের সাবেক সভাপতিসহ ৫ নেতা এবং কিছুদিন আগে ছাত্রদলের আরো তিন নেতাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এ মুহূর্তে বিএনপির কোনো আন্দোলন বা অন্য কোনো কর্মসূচিও নেই, এরপরও কেন এই গ্রেপ্তার, এর কারণ খুঁজছেন দলটির নীতিনির্ধারকরা।

রাজনৈতিক দল হিসেবে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন হারানো জামায়াতে ইসলামীর নেতারা বলেন, সামনে যারাই সরকারবিরোধী আন্দোলনের ডাক দেবে, তাদের সঙ্গে রাজপথে নামবে জামায়াত। দলের এই সিদ্ধান্ত থেকে সরকারবিরোধী আন্দোলন জোরদারে মাঠ গোছাতে সারাদেশ সফর করেন কেন্দ্রীয় নেতারা। এই সফরের ফল পর্যালোচনা করতেই রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার একটি বাসায় গত সোমবার দলটির সেক্রেটারি জেনারেলসহ গুরুত্বপূর্ণ নেতারা বৈঠকে বসেন। সেখান থেকেই ৯ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গ্রেপ্তারদের বড় অংশই জামায়াতের ‘রাজনীতি ও নির্বাচন’ সংক্রান্ত বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। ফলে তাদের গ্রেপ্তারে দলের ওপর চাপ সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করেন দলটির নেতাকর্মীরা।

এই অবস্থায় গত বুধবার রাতে উত্তরার বাসা থেকে জামায়াতের নায়েবে আমির ও শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি মাওলানা আ ন ম শামসুল ইসলামকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আটক করেছে বলে অভিযোগ করেছেন জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান। জামায়াতের একাধিক নেতা বলেন, হঠাৎ করে তাদের কোনো কোনো নেতা গ্রেপ্তার হচ্ছেন। ফলে নেতাকর্মীদের মধ্যে গ্রেপ্তার আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। এই অবস্থায় সবাইকে সতর্কভাবে চলাফেরার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

বিএনপির দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স জানান, গত বুধবার রাতে ধানমন্ডি থেকে ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি ও বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা রাজীব আহসান, সাবেক যুগ্ম সম্পাদক আব্দুর রহিম হাওলাদার সেতু, বরিশাল দক্ষিণ জেলা যুবদলের যুগ্ম সম্পাদক এস এম আশরাফুল ইসলাম, রফিকুল ইসলাম রাহুলসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেন, জামায়াত নেতাদের গ্রেপ্তারের ঘটনা সরকারের বাড়াবাড়ি ছাড়া কিছু নয়। এটি একটি অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। এসব করে লাভ হবে না। কারণ জামায়াতের বিরুদ্ধে এই ধরনের গ্রেপ্তার নতুন নয়।

বিএনপি দলীয় সূত্র জানায়, দেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি আদায়ে ডান-বাম সব রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে নিয়ে এক প্ল্যাটফর্মে একত্র করতে চায় বিএনপি। এ ব্যাপারে দলের পক্ষে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু হয়েছে। অভিন্ন দাবিতে প্রথমে দলগতভাবে আদর্শভিত্তিক যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচি এবং পরে একমঞ্চ থেকে ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচি দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে দলটি। এরই মধ্যে ২০ দলকে কার্যত ‘নিষ্ক্রিয়’ করে রাখার কৌশল চলছে, যাতে বৃহত্তর ঐক্যজোটের পথে অন্যতম বাধা যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামীকে ধীরে ধীরে জোটের বাইরে ঠেলে দেওয়া যায়।

বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, সরকারে বিভিন্ন বক্তব্য, মন্তব্য এবং কর্মকা্লের ব্যাপারে জনগণ যেহেতু বিক্ষুব্ধ সেই দৃষ্টিকে অন্য খাতে প্রবাহিত করার জন্য এই নির্যাতনমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হাজার হাজার মামলা। সেসব মামলার অনেকগুলোর আসামি আবার অজ্ঞাত। এজন্য চাইলে যে কাউকেই সেসব মামলায় গ্রেপ্তার করা যেতে পারে। এভাবে মামলার পর মামলা দেওয়া হচ্ছে। সঙ্গত কারণে গ্রেপ্তার আতঙ্ক তো থাকবেই। সরকার বিনা ভোটে হওয়ায় তাদের মধ্যেও আতঙ্ক আছে যেকোনো সময় পতন হতে পারে। এজন্য বিরোধী দল বিশেষ করে বিএনপি নেতাকর্মীদের রাজপথে দাঁড়ানোর সুযোগ ক্ষমতাসীনরা নেবেন না। তাই গ্রেপ্তারের পথ বেছে নিয়েছে ক্ষমতাসীনরা। দ্বাদশ নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ না করতে পারলে দেশের পরবর্তী রাজনৈতিক অবস্থা আরো খারাপ হওয়ার আশঙ্কা করেনে তিনি।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, বিএনপি আন্দোলনের হাঁকডাক দিচ্ছে। ষড়যন্ত্রের রাজনীতি এখনো চলমান। বিএনপি যেই অপরাজনীতি ও নেতিবাচক রাজনীতি অব্যাহত রেখেছে তাতে তারা ক্রমেই হতাশার গভীরেই নিমজ্জিত হচ্ছে। অন্ধ সমালোচনা আর বিষোদগার রাজনীতি ফ্রাংকেনস্টাইন হয়ে নিজেদেরকেই আঘাত করছে। মির্জা ফখরুলসহ বিএনপি নেতারা যত কথাই বলুন না কেন, জনপ্রত্যাশা থেকে ছিটকে পড়ে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতা পেতে মরিয়া বিএনপির নেতাকর্মীরা এখন গণহতাশায় ভুগছে। দ্বাদশ নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভাবে সম্পন্ন হওয়ার আশা প্রকাশ করেন কাদের।  

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads