• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯

রাজনীতি

উত্তপ্ত হচ্ছে রাজনীতির মাঠ

এক দফা দাবি আদায়ে মাঠে থাকবে বিএনপি

  • এম এ বাবর
  • প্রকাশিত ১১ অক্টোবর ২০২১

একদিকে করোনা মহামারি ধীরে ধীরে বিদায় নিচ্ছে, অন্যদিকে সক্রিয় হচ্ছে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো। প্রায়  দেড় বছর করোনায় স্থবির ছিল জনজীবন। রাজনীতি, অর্থনীতিসহ সবখানে মহামারির প্রভাব ছিল লক্ষণীয়। কিছুদিন ধরে করোনা সংক্রামণ অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আসায় জনজীবন কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে। সেইসাথে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে রাজনীতির মাঠ। সরকারি, বিরোধী সব দলই সাংগঠনিক তৎপরতা জোরদার করছে।

আগামী সংসদ নির্বাচনে নিজেদের বিজয়ী করতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি জোটে শুরু হয়েছে ব্যাপক তৎপরতা। বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলো বলছে দ্বাদশ নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ফাঁকা মাঠে গোল দিতে দেওয়া হবে না। তাই দ্বাদশ নির্বাচন পর্যন্ত নানা কর্মসূচির মাধ্যমে মাঠ দখলে রাখবে বিএনপি ও মিত্র দলের নেতাকর্মীরা।   

এদিকে বিএনপির আন্দোলনের পরিকল্পনাকে তেমন একটা পাত্তা দিচ্ছে না আওয়ামী লীগ। আগামী নির্বাচনের আগে দল পুনর্গঠনের কাজ আরো বাড়িয়ে রাজনীতির মাঠ দখলে রাখতে চায় ক্ষমতাসীন দলটি। আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, রাজনীতির মাঠ দখলে থাকলে বিএনপির আন্দোলন মোকাবিলা করা কঠিন কোনো বিষয় হবে না। তবে জনগণের সম্পদের ওপর কোনো হামলা এলে দল হিসেবে আওয়ামী লীগও পাল্টা জবাব দেবে। আর বিএনপি গুজব ছড়ালে তা প্রতিরোধ করা হবে বলে বলছেন দলটির নেতারা। এদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সম্ভাব্য মাঠ দখল কর্মসূচি নিয়ে উদ্বিগ্ন রাজনীতি বোদ্ধা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। এতে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার আশঙ্কা করছেন তারা।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সঙ্গে যারা জোটবদ্ধ হয়ে আছেন তারাও এখন নড়েচড়ে বসছেন। হিসাব কষছেন আগামী নির্বাচনে বৈতরণী পার হওয়ার কলাকৌশল নিয়ে। জোটে থেকে রাজনৈতিক প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তি নিয়েও হিসাব করছেন তারা। এরই মধ্যে জোট নিয়ে দুই বড় দলের নির্বাচিত নেতারা কাজ শুরু করেছেন। নীরব দায়িত্ব পেয়ে ওই সব নেতা আপাতত ব্যক্তিগত পর্যায়ে আলাপ-আলোচনায় ব্যস্ত সময় পার করছেন। জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচনের ছক কষছেন তারা। আলোচনায় চলে এসেছে নতুন করে নির্বাচন কমিশন গঠন ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে আগামী সংসদ নির্বাচন। বিভিন্ন দলের রাজনীতিবিদরা জানান, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হতে পারে নানামুখী চমকের মধ্য দিয়ে।

এরই মধ্যে নির্বাচন কমিশন (ইসি) থেকে স্থানীয় সরকারের অনেক নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। তফসিল অনুসারে আগামী ১১ নভেম্বর দেশে দ্বিতীয় ধাপে ৮৪৮টি ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়া সিরাজগঞ্জ-৬ আসনের উপ-নির্বাচন ও ১০ পৌরসভায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ২ নভেম্বর। ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) ও পৌরসভা নির্বাচনসহ স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচনের মাধ্যমে সারা দেশে দলীয় রাজনৈতিক কার্যক্রম বিস্তৃত করার প্রস্তুতি চলছে। উল্লেখযোগ্য দলগুলোর শীর্ষ নেতৃত্বের মতে, করোনার মধ্যেও মূলত ইউপি নির্বাচন ঘিরেই সারা দেশে রাজনীতি আবার সরগরম হয়ে উঠবে।

আসন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও জয়ের ধারা অব্যাহত রাখতে চায় আওয়ামী লীগ। এ জন্য কৌশল প্রণয়নে ব্যস্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতারা। দলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-কোন্দল নিরসন, প্রার্থী বাছাই এবং বিদ্রোহী প্রার্থী যাতে না থাকে, সে জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা। একই সঙ্গে আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে তৃণমূল পর্যায়ের নির্বাচনের মাঠে নিজেদের অবস্থান আরো সুসংহত করার লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে ক্ষমতাসীন দল। এছাড়া স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচনসহ সাংগঠনিক কার্যক্রম জোরদারের লক্ষ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এরই মধ্যে দেশব্যাপী দলের অপূর্ণাঙ্গ কমিটিগুলো পূর্ণাঙ্গ করার উদ্যোগ। আওয়ামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি আগের মতো ভবিষ্যতেও স্থানীয় সরকারের সব নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। জাতীয় পার্টি (জাপা), জাতীয় পার্টি-জেপি, জাসদ, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ও চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ (আইএবি) অন্যান্য উল্লেখযোগ্য দলও বিশেষত ইউপি নির্বাচন সামনে রেখে সংগঠন গোছানোর পদক্ষেপ নিয়েছে।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সমপ্রতি দলীয় ফোরামের একাধিক অনুষ্ঠানে বলেছেন, স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলোতেও সৎ, যোগ্য ও স্বচ্ছ ইমেজের এবং বিতর্কমুক্ত নেতাদেরই প্রার্থী করা হবে। কিন্তু নির্বাচন ঘিরে কোথাও কোনো ধরনের বিদ্রোহ কিংবা বিশৃঙ্খলা বরদাশত করা হবে না। দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গকারীদের কঠোর সাংগঠনিক শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে।

রাজনৈতিক দলগুলোর ধারণা, ইউপির আগে পৌরসভা এবং সংসদীয় আসনের উপনির্বাচন ঘিরে দলগুলোর রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক তৎপরতাও ধাপে ধাপে মাঠে বিস্তৃত হবে। আর সাংগঠনিক তৎপরতা দেশব্যাপী পূর্ণতা পাবে কার্যত ইউপি নির্বাচনের মাধ্যমে।

স্থানীয় নির্বাচন ঘিরে সরকারি দল আওয়ামী লীগের পাশাপাশি দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপিও পর্যায়ক্রমে দল গোছানোর কাজে হাত দিয়েছে। গত একমাসে দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব বিভিন্নস্তরের নেতাকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছে। মতবিনিময়কালে দলকে শক্তিশালী করা, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন, ইসি গঠন, নেতাকর্মীদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ততা বাড়ানোর মতো সুপারিশ উঠে এসেছে। দলকে শক্তিশালী করতে মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি ভেঙ্গে নতুন কমিটি গঠনের উদ্যোগও নিয়েছে দলটি। নিজ দলের নেতাকর্মীদের পাশাপাশি দলটির শীর্ষ নেতারা পেশাজীবীদের সঙ্গেও বৈঠক করছেন।

আওয়ামী লীগের জোটের শরিক জাতীয় পার্টিতে বিভক্তি থাকলেও তারা আগামী নির্বাচন ঘিরে নতুন হিসাব-নিকাশ কষছে। জোটের ছোট ছোট দলও আস্তে আস্তে নিজেদের অস্তিত্বের প্রমাণ দিচ্ছে জাতীয় সংসদ ও সংসদের বাইরে।

বর্তমানে রাজনৈতিক দলগুলো ইউনিয়ন, পৌরসভা নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও সবার চোখ আগামী সংসদ নির্বাচনের দিকে। এর আগে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়েও রাজনৈতিক দলগুলোর কিছুটা কর্মচাঞ্চল্য লক্ষ্য করা গেছে। সময়ের অভাবে আইন করে ইসি নিয়োগের সুযোগ না থাকায় বিগত দুবারের মতো এবারও সার্চ কমিটির মাধ্যমেই ইসি গঠন করা হবে বলে সরকারি দলের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে। তবে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি ও তার জোটের সহযোগী দলগুলো মনে করছে, সার্চ কমিটির মাধ্যমে সরকার পছন্দের মানুষকে ফের নিয়োগ দিতে চাচ্ছে। দলটি বলছে, বর্তমান সরকারের অধীনে অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া বিএনপি কোনো নির্বাচনেই অংশ নেবে না।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে বর্তমান সরকারকে হটাতে হবে। নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া আগামীতে কোনো জাতীয় নির্বাচন হবে না। জনগণ হতে দেবে না, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় রাজপথে নেমে এই সরকারকে হটিয়ে ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা করবেই।

তিনি বলেন, বাংলাদেশে ভোট ডাকাতির জনক হলো আওয়ামী লীগ। গণতন্ত্র হত্যাকারী হলো আওয়ামী লীগ। কেন্দ্র দখল করে জালভোটের উৎসব করে আওয়ামী লীগ, দিনের ভোট রাতে করে আওয়ামী লীগ, বিনা ভোটে নির্বাচন করে আওয়ামী লীগ। এখন বাংলাদেশ থেকে সুষ্ঠু নির্বাচন নির্বাসনে পাঠাতে সক্ষম হয়েছে তারা। তাই বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হলে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার লাগবে। আইন করে নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। ভোটারদের আস্থা ফেরাতে ও নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করতে এক দফা দাবি আদায়ে প্রয়োজনে কঠোর আন্দোলনে মাঠে থাকবে বিএনপি। 

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য লে. কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান বলেন, বিএনপি তো সব সময়ই আন্দোলনের কথা বলে, মুখে মুখে আন্দোলনের কথা বলে আর মিথ্যার আশ্রয় নেয়। কিন্তু তারা এখনো আন্দোলন করতে পারেনি। যদি তারা আন্দোলনে নামে তবে আমরা আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠন তৎপর আছি। আমরা মূলত জনগণকে সচেতন করব।

তিনি বলেন, আমরা মূলত তিনটা কাজ করব। সেগুলো হলো : বিএনপি যদি জ্বালাও-পোড়াও করে, তাহলে দলের নেতা-কর্মীরা তাদের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে তুলে দেবে। আর গুজব রটালে তাদের বিষয়ে আমরা জনগণকে সচেতন করব। তাদের মিথ্যা কোনো তথ্যের বিষয়ে আমাদের নেতা-কর্মীরা সচেতন থাকবে। তৃতীয়ত, তাদের যে কোনো অসত্য বক্তব্যের বিষয় জনগণ যাতে বিভ্রান্ত না হয়, সে বিষয়ে আমরা অবশ্যই কাউন্টার দেব।

বিএনপির নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিএনপির কাছে পৃথিবীর সকল নির্বাচন নিরপেক্ষ, যদি তারা ক্ষমতায় যেত। বিএনপি নেত্রী ১৯৯৬ সালে বলেছিলেন, শিশু আর পাগল ছাড়া কেউ নিরপেক্ষ নয়। আসলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এই যে কনসেপ্ট, এটা ধ্বংস করেছে বিএনপি। সুতরাং এ ইস্যুতে রাজনীতির মাঠ গরম হতে দেওয়া হবে না।

সাবেক নির্বাচন কমিশনার অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, এ ভাবে মাঠ দখলের রাজনীতিতে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি হতে পারে। তাই সবদল মিলে সুষ্ঠু নির্বাচনি পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে। 

সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, একটি অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য নির্বাচনকালীন সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীরও যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। জনগণের মতের প্রতিফলন ঘটাতে সব দলের অংশগ্রহণে একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন করতে হবে। এ ইস্যুতে সমাধানে আসতে হলে আলোচনার কোনো বিকল্প নেই।

সরকার আলোচনায় না বসলে বিএনপি রাজপথে নামার ঘোষণা দিয়েছে। প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সব সরকারের পক্ষে। তারা কাউকে রাজপথে নামতে দেবে না। তারপরও বিএনপি মাঠে নামলে তাদের বিরুদ্ধে মামলা হবে, হামলা হবে। এতে একটা সংঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। নির্বাচন হলো আমাদের ক্ষমতা হস্তান্তরের সাংবিধানিক পথ। সেটাকে কার্যকর করতে হলে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। তারা যদি না চায় সেটা আমাদের দুর্ভাগ্য। জাতি হিসাবে আমরা মহাসংকটে পড়ব।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads