• মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪২৯
উত্তপ্ত হয়ে উঠছে রাজনীতির মাঠ

সংগৃহীত ছবি

রাজনীতি

উত্তপ্ত হয়ে উঠছে রাজনীতির মাঠ

  • সালাহ উদ্দিন চৌধুরী
  • প্রকাশিত ২৮ মে ২০২২

দীর্ঘদিন পর আবারো উত্তাপ ছড়াতে শুরু করেছে মাঠের রাজনীতি। সম্প্রতি ছাত্রদল-ছাত্রলীগের হামলা-পাল্টা হামলার বিপরীতে বিএনপি-আওয়ামী লীগ শীর্ষ নেতাদের হুমকি-পাল্টা হুমকি আর বৃহত্তর রাজনৈতিক জোট গঠনে বিএনপির তোড়জোড় রাজনীতির মাঠ গরমের পূর্বাভাস দিচ্ছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

জানা গেছে, রাজনীতির মাঠে কোনঠাসা বিএনপির নেতাকর্মীরা সক্রিয় হতে শুরু করেছে রাজপথে। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সমমনাদের নিয়ে রাজপথে আন্দোলন জোরদার করার লক্ষ্যে বৈঠকও শুরু করেছে বিএনপি। ছাত্রদলকে দেখা যাচ্ছে দীর্ঘদিন পর ছাত্রলীগের হামলার জবাবে পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করতে। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও হুঁশিয়ারি দিচ্ছে বিরোধীপক্ষকে ছাড় না দেওয়ার। সার্বিক এ বিষয়গুলোকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা দেখছেন আগামী দিনগুলোতে রাজনীতির মাঠ দখলের চিরাচরিত সেই সহিংস প্রতিযোগিতা হিসেবে।

যেকোনো আন্দোলনে সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কয়েকদিন ধরে মুখোমুখি অবস্থানে দেখা যাচ্ছে ছাত্রদল ও ছাত্রলীগকে। তাদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া আর হামলা-পাল্টা হামলার ঘটনা ঘটছে। উভয় পক্ষই পরস্পরকে হুমকি-ধমকি দিয়ে নিজেদের অনড় অবস্থানের জানান দিচ্ছে।

খালেদা জিয়াকে হত্যার হুমকি ও নেতাকর্মীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে ছাত্রদলের ঘোষিত কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ছাত্রদল ও ছাত্রলীগের মধ্যে গত মঙ্গল ও বৃহস্পতিবার ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ। বিপরীতে ছাত্রদল নেতাকর্মীরাও পাল্টা আক্রমণ চালায়। উভয়পক্ষের নেতাকর্মীদের ইট-পাটকেল নিক্ষেপ ও ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়ায় উত্তপ্ত ক্যাম্পাস। দুই দলের নেতাকর্মীদের হাতে স্টিলের পাইপ, কাঠের ফ্রেম, লাঠি, স্ট্যাম্প, হকিস্টিক, রড দেখা গেছে। ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের হামলায় ছাত্রদলের ৩০-৪০ জন নেতাকর্মী আহতও হয়েছেন।

এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) নেতাকর্মীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে দুদিনের বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। কর্মসূচি অনুযায়ী, আজ শনিবার সারা দেশে জেলা ও মহানগর পর্যায়ে এবং রোববার উপজেলা, থানা, পৌর এলাকা এবং কলেজে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করবে ছাত্রদল।

এদিকে ঢাবি ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের হামলার পাল্টা জবাব দেওয়ায় ছাত্রদলে নেতাকর্মীদের প্রশংসা করেছেন বিএনপির শীর্ষ নেতারা। আঘাতের বিপরীতে পাল্টা আঘাত করার জন্য দলীয় নেতাকর্মীদের আহবান জানান তারা। একই সাথে ছাত্রদলের এই কর্মসূচিকে রাজপথে আন্দোলনের সূচনা বলে মন্তব্য করেছেন দলটির শীর্ষ নেতারা।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, দলীয় চেয়ারপারসনের হত্যার হুমকির প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে ছাত্রদল রাজপথে আন্দোলনের সূচনা করেছে। ছাত্রদলের এই আন্দোলন সবাইকে এগিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দেন বিএনপির এই জ্যেষ্ঠ নেতা। গতকাল শুক্রবার রাজধানীর প্রেস ক্লাবের সামনে বিএনপির ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের উদ্যোগে এ সমাবেশে তিনি এ কথা বলেন।

এর আগে ছাত্রদলের ওপর হামলার পরদিন গত বুধবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে এক মানববন্ধনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেছেন, আঘাত এলে এখন থেকে পাল্টা আঘাত করা হবে। যেখানেই হোক, যেখানে আঘাত আসবে সেখানে পাল্টা আঘাত দিতে হবে। এই আঘাত দেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। সরকারি দলের প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, যুদ্ধ যদি করতে চান তাহলে অলিতে গলিতে যুদ্ধ শুরু হবে।

এছাড়া আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বৃহত্তর রাজনৈতিক জোট গঠন ও আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে বৈঠক শুরু করেছে বিএনপি। এরই অংশ হিসেবে তারা গত মঙ্গলবার প্রথম বৈঠকে বসে নাগরিক ঐক্যের সঙ্গে। দ্বিতীয় দল হিসেবে গতকাল শুক্রবার লেবার পার্টির সঙ্গে আলোচনায় বসে দলটি।

নাগরিক ঐক্যের সঙ্গে দেড় ঘণ্টার বৈঠক শেষে বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়, বৃহত্তর আন্দোলনের স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু করেছে তারা। একই ইস্যুতে অন্যান্য দলগুলোর সঙ্গেও কথা বলবে দলটি। অতি দ্রুত সবার সঙ্গে আলোচনা শেষ করছি একটা যৌথভাবে আন্দোলনের সূচনা করা হবে।

অন্যদিকে, সম্প্রতি পদ্মা সেতুর ওপর থেকে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে ‘টুস’ করে ফেলে দেওয়া হবে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এমন মন্তব্যে উত্তপ্ত হয়ে উঠে বিরোধী শিবির।  রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষাভ মিছিল ও প্রতিবাদ করছে দলটির নেতাকর্মীরা। আর এসব প্রতিবাদকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে দেশের বিভিন্ন জায়গায়।

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে হত্যার হুমকির প্রতিবাদে পটুয়াখালীতে বিক্ষোভ সমাবেশে দফায় দফায় বিএনপি ও ছাত্রলীগের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। একই ঘটনার প্রতিবাদে রাজধানীতে মানববন্ধন করে জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দল। ঝালকাঠির রাজাপুরেও আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে পুলিশের এক এসআইসহ উভয় পক্ষের ১০ জন আহত হয়েছেন। এর আগে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রতিবাদে জাতীয়তাবাদী মহিলা দলের বিক্ষোভ মিছিলে করে। ঝালকাঠির রাজাপুরেও বিএনপির সঙ্গে আওয়ামী লীগের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে গত মঙ্গলবার।

আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে বিভিন্ন ইস্যুতে আগামী দিনগুলোতে এভাবে রাজপথ উত্তপ্ত হবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, র্যাবসহ র্যাবের বর্তমান ও সাবেক ৭ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার ফলে পুলিশি নির্যাতন থেকে নিজেদেরকে অনেকটাই এখন ‘নিরাপদ’ ভাবছে বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা। তাই অনেকটাই নির্ভয়ে এখন মাঠে নামতে পারছে তারা। ছাত্রদলের সাম্প্রতিক প্রতিবাদ কর্মসূচি এবং সেই সাথে ছাত্রলীগকে প্রতিহতের ঘটনাকে আগামী দিনে মাঠের রাজনীতিকে উত্তপ্ত করার ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে বিএনপিকে প্রতিবাদ কর্মসূচির বিষয়ে হুঁশিয়ারি দিয়েছে আওয়ামী লীগ। একই সাথে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বিএনপির সংলাপের সমালোচনাও করেছে দলটির শীর্ষ নেতারা।

গতকাল শুক্রবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা মাঠে নেমেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সারা দেশে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে। সরকার পতন না হওয়া পর্যন্ত নেতাকর্মীরা ঘরে ফিরবে না। সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার পর প্রধান বিচারপতি বিবৃতি না দেওয়ায় ক্ষোভ জানিয়ে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা সুপ্রিম কোর্টে ঢুকে হামলা করেছে। অথচ প্রধান বিচারপতি, সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা একটি বিবৃতি পর্যন্ত দিলেন না। কারণ সরকার আজকে সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে দলীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে। ছাত্রলীগ লাঠি নিয়ে রাজপথে যেভাবে প্রতিপক্ষকে পিটিয়েছে, তা দেখে পল্টনে লগি-বৈঠা দিয়ে মানুষ হত্যার পৈচাশিকতা পুনরাবৃত্তি বলে মনে হয়েছে। মির্জা ফখরুল বলেন, যার যার অবস্থান থেকে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। এ সরকারের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। কারণ এ সরকারের অধীনে নির্বাচন সম্ভব নয়।

অন্যদিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, নানা অপচেষ্টার পরও পদ্মা সেতুর নির্মাণ ঠেকাতে না পেরে, সেতু উদ্বোধনের আগে দেশকে অস্থিতিশীল করার লক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লাশ ফেলার ষড়যন্ত্রে মেতেছে বিএনপি। রাজধানীতে নিজ বাসভবনে শুক্রবার দুপুরে এক ব্রিফিংয়ে তিনি এসব কথা বলেন। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, চট্টগ্রামে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্ণফুলী টানেলসহ সরকারে মেগা প্রকল্পগুলো দেখে বিএনপি নেতাদের মাথা নষ্ট হয়ে গেছে বলেও মন্তব্য করেন ক্ষমতাসীন দলের এই নেতা। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ‘পলিটিক্যাল হ্যালুসিনেশনে’ ভুগছেন মন্তব্য করে কাদের আরও বলেন, পদ্মা সেতুতে দুর্নীতি নিয়ে আনা অভিযোগের ভিত্তিতে তথ্য-প্রমাণ দিতে না পারলে মির্জা ফখরুলকে ক্ষমা চাইতে হবে।

এর আগে গত বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেছেন, বিএনপি যদি আবারো ২০১৩-১৪ সালের মতো সহিংস ও জ্বালাও-পোড়াও রাজনীতি করে তাহলে জান-মাল রক্ষায় জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আওয়ামী লীগ রাজপথে মোকাবিলা করতে প্রস্তুত। তিনি বলেন, সরকারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের রূপরেখা তৈরি করতে যে সংলাপের কথা বিএনপি বলছে সেটা আসলে সংলাপ নয়, সংলাপের আড়ালে বিএনপি ও তাদের দোসর সামপ্রদায়িক অপশক্তির গভীর ষড়যন্ত্র।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads