সন্তানের জন্মের দিনটা সব বাবা-মায়ের কাছে বিশেষ। কিন্তু কোনোদিনই এই দাবিটা করতে পারবেন না স্যামুয়েল উমতিতির বাবা। করবেন কী করে? ছেলের মুখ দেখার জন্য ছিলেনই না! বাবা যে কে, কেমন, সবটাই ধোঁয়াশা উমতিতির কাছে। উমতিতি জানেনই না তার বাবার কথা। শুধু জেনেছেন, দেখেছেন, চিনেছেন মাকে। মিসেস অ্যানি গো উম।
১৯৯৩-এর ১৪ নভেম্বর উমতিতির জন্ম ক্যামেরুনের ইয়াউন্ডে। কিন্তু সিঙ্গেল মাদারের পক্ষে সন্তান লালন যে কতখানি কষ্টের তা অ্যানির চেয়ে ভালো আর কে বোঝেন? বাধ্য হয়ে দু’বছরের ছেলেকে দিয়ে দিলেন এক আত্মীয়ের কাছে। কী অদ্ভুত! ওই আত্মীয় ক্যামেরুন ছেড়ে ফ্রান্স চলে গেলেন একটু সুখের খোঁজে। ক্যামেরুন থেকে আসা অভিবাসীদের একান্নবর্তী সংসারে ঠাঁই হলো উমতিতির।
এ সময়েই তো ক্যামেরুনের তারকা রজার মিলার দাপট দেখেছে বিশ্ব ফুটবল। ’৯০-এর বিশ্বকাপে চার-চারটি গোল। আফ্রিকার দলকে প্রথমবার পৌঁছে দিয়েছিলেন বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে। ’৯৪-এর বিশ্বকাপে ৪২ বছর বয়সে গোল। বিশ্বকাপের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বয়সী হিসেবে গোল। ফ্রান্সে থাকা ক্যামেরুন অভিবাসীদের মনের শক্তি জোগাচ্ছিলেন তখন মিলা। যার প্রভাব থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারল না ছোট্ট উমতিতি। ফুটবলের সঙ্গ তো ছিলই। কিছুদিন পর মাকেও কাছে পেলেন। অ্যানির কড়া শাসনে একটাই নিষেধের পরীক্ষা ছিল- ‘ফুটবল খেল, খেল; কিন্তু পড়াটা ঠিক সময়ে শেষ করতে হবে।’
অবাধ্য ছিলেন না। নিয়ম মানাটাই ছিল অভ্যেস। কিন্তু দারিদ্র্যের সঙ্গে প্রতিদিনের লড়াইটা? এক-আধদিন অসহ্য মনে হতো। তবু লড়তেন। এর মধ্যেই আরো এক ফুটবল-ঢেউ আছড়ে পড়ল ফ্রান্সে। ১৯৯৮-এর বিশ্বকাপ। জিনেদিন জিদান। উমতিতি যোগ দিলেন মেনিভালে। মেনিভালে তার খেলা দেখে লিঁওর স্কাউট আগ্রহ দেখায়। আট বছর বয়সে লিঁওর একাডেমিতে যোগদান। আট বছর যুব দলে কাটিয়ে ২০১২-তে লিঁওর সিনিয়র দলে অভিষেক। ২০১৫-১৬ মৌসুমের সেরা প্লেয়ার হন অনুরাগীদের বিচারে, যা নজরে পরে বার্সেলোনার। ২০১৬ থেকে এখন পর্যন্ত বার্সায় ৫০ ম্যাচ খেলে ২ গোল। ফ্রান্স জাতীয় দলে অভিষেক ২০১৬-তে। ২৪ ম্যাচে ৩ গোল। মঙ্গলবার ফ্রান্সকে বিশ্বকাপের ফাইনালে তোলার কারিগরও তিনি।
দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই। সস্তার বাড়ি খুঁজতে এক সময় যার কেটে গিয়েছিল কয়েক মাস, সেই তার (উমতিতি) বাড়ির গ্যারেজেই এখন চার-চারটি দামি গাড়ি- ফেরারি, অডি, মার্সিডিজ ও বিএমডব্লিউ! সেন্টার ব্যাকের জীবনের এই বদলটা দেখে অনেকে যখন ভ্রূ কুঁচকে থাকেন, যখন মাঠে বিপক্ষের ফুটবলার তার গায়ের রঙ নিয়ে খোঁচা দেন, তখনো উমতিতি লড়াইয়ের মঞ্চটা ছাড়েন না। কেন ছাড়বেন? অনেক ঘাম, রক্ত ঝরিয়ে এখন এখানে। জীবনের এই বদলের জন্য উমতিতি সব কৃতিত্ব দেন মাকে। বার বার বলেন, ‘মায়ের সমর্থন ছাড়া এই জায়গায় পৌঁছতে পারতাম না। তিনি সব সময় আমার পড়াশোনায় জোর দিতেন। বলতেন, ‘আগে পড়া। তারপর ফুটবল।’ হোমওয়ার্ক না করলে ট্রেনিংয়েই যেতে দিতেন না! পড়াশোনার গুরুত্ব ওর কাছেই বুঝেছি। তাই লেখাপড়া তাড়াতাড়ি করতাম। যাতে বন্ধুদের সঙ্গে বল নিয়ে মাঠে যেতে পারি। মায়ের অনুশাসন আমাকে জীবনের সবক্ষেত্রে সাহায্য করেছে। করছেও।’ মা কীভাবে তার জন্য কষ্ট করেছেন, সে গল্পও উমতিতি বলেন, ‘মা আমার জন্য কী না করেছেন! তিনি এত ত্যাগ স্বীকার না করলে আমি কি আদৌ এই জায়গায় পৌঁছতাম? না। প্রতিদিন সকাল-বিকাল এই যে ট্রেনিং করি, ম্যাচে সবটুকু উজাড় করে দিই, তা তো মায়ের মুখে হাসি ফোটাব বলেই। লিঁও যখন আমাকে সই করাল, মা অদ্ভুত এক দ্বিধায় পড়েছিলেন। আসলে ট্রেনিংয়ে যাওয়াটাই বেশ কষ্টসাধ্য ছিল। মা তড়িঘড়ি গাড়ি চালানো শিখলেন। তারপর কোথা থেকে একটা গাড়ি জোগাড় করে রোজ পৌঁছে দিতেন ট্রেনিংয়ে। আবার নিয়েও আসতেন।’