• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
হেমনগর জমিদার বাড়ি ও ২০১ গম্বুজ মসজিদ

সংগৃহীত ছবি

ভ্রমণ

হেমনগর জমিদার বাড়ি ও ২০১ গম্বুজ মসজিদ

  • ডেস্ক রিপোর্ট
  • প্রকাশিত ২০ মে ২০২২

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে  কাদেরিয়া বাহিনীর অবদান কম বেশি আমরা সবাই জানি। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে টাঙ্গাইল জেলায় বাংলার বীর যোদ্ধাদের নিয়ে গঠিত হয় গেরিলা দল কাদেরিয়া বাহিনী। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বই পড়ে জানতে পারি যুদ্ধকালীন সময়ে এই কাদেরিয়া বাহিনী টাঙ্গাইল জেলার হেমনগর জমিদার বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাটি গড়ে তোলে। শুধুই কি তাই! ঐতিহ্য-স্থাপনায়, সৌন্দর্যের এই বাড়িটি নজর কাড়ে পর্যটকদের।  ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে অসংখ্য জমিদার বাড়ি  দর্পের সাথে দাঁড়িয়ে রয়েছে টাঙ্গাইল জেলায়। তাই তো এবারের ঈদের ছুটি কাটাতে ভ্রমণের জন্য বেছে নিলাম এই জেলাকে। যেহেতু জমিদারি দম্ভ এবং মুক্তিযুদ্ধের আবেগ মিশ্রিত আছে টাঙ্গাইল জেলার গোপালপুর উপজেলায় হেমনগর জমিদার বাড়িতে এবং বাংলাদেশে দ্বিতীয় উচ্চতম মিনার ও ২০১ গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদও অবস্থিত এই জেলায়। তাই ভাবলাম একবার ঘুরে আসাই যায়। পরিবারের সবাই মিলে বৃহস্পতিবার রাতে সবরকম পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি সম্পন্ন করলাম। শুক্রবার সকাল ৭টা ঢাকা থেকে আমাদের যাত্রা শুরু। গাড়ির চার চাকা যত ঘুরতে থাকে আমাদের উত্তেজনা তত বাড়তে থাকে। আমাদের ছোট সোনামণি ইয়াসিন তো একের পর এক প্রশ্ন করেই যাচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধ কি? মুক্তিযোদ্ধা কারা? কেন যুদ্ধ হলো? যুদ্ধের সময় সে কোথায় ছিল? প্রশ্ন উত্তরগুলো তাকে বোঝাতে ভালোই বেগ পেতে হলো তার বাবাকে। নানারকম কৌতুহল-উৎকণ্ঠার মাঝে আরো একটা যে জিনিস জানান দিচ্ছিল তা হলো ক্ষুধা। তবে ঈদের ছুটিতে এতো সকালে খাবারের দোকান খোলা পাওয়া দায়! কালিহাতি জেলার এলেঙ্গা শহরে পৌঁছে একটিমাত্র খাবারের দোকান খোলা পাওয়া গেল। সাথে সাথে গাড়ি দাঁড় করিয়ে সেরে নিলাম সকালের নাস্তা। ঘড়িতে সকাল ১১ টা আমরা দাঁড়িয়ে আছি কাঙ্ক্ষিত হেমনগর জমিদার বাড়ির মূল ফটকে। গাড়ি থেকে নেমে মাটিতে পা রাখতেই যেন চোখের সামনে ভেসে উঠল জমিদারি শাসন। জমিদার হেমচন্দ্রের পিতা কালিবাবু ব্রিটিশ আমলের সূর্যাস্ত আইনের আওতায় শিমুলিয়া পরগনার মালিকানা পান। কলকাতা থেকে অনেকেই আসতেন এখানে সেই সাথে ব্রিটিশরা পানসে নৌকায় চড়ে বেড়াতে আসতেন এই বাড়িতে। না জানি কত বিশিষ্ট মানুষের পদচারণায় মুখর থাকতো এ বাড়ি। প্রজাদের কাছ থেকে নেওয়া হতো খাজনা। হঠাৎ-ই আম্মুর ডাকে ভ্রম কাটলো। সবাই মিলে বাড়ির ভেতরে ঢুকলাম। কি সুন্দর কারুকাজখচিত দ্বিতল এই বাড়িটি! বাড়ির সামনে ও পেছনে রয়েছে সান বাঁধানো দুটি পুকুরঘাট। স্থাপনাটির সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো, এর চিনি টিকরী অলংকার। চীনা মাটির বাসনকোসনের ছোট ছোট ভগ্নাংশ ও কাঁচের টুকরো ব্যবহার করে ফুল ও লতাপাতার  নকশা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বাড়ির পিলার এবং দেয়ালে। বাড়ির সামনে দুটি পরী মূর্তি থাকায় এলাকাজুড়ে ‘পরীর দালান’ নামেও এটি সমাদৃত। ৬০ একর জমি নিয়ে নির্মিত এই বাড়িতে রয়েছে একটি খেলার মাঠ। জমিদারের দরবার ঘর। একটি দোতলা ভবন ও দুটি একতলা ভবন। বাড়ির আশপাশে রয়েছে আরো ৭টি সুরম্য ভবন এবং ১০ টি কুয়া। জমিদার হেমচন্দ্রের নাম অনুসরণ করে এই এলাকার নামকরণ করা হয় হেমনগর। জমিদার বাড়ির পাশাপাশি আরো দুটি বিষয়ের জন্য জমিদার হেমচন্দ্র বিখ্যাত ছিলেন। একটি, তিনি শিক্ষা, সংস্কৃতি, স্বাস্থ্যসেবা এবং যোগাযোগ খাতে জমি ও অর্থ প্রদান করতেন। তার দানকৃত অর্থে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন স্কুল।

দ্বিতীয়টি, তার অত্যাচারী নিয়মাবলি। তার বর্বর আচরণের জন্য কলকাতা আদালতে সাধারণ প্রজারা এতো পরিমাণ ক্ষিপ্ত হয় যে প্রাণভয়ে তিনি কলকাতা পালিয়ে যান। আর কখনই এদেশে আসেননি এবং ১৯১৫ সালে ব্যানারসে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।

 ঘুরতে ঘুরতে মনে হলে এই বাড়িতে  থেকেই কাদেরিয়া বাহিনীর যোদ্ধা রা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর  বিরুদ্ধে যুদ্ধ জয়ের কতই না পরিকল্পনা করে ছিল। পরবর্তীতে এ বাড়িটি হেমনগর ডিগ্রি কলেজ হিসেবে ব্যবহার করা হলেও এখন সম্পূর্ণ অব্যবহূত।

দুপুর ১২.৩০। আশপাশের মসজিদগুলো থেকে ভেসে আসছে জোহরের আজান। তাই আর দেরি না করে অগ্রসর হলাম আমাদের দ্বিতীয় গন্তব্য গোপালপুর উপজেলার দক্ষিণ পাথালিয়া গ্রামে অবস্থিত বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি গম্বুজ ও দ্বিতীয় উচ্চতম মিনার বিশিষ্ট মসজিদ। যেতে যেতে জুম্মার নামাজের সময় হওয়ায় সবাই নামাজের প্রস্তুতি নিয়ে নিল। ১৫০০০ মুসল্লী ধারণক্ষমতাসম্পন্ন এই মসজিদে রয়েছে ২০১টি গম্বুজ এবং ৯টি মিনার। মসজিদর দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ ১৪৪ বর্গফুট। মূল মিনার ৪৫১ ফুট,  চারকোণে চারটি মিনার ১০১ ফুট করে এবং অভ্যন্তরীণ ৪টি মিনার যথাক্রমে ৮১ ফুট। ইসলামী এই স্থাপত্যকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে নানারকম মুখরোচক খাবারের দোকান এবং দৃষ্টিনন্দন সামগ্রীর দোকান। নামাজ শেষ হতে হতে দুপুরের খাবার সময় হয়ে যায়। বাড়ি থেকে দুপুরে খাবার নিয়ে যাওয়ায় তেমন কোনো ঝামেলায় পড়তে হলো না। গাড়ি ঘুরিয়ে একটু ফাঁকা জায়গায় খুঁজে সবুজ ঘাসের ওপর খেতে বসলাম। চারদিকে সোনালি ধান, আকাশে ঘন কালো মেঘ এই বুঝি বৃষ্টি নামলো, দূরে দেখা যাচ্ছে নদী। এমন একটি পরিবেশে দুপুরের খাবারটি যেন অমৃত মনে হচ্ছে । খাওয়া শেষে আশপাশের গ্রামগুলো ঘুরে দেখতে দেখতে ৩.৩০টা বেজে গেল। টাঙ্গাইল এসেছি আর পোড়াবাড়ির চমচম খাবো না তা কি হয়! এবারের গন্তব্য টাঙ্গাইল শহরের পোড়াবাড়ির চমচমের দোকান। ৪৭ কি.মি. পাড়ি দিয়ে এসে দেখি দোকান বন্ধ। সারা দিনের আনন্দে ভাটা পড়ল এক নিমিষেই। যাই হোক এবার ফিরে আসার পালা। বিকেল ৫ টায় আবারও যাত্রা শুরু গন্তব্য নিজ বাড়ি।

ঢাকা থেকে হেমনগর জমিদার বাড়ি ও ২০১ গম্বুজ মসজিদে যেতে যেতে দেখে নিতে পারেন আরো দুটি চমৎকার জমিদার বাড়ি। মির্জাপুরে অবস্থিত ‘মহেরা জমিদার বাড়ি’ ও ‘করোটিয়া জমিদার বাড়ি’ যা এদেশের জমিদারি ঐতিহ্য বহন করছে। তার সাথে সময় করে ঘুরে আসতে পারেন মধুপুরগড় থেকে সেখানে দেখা মিলবে ঝাঁকে ঝাঁকে বানর। তাদের জন্য বাদাম, কলা নিয়ে যেতে একদমই ভুলবেন না এছাড়াও এ দেশের বরেণ্য নেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর সমাধি স্থানও এখানেই।

একদিনের ছুটিতে ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো দেখার জন্য টাঙ্গাইল অন্যতম। বাস কিংবা রেলযোগে চলে যাবেন টাঙ্গাইল শহরে সেখান থেকে সিএনজিতে ঘুরে দেখতে পারেন সবগুলো স্থাপনা। ঢাকা টু টাঙ্গাইল রেল টিকিটে খরচ পড়বে ৯০ থেকে ৩১৫ টাকা এবং ননএসি-এসি বাসে টিকিটে খরচ পড়বে ৩৫০ থেকে ৪৮০ টাকা। সিএনজি ভাড়া জায়গার ওপর ভিত্তি করে নির্ধারণ করে নিবেন।

মনে রাখবেন, একজন পর্যটক হিসেবে পর্যটন এরিয়াগুলো পরিষ্কার-পরিছন্ন, সুরক্ষিত রাখা আপনার-আমার, আমাদের সকলের দায়িত্ব। সাপ্তাহিক ছুটি কিংবা যেকোনো একদিনের ছুটিতে পরিবারপরিজন অথবা বন্ধু-বান্ধব নিয়ে ঘুরে আসতে পারেন ঐতিহ্যের এ জেলা থেকে এর সাথে সাথে একটি বিকেল কাটিয়ে আসতে পারেন যমুনার তীরে। চাইলে করতে পারেন রাত্রি যাপনও।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads