• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
কৃষকের মুখে হাসি নেই

ছবি : সংগৃহীত

সম্পাদকীয়

কৃষকের মুখে হাসি নেই

  • আবদুল হাই রঞ্জু
  • প্রকাশিত ২৩ ডিসেম্বর ২০১৮

গত আমন মৌসুমে সরকার প্রতি কেজি ৩৯ টাকা দরে তিন লাখ  টন চাল সংগ্রহ করেছিল। অবশ্য সে সময় বাজারে ধান-চালের দাম বেশি ছিল। উল্লেখিত সময়ে দেশীয়ভাবে উৎপাদিত চালের পাশাপাশি সরকারি বেসরকারিভাবেও চাল আমদানি হয়েছিল। আর এবারের আমন মৌসুমের চিত্র ভিন্ন। বাজারে তুলনামূলক ধান-চালের দাম কম। আবার আমন ধানের ফলনও ভালো হয়েছে। যদিও গোটা দেশেই বৃষ্টি-বর্ষার মৌসুমেও বৃষ্টির দেখা তেমন একটা মেলেনি। ফলে ধানচাষিদের জমিতে সেচ দিতে হয়েছে। অথচ আমন ধান প্রকৃতির পানিতেই চাষাবাদ হয়ে থাকে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, মাত্রাতিরিক্ত শীতের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ এখন মানুষের নিত্যসঙ্গী। এসব কারণে এবারে আমন মৌসুমে বোরো চাষাবাদের ন্যায় জমিতে সেচ দিতে হয়েছে। ফলে উৎপাদন খরচ বেড়েছে। গত ১৮ নভেম্বর সচিবালয়ে খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটির (এফপিএমসি) সভায় আমন ধানচাষিরা কম খরচে ধান উৎপাদন করছে মর্মে প্রতি কেজিতে তিন টাকা কমিয়ে ৩৬ টাকা দরে ছয় লাখ টন সিদ্ধ চাল সংগ্রহের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়। ইতোমধ্যেই আমন চাল সংগ্রহ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। সভায় দাবি করা হয়, সরকারিভাবে খাদ্য মজুদ পরিস্থিতিও ভালো। খাদ্য অধিদফতরের তথ্যমতে, সরকারি খাদ্যগুদামে ৯ লাখ ৬৮ হাজার টন চাল ও ২ লাখ ৫০ হাজার টন গম মজুদ আছে। এ মজুদকে সন্তোষজনক উল্লেখ করে আমনে প্রাথমিক পর্যায়ে ৬ লাখ টন সিদ্ধ চাল ১ ডিসেম্বর থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সংগ্রহ করবে। প্রয়োজনে আরো চাল সংগ্রহ করা হবে মর্মেও খাদ্যমন্ত্রী মন্তব্য করেন।

বাস্তবতা হচ্ছে, গত বোরো মৌসুমে ধানের ভালো ফলন হওয়ায় ধানচাষিরা ধানের উপযুক্ত মূল্য থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। এখনো অনেক কৃষক ধানের দাম কম থাকায় বোরো ধান বিক্রি না করে দামের আশায় গোলায় মজুত রেখেছেন। এরই মধ্যে আমন ধান কৃষকের ঘরে আসা শুরু হয়েছে। সরকার এ বছর আমনেও প্রতি কেজি চালে তিন টাকা কম দর নির্ধারণ করায় চাষিরা উপযুক্ত মূল্য থেকে বঞ্চিত হবেন, এটা অনেকটাই নিশ্চিত। আর চাষিরা ধানের উপযুক্ত মূল্য থেকে বঞ্চিত হলে ব্যাংকের ঋণ, মহাজনী ঋণ কিংবা এনজিও থেকে নেওয়া ঋণের টাকা পরিশোধ করতে ব্যর্থ হবেন। এর ওপর আবার ঊর্ধ্বমুখী বাজারদরে নিত্যপণ্য কেনা, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ, অসুখ-বিসুখে ন্যূনতম চিকিৎসা নিতে হয়। যা চাষিরা ধান বিক্রি করেই সামাল দেয়, তাও কঠিন হয়ে পড়বে। এমনিতেই কৃষি শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি, কৃষি চাষাবাদের নিয়ামক বিদ্যুৎ, ডিজেল, সারও বাড়তি মূল্যে কিনতে হয়। সবদিক বিবেচনায় নিলে চাষাবাদ করে ধানচাষিদের লোকসান গুনতে হয়। এভাবেই কৃষক লোকসান গুনতে গুনতে কোমর আর সোজা করে দাঁড়াতে পারছেন না। আর কৃষকের ধানের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত না হওয়ার অর্থই হলো মধ্যস্বত্বভোগীদের আধিপত্য সৃষ্টি হওয়া। এভাবে শুধু ধানের ক্ষেত্রেই নয়, সবজি থেকে শুরু করে প্রতিটি কৃষিপণ্যে উৎপাদন বেশি হলেই বিপাকে পড়েন চাষিরা। আর আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয় মধ্যস্বত্বভোগীদের। এভাবেই স্বাধীনতা-উত্তর গত ৪৭ বছরে এই দেশের কৃষক দায়দেনার বোঝা সামাল দিতে পানির দামে চাষের জমি বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। জমিজমা হারিয়ে মধ্যবিত্ত কৃষক পরিবারগুলোই এখন বর্গাচাষি কিংবা ভূমিহীন। এখন শ্রম বিক্রিই যাদের একমাত্র অবলম্বন। অথচ এই কৃষকই চাষাবাদ করে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর মুখের আহারের জোগান দিচ্ছে, তাদের কষ্টের শেষ নেই। অথচ ক্ষমতাসীনরা এ দেশের কৃষকের ভাগ্যবদলের কথা বলতে বলতে মুখে ফেনা তুললেও বাস্তবে দেশের কৃষক পরিবারগুলোর দীনতার পরিবর্তন হচ্ছে না।

             অথচ কৃষি অর্থনীতির দেশে সরকার কৃষকবান্ধব পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করলে কৃষিই আমাদের অর্থনীতির চাকা পাল্টে দিতে পারত। বিশেষ করে উৎপাদিত কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে পারলে কৃষি চাষাবাদে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা সম্ভব ছিল। বিশেষ করে আলু, ভুট্টা, আখ চাষ এখন চরাঞ্চলে ব্যাপকভাবে হচ্ছে। শুধু সংরক্ষণের অভাবে, পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ফলন দিনে দিনে কমে আসছে। উল্লেখ্য, আলুর ব্যাপক চাষাবাদ হয় কিন্তু সংরক্ষণ উপযোগী হিমাগার নেই। আবার হিমাগার থাকলেও মাত্রাতিরিক্ত ভাড়া। এখন চরাঞ্চলের দোঁআশ মাটিতে ভুট্টার ব্যাপক চাষাবাদ হলেও ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না ভুট্টাচাষিরা। গত দুই বছর আগে ‘হূদয়ে মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানে নীলফামারীতে প্রধান অতিথি হিসেবে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত উপস্থিত ছিলেন। উক্ত অনুষ্ঠানে ভুট্টাচাষিরা ধান, চাল, গমের মতো ভুট্টাও সরকারিভাবে সংগ্রহ করার দাবি তোলেন। কৃষকের দাবির মুখে অর্থমন্ত্রী ভুট্টাও সরকারিভাবে সংগ্রহ করা হবে মর্মে চাষিদের আশ্বস্ত করেন। কিন্তু আজো তা আলোর মুখ দেখেনি। পাশাপাশি আখেরও চাষ ভালো হচ্ছে। কিন্তু আখচাষিরা দেশীয় চিনিকলে আখ বিক্রি করে যথাসময়ে টাকা পান না। এমনকি বছরের পর বছর পেরিয়ে গেলেও পাওনা টাকা পরিশোধে মিল কর্তৃপক্ষ ব্যর্থ হচ্ছেন। ফলে আখ চাষ কমেই গেছে। শুধু কি তাই? এখন দেশীয় চিনিকলের উৎপাদিত চিনি বাড়তি মূল্যের কারণে মিলেই মজুত থাকে। আর ৭-৮টি দেশীয় প্রতিষ্ঠানকে অপরিশোধিত চিনি আমদানির সুযোগ দিয়ে সে চিনি দেশে পরিশোধন করে খেয়ালখুশিমতো দর নির্ধারণ করে ভোক্তা পর্যায়ে বিপণন করছে। যখন অতীব সম্ভাবনার দেশীয় চিনিশিল্প ধ্বংস হচ্ছে, তখন শ্রেণিস্বার্থ রক্ষার সুযোগ দিয়ে গুটিতকতক প্রতিষ্ঠানকে বহুজাতিক কোম্পানিতে রূপান্তর করা হচ্ছে। অথচ মান্ধাতার আমলের মিল মেশিনারিজ পরিবর্তন করে আধুনিকায়ন করে চিনিকলগুলোকে পুনর্জীবিত করা সম্ভব। কিন্তু তা করা হচ্ছে না। ফলে বিদেশিদের উৎপাদিত চিনি আমাদের বাজারের প্রায় পুরো ভাগই এখন দখলে নিয়েছে। এই হচ্ছে কৃষি অর্থনীতির দেশের কৃষির বাস্তব অবস্থা! বাস্তবে চাষির স্বার্থরক্ষার কথা প্রতি ক্ষেত্রেই বলা হলেও কৃষকের স্বার্থরক্ষায় উপযুক্ত ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত কোনো সরকারই গ্রহণ করেনি। ফলে চাষিদের নিরন্তর প্রচেষ্টায় কৃষিতে ব্যাপক সাফলতা এলেও কৃষকের মুখে হাসি নেই।

 

লেখক : সমাজকর্মী

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads