• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
চমস্কির নব্বই

নোয়াম চমস্কি

ছবি :

সম্পাদকীয়

চমস্কির নব্বই

  • শহীদ ইকবাল
  • প্রকাশিত ২৪ ডিসেম্বর ২০১৮

গত ৭ ডিসেম্বর আমেরিকা-নিবাসী বুদ্ধিজীবী নোয়াম চমস্কির নব্বই বছর পূর্ণ হলো। বয়সে এটা কম নয়! একজন সাধারণ মানুষের জন্মদিন অসাধারণ কিছু না হলেও (যদিও আজকাল জন্মদিন উদযাপন একটা গৎবাঁধা স্বাভাবিক রেওয়াজে পরিণত হয়েছে) চমস্কির জন্মদিনটা— বিশেষ করে যখন নব্বই স্পর্শ করে, তখন একটু কেমন কেমন লাগে! মনে পড়ে গত শতকের প্রিভিয়াস অনেক বুদ্ধিজীবীর যখন, এখন অনেকেই নেই, জীবনাবসান হয়েছে, কিন্তু হারিয়ে যাননি; মুছে তো যাবেনই না। এই তো ক’বছর আগে ক্লদ লেভি স্ত্রাউস (২০০৯) চলে গেলেন, আর বিগত দশকে ফ্রয়েড-ল্যাকা-গ্রামসি-বেনজামিন-ফুকো-দেরিদা প্রমুখ অনেকেই চলে গেছেন, বিশ্বের বিস্ময়কর অনেক কিছু উপহার দিয়ে। নোয়াম চমস্কি এমন সৃষ্টিশীল বুদ্ধিজীবীদের ধারায় এখন একশেষ হয়ে জীবিত। আজো জীবিত। কিংবদন্তি-ভাবুক পুরুষদের অনেকেই এখন নেই, এ বিশ্বে তারা এখন স্বপ্ন-জাগানিয়া, সেই ধারায় চিনে নিই চমস্কিকে। এটা একপ্রকার সৌভাগ্যও যে— আমরা তাদের ধারার একজনকে দেখছি এবং তার মত নিয়ে নিজেরা নতুন কিছু ভাবতে চেষ্টা করছি। এ লেখাটা তার প্রতি শ্রদ্ধাতর্পণস্বরূপ। তিনি আরো বাঁচুন, বলতে থাকুন— এ চঞ্চলময় বিশ্বের বিবেকোচিত শ্বাস-প্রশ্বাসের অনেক কথা কিংবা বিপরীতে চলতি বিশ্বের হতাশার ভেতর দিয়ে চিরজীবিত হয়ে জাগানোর কথা। রুগ্ণ-বিশ্বের বিপরীতে, সবল ও সুস্থ বিশ্বের কথা। তিনি আশার কথা বলেন। সেজন্য এই তো ২০১৭-তেই বেরিয়েছে— তার বই Optimism over Dispair, যেটা নিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করা হলো, ‘মানবিক ভবিষ্যৎ নিয়ে আপনি কী এখনো মোটামুটি আশাবাদী?’— বললেন— ‘Not much of a choice’— বড় বুদ্ধিজীবী এর বেশি আর কী বলবেন! একটা দীর্ঘ সময় তিনি পার করেছেন এ বিশ্বে। গত শতকে বিশ্বযুদ্ধোত্তর সমাজে তিনি ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলেন। মার্কিন সরকারের নীতিকে ভ্রূকুটি দেখিয়েছিলেন। ফলে তাকে ‘ব্ল্যাক লিস্টেড’ করা হয়। গ্রেফতারও হন। একাধিকবার জেলে থেকেছেন। যা হোক, অ্যানালাইটিক্যাল ভাষাবিজ্ঞানে তিনি এখনো বড় চিন্তক ও আইকনও বটে। এ ছাড়া দর্শন, কগনেটিভ সায়েন্সসহ নানা বিষয়ে তার রয়েছে বিস্তর আগ্রহ ও চর্চা। অনেক সময় রাজনৈতিক নিবন্ধও লেখেন তিনি। সময়ে সময়ে বিবেকোচিত রাজনৈতিক চিন্তাশীল ব্যাখ্যা দিয়ে সমাজ-রাষ্ট্রের মুখে তিনি বিতর্কিতও হয়েছেন নানাভাবে। এ বিতর্কের একদিকে রয়েছে প্রান্ত অন্যদিকে কেন্দ্র, একদিকে রয়েছে জনতা অন্যদিকে রয়েছে শোষক, একদিকে রয়েছে বিবেকবান মানুষের সংগ্রাম অন্যদিকে রয়েছে রাষ্ট্রীয় ত্রাস। তিনি প্রথমোক্তটির পক্ষে। বরাবরই। চিরকালের তরে। এটি করতে গিয়ে তাকে মাঝে মাঝে চরম সাহসী হতে হয়েছে। কারণ আমেরিকায় বাস করে আমেরিকার পাওয়ারের বিরুদ্ধে কথা বলা, পাওয়ার ওয়ারের বিপক্ষে যাওয়া— একপ্রকার ‘খামোশ’। কিন্তু তিনি এসবের তোয়াক্কা করেন না। করেননি কখনো। আরো যে বিষয়টি তার জীবনী পড়লে আমরা দেখি, ইহুদি-পরিবারে তার জন্ম, সেখান থেকেই ক্রমাগত সংগ্রাম করতে করতে তাকে এ পর্যন্ত আসতে হয়েছে। এ যেন অনেকটা পথ পেরিয়ে আসা— অনেক মানুষের ভেতর থেকে নিজেকে চিনিয়ে নেওয়া। নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং অন্যকে সে পথ তৈরি করে দেওয়া। এভাবেই চমস্কি পৃথিবীর সব মানুষের হয়েছেন। চমস্কির বিরোধ বা শত্রু মানবতাবিরোধী যারা— তারা। সেসব দুষ্টু মানুষের বিপক্ষে তিনি। কখনোই তাদের ক্রিয়াকর্ম তিনি মেনে নেননি। যত ক্ষমতাধর হোক (সাধারণত এ সময়ে দুষ্ট বুদ্ধির মানুষের ক্ষমতা ও চালাকির শেষ নেই, দেশে দেশে তা তো এখন ব্যাপকভাবে চলছেই) তাদের প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেছেন, বিবেকোচিত বাণী প্রদান করে, সত্যটা প্রতিষ্ঠিত করে। এজন্য তিনি যুদ্ধের ইতিহাসও বলেছেন, জাতীয় মানুষের পক্ষে থেকেছেন! কার্যত এগুলো একধরনের বিবরণধর্মী কথাবার্তা। অনেকেই ইন্টারনেট সার্চ দিলে শট্ শট্ পেয়ে যাবেন। কিন্তু শ্রদ্ধাতর্পণই তো এ লেখার উদ্দেশ্য নয়! নব্বইয়ে পা দেওয়া একজন এতবড় বুদ্ধিজীবীর কৃত্য আমাদের চর্চা করাটাই মূল কথা। দেশ-জাতি-সমাজ-রাষ্ট্র সম্পর্কে আসলে তিনি কী মেসেজ দিচ্ছেন? সত্যিই কী এ পৃথিবীতে আশাবাদী হওয়ার মতো কিছু আছে? প্রায়ই পত্রিকার পৃষ্ঠায় আমরা নানা কথা লিখছি। মানুষের ভবিষ্যৎ, মানবিকতার প্রতিষ্ঠা ও প্রসার, শ্রেণিহীন সমাজ, মানুষের জন্য সমাজ, পরিশুদ্ধ মানুষের জীবন ইত্যাদি বিষয় বিশ্বে এখন কতটা নিশ্চিত! কতটাইবা তা দেখা যাচ্ছে? চমস্কি তো সারাটা জীবন মানুষের জন্য করে গেছেন, তার কাঙ্ক্ষিত বিশ্ব কী এখন দৃশ্যমান কিংবা গত ষাট-উত্তর সময়ের বিশ্বে তিনি যা দেখেছিলেন, যে বিষয়গুলোর প্রতিবাদ করেছিলেন, তা কি এখনো বর্তমান আছে কিংবা তা কোন পর্যায়ে, তার কী সমাধান হয়েছে? নাকি চমস্কির প্রশ্নগুলো তখন যেমন ছিল এখনো তেমনই আছে। তখনকার প্রশ্ন ও প্রতিবাদ এখনো সেরকমই যদি রয়ে যায়, তবে আমাদের যে প্রযুক্তির বিপ্লবমুখী বিশ্ব— যার মুখোমুখি এখন প্রতিনিয়ত আমরা, যে প্রক্রিয়ায় আমাদের সবকিছু এখন হাতের মুঠোয়, অনেককিছু এখন যেখানে সহজ-সুলভ, যোগাযোগও তীব্রমুখী এবং আপামর জনতার হাতে সবকিছু যখন দ্রুত উঠে গেছে বা যাচ্ছে— ফোন, ইন্টারনেট— তাতে কী সুফল এলো! কী রকম প্রাযুক্তিক ধারণা আমাদের প্রগতিমুখী করতে সক্ষম করালো, কীভাবে এখন জনস্বার্থকর কাজগুলো সম্পন্ন হতে পারে বা হচ্ছে, কীভাবে এখন রাষ্ট্রীয় সুবিধাগুলো মানুষ পায়, কীভাবে তা খুব দ্রুততায় মানুষ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারছে বা বুদ্ধিশীল হচ্ছে, চিন্তাশীল হচ্ছে— ব্যক্তিত্বপ্রবণ হচ্ছে ইত্যাদি এন্তার বিষয় নিয়ে নোয়াম চমস্কির জন্মদিনে আমাদের প্রশ্ন। আরো বলি সরকার পরিচালিত রাষ্ট্রে তো সর্বরকম ব্যবস্থাই তৈরি হয়ে যাচ্ছে। ফলে তবু মানুষ কেন অপ্টিমিস্টিক না হয়ে পেসিমিস্ট চিন্তার কথা ভাবছে? একটা প্রতিক্রিয়াশীল খোলস কেন? বা সে খোলস থেকে মানুষের স্বতঃস্ফূর্তি ঘটছে না কেন, বা মানুষের তীব্র ও কাঙ্ক্ষিত মুক্তিই বা আসছে না কেন? আবার উল্টোদিকে পেসিমিস্ট বা হতাশাজনক কিছু তো কোনো সমাধান নয়! তবে বিশ্ব এখন কোনদিকে এগুচ্ছে? চমস্কি বলছেন : ‘Intellectuals are in a position to expose the lies of goverments, to analyse actions according to their causes and motives and often hidden intentions, In the western world at least, they have to power that comes from political liberty, from access information and freedom of expression.’ (২০১৮)— এ পর্যায়ে একটা পুরনো ইন্টারভিউ থেকে কোড করি ‘আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় এখন যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে, তা হলো পশ্চিমের অধোগতি এবং তার সঙ্গে চূড়ান্ত একটি ধারণা— বৈশ্বিক শক্তি হিসেবে চীন ও ভারত বেরিয়ে আসবে কি-না। ধারণাটি তেমন যুক্তিযুক্ত নয়। চীনে অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি ঘটছে ঠিক। কিন্তু এগুলো অত্যন্ত গরিব দেশ। ইউরোপ ও আমেরিকার মাথাপিছু আয় অত্যন্ত কম। তাদের রয়েছে বহুবিধ অভ্যন্তরীণ সমস্যা। জিনকে এখন অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি মনে করা হলেও, এদের অর্থনীতি এখনো অ্যাসেম্বলি প্লান্টের (সংযোজন কারখানার) বেশি কিছু নয়। চীন, জাপান, কোরিয়ার সঙ্গে আমেরিকার বাণিজ্য ঘাটতি সত্যিকারভাবে নিরূপিত হলে তা ২৫ শতাংশ কমে যাবে। কারণ শিল্পোন্নত ইউরোপ এবং আমেরিকা থেকে প্রযুক্তি ও যন্ত্রাংশ ঢুকেছে চীনে এবং সেগুলো এসেম্বলড হয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে আবার শিল্পোন্নত দেশেই। যেমন আপনি যে আইপডটি কিনলেন বাজার থেকে, তার গায়ে যদিও চীন থেকে রফতানিকৃত লেখা কিন্তু চীন থেকে খুব সামান্যই মূল্য সংযোজিত হয়েছে। তবে এটাও সুনিশ্চিত যে, চীনও প্রযুক্তির শীর্ষে আরোহণ করবে। চীনের রয়েছে জনসংখ্যা সমস্যা। তথাপি চীন উন্নত করবে। কিন্তু ভারত সে তুলনায় একটি দারিদ্র্যপীড়িত দেশ। যার কোটি কোটি মানুষ অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশার মধ্যে দিনাতিপাত করে। তবে আমাদের এই পৃথিবীটা ক্রমেই বৈচিত্র্যময় হয়ে উঠছে। বৈচিত্র্যময়তা আর বহুজাতিকতার এক নতুন শতাব্দীর দ্বারপ্রান্তে আমরা।’ এটি ২০১১-তে বলেছেন চমস্কি। এখন এ চিন্তার মধ্যে নিশ্চয়ই ভেরিয়েশন এসেছে কিন্তু প্রকৃত সত্যটা তিনি বলেছেন, ‘বৈচিত্র্যময়তা’ ও ‘বহুজাতিকতা’র মধ্যে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিষয়টি বিদ্যমান। সেখানে ‘পাওয়ারে’র নজরদারিটা সার্বক্ষণিক। যুক্তরাষ্ট্র শাসক হিসেবে যে কারণে বিশ্বের দেশে দেশে সাধারণ সব মানুষদের ‘অমানুষ’ মনে করছে আর স্থানে স্থানে সে কিছু ‘দানব’ সৃষ্টি করছে। আর এ দানবকে ঠেকানো এখন কঠিনই বটে! সেটি সচেতন বুদ্ধিজীবীদের ভাবতে হবে। ফ্রিডম বা লিবার্টি ইত্যাদি বিষয়গুলোর সঙ্গে আর্থনীতিক বিষয়গুলো যুক্ত। এই যুক্ত ও যুক্তি রাষ্ট্রকে মানতে হবে। আর তা না মানলে ‘গ্লোবালাইজেশনে’র নামে বহুজাতিকতার সংস্রব একধরনের ভিন্নধর্মী আগ্রাসনকেও উসকে দিতে পারে। এ নিয়ে চমস্কির ২০১৮ সালের পর্যবেক্ষণটিতে বুদ্ধিজীবীদের গুরুত্বের কথাটি ভাবিয়ে তুলছে চরমভাবে। বস্তুত তার চিন্তার সৌন্দর্য হচ্ছে কর্তৃত্ববাদ-বিরোধিতায়। শাসকদের বিরুদ্ধে তার প্রতিবাদ। এই প্রতিবাদটি আমরা কীভাবে গ্রহণ করছি? বা আমাদের মতো দেশগুলোতে এ নিয়ে কী ভাবছে— সেটিই আলোচ্য বিষয়। এবং ভাবারও ব্যাপার।

চমস্কি এই নব্বইয়ে এসেও এসব নিয়ে ভাবছেন। কর্তৃত্ববাদী আমেরিকার বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। সমস্ত আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তিনি একাট্টা। যেসব দেশে যুদ্ধ চলছে, সেখানে যে দানবীয় কর্তৃত্ববাদ প্রতিষ্ঠা পেয়েছে তাতে মানুষের মুক্তি সম্পর্কে তিনি সন্দিহান। কার্যত ‘শাসক’— মানুষদের ‘অমানুষ’ মনে করে। এই অমানুষী মনোভাব থেকে বিশ্ব কী মুক্তি পাবে? কতটা এ মুক্তির পথ? কার্যত চমস্কির কোনো দেশ নেই। কোনো অঞ্চল নেই। সব দেশই তার দেশ। মানুষ অর্থে মানুষ নয় তিনি একটি মানবিক বিশ্বের প্রত্যাশা করেছেন। এই ‘মানুষ’ শব্দটি একটা ইমেজ। এর বাইরে এ পৃথিবীতে আর কী আছে? এটি বুঝতে পারার যোগ্য মানুষের সংখ্যা কী কমে আসছে? কেন? এই সহজ সত্যটি বুঝতে আমরা অক্ষম কেন। তবে কী আগ্রাসন আর কর্তৃত্বের কাছে সবকিছু বন্দি? পৃথিবীর ইতিহাসে যারা ক্ষমতা আর আগ্রাসনের চর্চা করেছেন তারা কেউ কি টিকে আছেন? এ মোহান্ধতার কারণ কী? বর্তমান বিশ্বের ‘সক্রেটিস’ চমস্কি এই প্রশ্নটি এই পঞ্চাশে এসেও আমাদের সামনে ছুড়ে দিচ্ছেন এবং নিরন্তর লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন, মানবিক বিশ্বের পক্ষে। এমনকি আমেরিকায় বাস করে ওই আমেরিকার বিরুদ্ধে এই যুদ্ধ। সমস্ত মানবিক বিশ্বের পক্ষে, মানুষের পক্ষে এই যুদ্ধ। আমরা কীভাবে অনুপ্রাণিত হতে পারি তার কাছ থেকে। স্যালুট চমস্কি।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads