• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণ প্রসঙ্গ

  • প্রকাশিত ২০ নভেম্বর ২০২০

মোহম্মদ শাহিন

 

 

বর্তমান সময়ে তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে যেমন এগিয়ে চলছে বিশ্ব, তেমনি প্রযুক্তিনির্ভর সহজলভ্যতার দরুন উদ্বেগজনক হারে বেড়েই চলছে সাইবার অপরাধ। ডিজিটালাইজেশনের ছোঁয়া আজ প্রতিটি জনপদ ও জনমনে পৌঁছে যাওয়ার কারণে বাস্তব জীবনে ঘটমান অপরাধগুলো স্থানান্তরিত হয়ে রূপ নিয়েছে ডিজিটালে। প্রতিনিয়ত তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে সমান্তরাল হারে ঘটছে সহিংস উগ্রবাদ, গুজব, হয়রানি, হুমকি, রাজনৈতিক অপপ্রচার, গ্যাং কালচার, আত্মহত্যা, পর্নোগ্রাফি, সাইবার বুলিং, জালিয়াতি, চাঁদাবাজি, পাইরেসি ইত্যাদি, যা সাইবার অপরাধের অন্তর্ভুক্ত। তথ্যপ্রযুক্তির জনপ্রিয় মাধ্যম ফেসবুক, ইউটিউব, ইমু, ইনস্ট্রাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ ইত্যাদির মাধ্যমে এ অপরাধগুলো সংঘটিত হচ্ছে বেশি।

বাংলাদেশ সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের গত বছরের এক গবেষণার তথ্যের ভিত্তিতে বলা হয়েছে, বর্তমানে দেশে যত অপরাধ হচ্ছে তার ৭০ শতাংশের শিকার হচ্ছেন কিশোরীরা। বিভিন্ন হুমকি, যৌন হয়রানি কিংবা সম্পর্কে একটু মনোমালিন্য হলেই কিশোরীর আপত্তিকর ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল করছে তরুণরা। প্রযুক্তি ব্যবহারকারীরা ১১ ধাপে সাইবার অপরাধের শিকার হচ্ছেন। এর মধ্যে চারটিই নতুন। ইন্টারনেট ব্যবহার করতে গিয়ে সাইবার অপরাধের শিকার হচ্ছেন ৬৭ দশমিক ৯ শতাংশ নারী। এর মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপপ্রচারের শিকারে সর্বোচ্চ অবস্থানে আছেন তারা। এই অপরাধের শিকার ১৬ দশমিক ৩ শতাংশ। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে অনলাইন বার্তা পাঠিয়ে হুমকি। ছবি বিকৃত করে অনলাইন অপপ্রচারে শিকার হওয়া নারীর হার ১১ দশমিক ২ শতাংশ। জরিপে আরো বলা হচ্ছে, পর্নোগ্রাফিকেন্দ্রিক অপরাধ ২ দশমিক ২৫ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ০৫ শতাংশে এবং অনলাইন বার্তা পাঠিয়ে হুমকির ঘটনা ১৩ দশমিক ৫ থেকে বেড়ে গেছে ১৭ দশমিক ৬৭ শতাংশে।

তথ্যমতে, ২০১৫ সালে সারা দেশে সাইবার ক্রাইম অ্যাক্টে মামলা হয়েছিল ৬৩৮টি, ২০১৬ সালে তা বেড়ে ৯৩২টি, ২০১৭ সালে আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ৪৮টি এবং ২০১৮ সালে তা দাঁড়ায় ১ হাজার ১৩৫টিতে। তা ছাড়া পুলিশের ক্রাইম ডাটা ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের (সিডিএমএম) ফেসবুক পেজে মাসে সহস্রাধিক ব্যক্তি সাইবার অপরাধের শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ করছেন। তবে এ সংক্রান্ত অপরাধ নেহাতই যেন আরো বেশি তা সহজেই অনুমেয়। কেননা এ সংক্রান্ত অনেক খবর সংবাদ মাধ্যমে আসে না। মান-সম্মানের ভয়ে এ ধরনের অপরাধের অনেক ভুক্তভোগী থানা-পুলিশ কিংবা অন্য কোনো সংস্থার কাছে অভিযোগ করেন না। ফলে অনেক ঘটনাই বিচারের আওতায় আসছে না, যাও আসছে সেগুলোর অনেক ক্ষেত্রে অপরাধীদের শনাক্ত করা যায় না।

বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, এ ক্ষেত্রে আমাদের প্রযুক্তিগত বেশ সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সাইবার অপরাধ দমনে দেশে ডিজিটাল আইন পাস করা হয়েছে, সাইবার ট্রাইব্যুনাল গঠনসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এতসব উদ্যোগ থাকার পরও কেন দিন দিন সাইবার অপরাধ আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে তা ভাবার বিষয় বটে। সাইবার অপরাধ দমনে সরকার কর্তৃক নানা সময় নানা পদক্ষেপ নেওয়া হলেও সে পদক্ষেপগুলোর বাস্তবমুখী প্রয়োগের অভাবে সাইবার অপরাধ ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলছে। দেশে পর্যাপ্ত ফরেনসিক ডিভাইস নেই, উপযুক্ত ল্যাবও নেই। এ বিষয়গুলো নিয়ে নতুন করে ভাবা দরকার। দেশে-বিদেশে প্রতিদিনই নতুন নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন হচ্ছে। অপরাধীরা সে প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে অপরাধ করে চলছে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে  যারা মাঠপর্যায়ে তদন্ত কাজ করছেন, তাদেরও এ ব্যাপারে দক্ষতা বাড়াতে হবে। যেভাবে দিন দিন সাইবার অপরাধ বাড়ছে তাতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এখনই এ ব্যাপারে আরো দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়ার বিকল্প নেই।

সাইবার অপরাধ রোধে জনসচেতনতা খুবই কার্যকর একটি পদ্ধতি। সরকারি উদ্যোগগুলো বরাবরই জনসচেতনতাকে গুরুত্ব না দিয়ে কোটি কোটি টাকার প্রকল্প নিয়ে সাইবার অপরাধ প্রতিরোধে ব্যস্ত। কিন্তু শুধু আইন কিংবা আধুনিক টেকনোলজি দিয়ে সাইবার অপরাধ রোধ সম্ভব নয়, এসবের পাশাপাশি জনসচেতনতাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণ মানুষের অনেকেই জানেন না, ইন্টারনেটের বৈধ ব্যবহারকে যারা প্রতারণার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যায়। বর্তমান সময়ে উঠতি বয়সি অনেক তরুণ-তরুণীও সাইবার অপরাধ সম্পর্কে বেশ অজ্ঞ। যার ফলে তারা অবিরত বিভিন্ন গুজব শেয়ার, রাষ্ট্র বা ব্যক্তির নামে আপত্তিকর স্ট্যাটাস বা মন্তব্য, যৌন হয়রানি ও হুমকিসহ বিভিন্ন সাইবার অপরাধ করছে। এতে একদিকে যেমন ভুক্তভোগী হয়রানির শিকার হচ্ছেন, অপরদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিপাকে পড়ছে। সুতরাং এক্ষেত্রে সর্বসাধারণের মাঝে জনসচেতনতা তৈরি খুবই জরুরি। প্রয়োজনে গণমাধ্যম এক্ষেত্রে শুভ সহায়ক হতে পারে।

একই সঙ্গে আমরা যারা তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করছি, তাদের জানা প্রয়োজন, অনলাইন ব্যবহারে সাবধানতা বা সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। ইচ্ছাকৃতভাবে বা একটু অসচেতনতাবশত গুজব শেয়ার, ব্যক্তি বা রাষ্ট্রের নামে অপপ্রচার, মেয়েদের যৌন হয়রানি বা আপত্তিকর ছবি ভাইরাল ইত্যাদি করলেই সাইবার অপরাধের দায়ে ফেঁসে যেতে পারেন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে। আর জেনে বা না বুঝে এ অপরাধ করে ফেললে দিতে হবে কঠিন মাশুল। তাই এ ব্যাপারে আমাদের সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। অভিভাবকদেরও তাদের সন্তান প্রযুক্তির অপব্যবহার করছে কি না সেদিকে কড়া নজর দিতে হবে।

সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সমন্বিত পদক্ষেপ, আইনের যথাযথ প্রয়োগ, জনগণের সচেতনতা ও আন্তরিক প্রচেষ্টায় দ্রুত সাইবার অপরাধ রোধ সক্ষম হবে, এমনটাই প্রত্যাশা।

 

লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

alommdshahin688@gmail.com

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads