• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
শৃঙ্খলায় নিয়ন্ত্রণ ও নিরাপদ হবে জীবন

সংগৃহীত ছবি

স্বাস্থ্য

ডায়াবেটিস

শৃঙ্খলায় নিয়ন্ত্রণ ও নিরাপদ হবে জীবন

  • এস এম মুকুল
  • প্রকাশিত ১৫ নভেম্বর ২০১৮

বিশ্বের ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থান দশম। ভেজাল খাদ্য, অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস এবং কম  পরিশ্রমের কারণে বিশ্বে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে। আশঙ্কার খবরটি হচ্ছে, বাংলাদেশে দিন দিন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিক ফেডারেশন-আইডিএফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে ডায়াবেটিস রোগীদের অর্ধেকই জানেন না তারা এতে আক্রান্ত। ফলে তারা থাকছেন চিকিৎসার আওতার বাইরে। জানা গেছে, নানা কর্মসূচি অব্যাহত রাখার পরও ডায়াবেটিস রোগীর মাত্র ২৫ ভাগকে স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আনতে পেরেছে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি। খাদ্যাভ্যাস, জীবনযাত্রার পরিবর্তন, নিয়মিত হাঁটার মাধ্যমে প্রায় ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ডায়াবেটিস প্রতিরোধ সম্ভব। এক গবেষণায় দেখা গেছে, শহরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গ্রামেও বাড়ছে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা। বর্তমানে শহরে ১০ ভাগ মানুষ এ রোগে আক্রান্ত, গ্রামে আক্রান্তের সংখ্যা ৮ ভাগ। আরো ১০ শতাংশ লোক ডায়াবেটিস হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে।

বছরে চিকিৎসাব্যয় ১৭ হাজার কোটি টাকা

ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিস ফাউন্ডেশনের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে এখন ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা ৭০ লাখেরও অধিক। একটি হিসাবে দেখানো হয়েছে, বাংলাদেশে যারা ডায়াবেটিস রোগের চিকিৎসা নেন তাদের মধ্যে শতকরা প্রায় ৭২ ভাগ ট্যাবলেট খান এবং প্রায় ১৭ ভাগ ইনসুলিন গ্রহণ করেন। বাকি ১১ শতাংশের দুটিই প্রয়োজন। সে হিসেবে একজন রোগীর যদি প্রতিমাসে গড়ে দুই হাজার টাকা খরচ হয়, তাহলে প্রতিমাসে বাংলাদেশে খরচ হচ্ছে ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা এবং প্রতিবছর খরচ হচ্ছে ১৬ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। ডায়াবেটিসের চিকিৎসার জন্য একজন রোগীকে মাসিক প্রায় ২ হাজার টাকা খরচ করতে হয় বলে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশনের এক গবেষণায় উঠে এসেছে। বাংলাদেশে ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে শতকরা প্রায় ৭২ ভাগ ট্যাবলেট খান এবং প্রায় ১৭ ভাগ ইনসুলিন নেন। বাকি ১১ শতাংশের দুটিই প্রয়োজন। আবার ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিক ফেডারেশন-আইডিএফের মতে, বাংলাদেশে মোট ৭১ লাখ শনাক্তকৃত ডায়াবেটিস রোগী রয়েছে। একজন ডায়াবেটিস রোগীর গড় খরচ ২ হাজার টাকা। সে হিসেবে ডায়াবেটিসের চিকিৎসা বাবদ প্রতিমাসে খরচ হচ্ছে ১ হাজার ৪২০ কোটি টাকা এবং প্রতিবছর খরচ হচ্ছে ১৭ হাজার ৪০ কোটি টাকা।

বিশ্বে ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা সাড়ে ৪১ কোটি

উন্নত বিশ্বের তুলনায় উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত দেশে ডায়াবেটিস রোগীর বৃদ্ধির হার বেশি। বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে ডায়াবেটিস এখন মহামারী হয়ে উঠছে। বিশ্বে ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা সাড়ে ৪১ কোটির উপরে। ডায়াবেটিস প্রতিরোধে এখনই কার্যকর উদ্যোগ না নিলে বিশ্বে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা আগামী ২০৪০ সালের মধ্যে ৬৪ কোটি ছাড়িয়ে যাবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটায় এ ধরনের প্রধান পাঁচটি কারণের মধ্যে ডায়াবেটিস অন্যতম। বিশ্বে প্রতি ১০ সেকেন্ডে একজন ডায়াবেটিস আক্রান্ত মানুষ মারা যায় এবং প্রতি ১০ সেকেন্ডে দুজন ডায়াবেটিস রোগী শনাক্ত করা হয়। তাই ডায়াবেটিসের ভয়াবহতা প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ একান্ত জরুরি।

ডায়াবেটিস প্রতিরোধে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি

বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির (বাডাস) তথ্যমতে, ১০ জনের মধ্যে একজন নারী ডায়াবেটিস আক্রান্ত। বাংলাদেশে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস আক্রান্তের হার ৬ থেকে ১৪ শতাংশ। গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মহিলাদের মধ্যে ৬৫ শতাংশের পরবর্তী গর্ভধারণের সময় গর্ভকালীন ডায়াবেটিস দেখা যায়। যেসব মহিলার গর্ভকালীন ডায়াবেটিস দেখা যায়, তাদের পরবর্তীকালে টাইপ-২ ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি। যেসব মায়ের গর্ভকালীন ডায়াবেটিস ছিল, তাদের শিশুদেরও পরবর্তী সময়ে টাইপ-২ ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি। বাডাস সূত্র জানায়, টাইপ-২ ডায়াবেটিস শতকরা ৭০ ভাগেরও বেশি প্রতিরোধযোগ্য। প্রাথমিকভাবে ডায়াবেটিস প্রতিরোধের লক্ষ্যে বাডাস কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে সম্প্রতি বাডাস করপোরেটভিত্তিক ডায়াবেটিস প্রতিরোধ কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। এই কর্মসূচির অধীনে বিভিন্ন অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীকে স্বল্পমূল্যে ডায়াবেটিস নির্ণয় ও প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যশিক্ষা দেওয়া হবে। ডায়াবেটিস প্রতিরোধে জাতীয় নীতিমালার একটি খসড়া তৈরি করে তা সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এতে ফাস্টফুড ও কোমল পানীয়ের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করার বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। পাঠ্যপুস্তকে যাতে প্রতিটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়, সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদ্যোগ নেওয়া উচিত। স্কুল-কলেজে খোলা মাঠ রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। এককভাবে না পারলেও কয়েকটি স্কুল বা কলেজ সম্মিলিতভাবে একটি খেলার মাঠের ব্যবস্থা করে সে ব্যাপারে বাধ্যবাধকতা আরোপ করা যেতে পারে। টিভি-রেডিও-সংবাদপত্রে সচেতনতামূলক বিজ্ঞাপন বা স্লোগান প্রচারের ব্যবস্থা করা দরকার। এলাকাভিত্তিক ওয়াকিং ক্লাব, সুইমিং ক্লাব ইত্যাদি গড়ে তোলা উচিত। গৃহায়ণ কর্মসূচির অনুমতি দেওয়ার সময় হাঁটাচলার জন্য পর্যাপ্ত রাস্তা ও খেলাধুলার জন্য কিছুটা জায়গা রাখার বিধান রাখা যেতে পারে। হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে স্বাস্থ্যশিক্ষার ব্যবস্থা রাখতে হবে। বিভিন্ন ধর্মীয় উপাসনালয়ে (যেমন মসজিদে খুতবার সময়) ডায়াবেটিস প্রতিরোধ ও সুস্বাস্থ্য রক্ষা সংক্রান্ত সচেতনতামূলক বক্তৃতার ব্যাপারে ধর্মীয় নেতাদের উৎসাহিত করার উদ্যোগ নিতে হবে।

সুশৃঙ্খল জীবনযাপনে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ

সচেতন হলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রেখেও প্রায় স্বাভাবিক জীবনযাপন করা যায়। ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞদের মতে, সচেতনতার অভাবে অনেকেই এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। সুশৃঙ্খল জীবনযাপন করলে রোগী নিজেই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। বিশেষজ্ঞরা জানান, ডায়াবেটিস এমন এক রোগ, স্বাস্থ্যশিক্ষাই যার প্রধান চিকিৎসা। যথাযথ স্বাস্থ্যশিক্ষা পেলে একজন ডায়াবেটিস রোগী চিকিৎসকের ওপর নির্ভর না হয়ে এ রোগ ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন। ডায়াবেটিস রোগীরা বাইরের কেনা খাবার একেবারেই খাবেন না। ডায়াবেটিস রোগীর প্লেটের অর্ধেকটাই হতে হবে সালাদ বা সবজি। আর বাকি অর্ধেকের চার ভাগের তিন ভাগ প্রোটিনযুক্ত খাবার, আর এক ভাগ শর্করা জাতীয় খাবার। জার্মান ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ প্রফেসর স্টেফান মার্টিনের মতে, খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন এনে অতিরিক্ত ওজন কমানোর মাধ্যমে ডায়াবেটিস শতকরা ৯০ ভাগ কমানো সম্ভব। তিনি বলেন, নুডুলস বা মিষ্টিজাতীয় খাবারের শর্করা রক্তে চিনির মাত্রা মুহূর্তের মধ্যেই বাড়িয়ে দেয়, ফলে শরীরের কোষে ইনসুলিন হরমোন ছড়িয়ে পড়ে। তাই এ থেকে দূরে থাকাই ভালো। ২০০ ডায়াবেটিস রোগীর ওপর পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা দিনে মাত্র ৬০০ ক্যালরি প্রোটিনযুক্ত খাবার খান, তারা ওষুধ ছাড়াই সুস্থ আছেন। ডায়াবেটিস থেকে ভালো থাকতে চাইলে রোগীকে প্রতিদিন এক মুঠো বাদাম, আখরোট খেতে হবে। কারণ বাদামের ম্যাগনেশিয়াম ইনসুলিনের প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণে রাখে। সালাদে থাকা পানি পেট ভরায় এবং খুব ধীরে ধীরে রক্তে প্রবেশ করে। সালাদের সঙ্গে জলপাইয়ের তেল মিশিয়ে নিলে দীর্ঘক্ষণ ক্ষুধা লাগে না। তাই প্রচুর সালাদ খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা। অন্যান্য ফলের তুলনায় স্ট্রবেরি ও আপেলে শর্করার পরিমাণ অনেক কম থাকে। কাজেই ওজন কমাতে এবং ব্লাডপ্রেশার নিয়ন্ত্রণে রাখতে এ ধরনের ফল প্রতিদিনই খাওয়া উচিত। চিকিৎসকদের মতে, সুস্থ মানুষের চেয়ে ডায়াবেটিস রোগীদের সবকিছুতেই ঝুঁকি একটু বেশি থাকে। তাই সুস্থতার জন্য তাদের খাবারদাবারে নিয়ম মেনে পরিমিত সুষম খাবার গ্রহণ করা এবং চিনি, মিষ্টিযুক্ত খাবার বর্জন করা উচিত। শাকসবজি ও আঁশজাতীয় খাবার বেশি বেশি খাওয়া উচিত। ফাস্টফুড ও কোল্ড ড্রিংকস পরিহার, ধূমপানসহ সব ধরনের তামাক বর্জন, প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০ মিনিট করে সপ্তাহে ১৫০ মিনিট দ্রুত পায়ে হাঁটা, সাইকেল চালানো, সাঁতার কাটা কিংবা সিঁড়ি ভাঙা প্রয়োজন প্রতিটি ডায়াবেটিস রোগীর। একটানা বেশি সময় বসে কাজ না করে কাজের ফাঁকে উঠে দাঁড়ান, হাঁটাহাঁটি করুন। মানসিক চাপমুক্ত থাকুন, মনকে প্রফুল্ল রাখুন।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads