• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯

সাহিত্য

জেন্ডার, ক্ষমতায়ন ও বাংলাদেশ

  • সেলিনা হোসেন
  • প্রকাশিত ০৭ অক্টোবর ২০১৮

আন্তর্জাতিক নারী দিবস এলেই নারী-বিষয়ে আলোচনা সামনে আসে। কখনো মনে হয় বিষয়টি বড় বেশি গৎবাঁধা। কখনো মনে হয় একটি প্রতীকী দিন সামনে থাকলে বছরজুড়ে নারী বিষয়টি নানা দিক থেকে গুরুত্ব পাবে। সঙ্গত কারণেই দ্বিধা কাটে না। কারণ বছরজুড়ে নারী-বিষয় তেমন গুরুত্ব পায় না। পেলে পারিবারিক নির্যাতন হতো না, ফতোয়া বন্ধ হতো, ইভটিজিং একটি আতঙ্কিত বিষয় হয়ে দাঁড়াতো না। ফলে সামাজিক মূল্যবোধের জায়গাটি শিথিল হয়ে যায়।

তারপরও আশাবাদের জায়গা আছে, যখন দেখি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে জেন্ডার ও ক্ষমতায়ন বিষয় শিক্ষার্থীদের শেখানো হয়; যারা ভবিষ্যতে জায়গা দুটি নির্মাণ করবে। কমবে নারীকে অবমূল্যায়নের দৃষ্টিভঙ্গি। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে জেন্ডার প্রত্যয়টি একটি উন্নয়ন ইস্যু। প্রমাণিত হয়েছে যে, নারী-পুরুষের সমান অংশীদারিত্ব ছাড়া টেকসই উন্নয়ন করা কঠিন। কারণ নারী-পুরুষের জেন্ডার ভূমিকা নির্ধারিত হয় সামাজিক-সাংস্কৃতিক আলোকে। সেক্স নারী-পুরুষের লিঙ্গ নির্ধারণ করে। আর জেন্ডার নারী-পুরুষের সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিচয় নির্ধারণ করে। তাই সমাজের অর্ধেক জনশক্তি নারীকে পাশ কাটিয়ে উন্নয়ন ধারণা নির্ণয় করা যে সঠিক নয় তা গবেষণা এবং বাস্তব ভূমিকায় উঠে এসেছে। ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের মানবাধিকার ঘোষণার পরে নারী-পুরুষের সমান অধিকার স্বীকৃত হয়েছিল।

কিন্তু বিষয়টি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঠিকভাবে বিবেচিত হয়নি। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে নারীর অবস্থান কী হবে, এটিও নির্দিষ্ট হতে অনেক সময় লেগেছে। দীর্ঘ সময় ধরে এমন ধারণা প্রচলিত ছিল যে, সমাজের একটি অংশ অর্থাৎ পুরুষ উপকৃত হলে নারীও তার সুফলভোগী হবে।

সময়ের বিবর্তনে পুরুষ-রচিত ইতিহাসে উন্নয়নে নারীর অবদানকে মূল্যায়ন না করে অদৃশ্য করে রাখা হয়েছিল। ১৯৫০-৬০ এর দশকে উন্নয়নে নারীর ইস্যুকে মানবাধিকার ইস্যু হিসেবে চিন্তা করা হতো। উন্নয়নের প্রত্যক্ষ কর্মকাণ্ড নারীকে অংশগ্রহণকারী হিসেবে না দেখে পরোক্ষ উপকারভোগী হিসেবে দেখা হতো। সেজন্য নারীবিষয়ক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের নীতিনির্ধারণী আলোচনায় নারীদের ডাকা হতো না। যদিও জাতিসংঘ নারী-বিষয়ে বিভিন্ন সনদ গ্রহণ করেছিল। ১৯৪৬ সালে গৃহীত হয়েছিল Comission on the Status of Women; ১৯৪৯ সালে Convention for the Suppression of Traffic in Persons and the Exploitation of the Prostitution of others; ১৯৫১ সালে Equal Remuneration of Men and Women Workers for work of Equal Value এবং ১৯৫২ সালে Convention on the Political Rights of Women গৃহীত হয়েছিল।

তারপরও উন্নয়ন ধারায় নারীর অবদান স্বীকৃতি পেতে শুরু করে সত্তর দশকের শুরু থেকে। এ সময়ে প্রকাশিত হয় ইসথার বোসপার রচিত গবেষণাগ্রন্থ Women’s Role in Economic Development. তার এই গবেষণা উন্নয়ন চিন্তাবিদদের মনোযোগ কাড়ে। তিনি ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছিলেন কীভাবে নারীর ওপর অর্থনৈতিক উন্নয়নের অসম প্রভাব পড়ে। ধীরে ধীরে পরিবর্তন সূচিত হতে থাকে। সত্তর দশকেই উইমেন ইন ডেভেলপমেন্ট (WID) তত্ত্ব বিস্তার লাভ করে। পরে দেখা যায় এ ধারণায় নারীর সার্বিক অবস্থার যথাযথ মূল্যায়ন হয় না। পরে আশির দশকের সূচনায় জেন্ডার অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (GAD) ধারণার উদ্ভব ঘটে। এই ধারণায় নারীজীবনের সামগ্রিক দিকগুলো প্রতিফলিত করার চেষ্টা হয়। সত্তর দশকে জনসংখ্যা ও খাদ্যবিষয়ক ইস্যুতে উন্নয়ন ধারণায় নারীর অবস্থান প্রবলভাবে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। ইসথার বোসপার তার গবেষণায় দেখিয়েছিলেন, আফ্রিকার ঔপনিবেশিক শাসকরা কীভাবে নারীকে খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়া থেকে সরিয়ে  দিয়েছিল। শাসকদের হস্তক্ষেপের আগে যেসব অঞ্চলের নারী ছিল সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী সক্রিয় কৃষক, হস্তক্ষেপের ফলে নারী হয়ে যায় পুরুষের ওপর নির্ভরশীল পরিবারের সদস্য বা সহায়ক। নারীকে এভাবে অবদমিত না করে উন্নয়ন প্রক্রিয়া যথাযথভাবে যুক্ত করাই টেকসই উন্নয়নের অন্যতম শর্ত। একই সঙ্গে অর্জিত হবে জেন্ডার সমতার জায়গা।

নারীবাদী গবেষক ঐবষার ঝঢ়রষধ বলেন, ‘এরাই হচ্ছে সেই নারী (৫০০ মিলিয়নের বেশি নিরক্ষর) যাদের ওপর আমাদের জনসংখ্যা নীতি, খাদ্য কর্মসূচি এবং সার্বিক উন্নয়ন-উদ্যোগের সাফল্য নির্ভরশীল। এসব নীতি সম্পর্কে যারা কম জানে, তাদের ওপরই এসব নীতির সাফল্য নির্ভর করে।’ (ঞযব ঞরসবং, ২৩.৩.১৯৭৫)

জেন্ডারের সঙ্গে ক্ষমতায়ন প্রত্যয়টি গভীরভাবে সম্পৃক্ত। ক্ষমতায়ন নারী-পুরুষের পূর্ণাঙ্গ জীবনমান অর্জনের ব্যাখ্যা। অর্থাৎ ব্যক্তির নিজ জীবন ব্যক্তি কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে তা ঠিক করা- পেশাগত দক্ষতা অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় যোগ্যতা অর্জন করা। ক্ষমতায়ন ব্যক্তির ভেতর আত্মবিশ্বাস দৃঢ় করে, যার দ্বারা সে সমস্যা সমাধান করতে শেখে। পরমুখাপেক্ষী না হয়ে স্বনির্ভর হয়। এভাবে নারী বা পুরুষ যখন জীবন জিজ্ঞাসার মতামত গ্রহণে ক্ষমতার অধিকারী হয়, তখন মনে করা হয় তার ক্ষমতায়ন হয়েছে। ক্ষমতায়ন কার্যকর করার জন্য তিনটি পর্যায়কে বিবেচনা করা হয়। যেমন ব্যক্তিগত। এ পর্যায়ে বিবেচিত হয় ব্যক্তির আত্মবিশ্বাস ও সামর্থ্যের ধারণা। অপরটি সম্পর্ক। এ পর্যায়ে দেখা হয় ব্যক্তির সম্পর্কযুক্ত ক্ষমতার সামর্থ্য। অর্থাৎ ব্যক্তি কতটা মধ্যস্থতাকারী ও অন্যের ওপর প্রভাব বিস্তারে কতটা সমর্থ। তৃতীয়টি সামষ্টিক। এ পর্যায়ে বিবেচিত হয় একসঙ্গে কাজ করার দক্ষতা। অর্থাৎ বড় আকারে প্রভাব বিস্তার ও তার ফললাভের জন্য একসঙ্গে সক্রিয় থাকার সামর্থ্য। এই ক্ষেত্রগুলো বিবেচনা করে নির্ধারণ করা যায় ক্ষমতায়নের মাত্রা। এই ক্ষমতা অর্জন পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। এর সঙ্গে বেঁচে থাকার নানা ব্যবস্থা গভীরভাবে জড়িত। বিশেষ করে নারীর ক্ষেত্রে বিষয়টি আরো জটিল। নারীর ক্ষমতায়ন হয়েছে কি-না তা বুঝতে হলে দেখতে হয় সম্পদের ওপর নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কি-না। সম্পদ নিয়ন্ত্রণে নারী সক্ষম কি-না অর্থাৎ নারী নিজ সম্পদ নিয়ন্ত্রণ  করছে কি-না। বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ফল নারী ভোগ করতে পারছে কি-না। অর্থাৎ নারী সরাসরি উন্নয়নের সুফলভোগী কি-না।

নারীর ক্ষমতায়নকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়। যেমন : অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন, সামাজিক ক্ষমতায়ন ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন। অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন বলতে বোঝায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মূলধারায় নারীর পূর্ণ অংশগ্রহণ। এর পূর্ণ ব্যাখ্যায় বলা যায়, সিদ্ধান্ত গ্রহণে, বাস্তবায়নে, অভিগম্যতায়, নিয়ন্ত্রণে এবং সমতার ভিত্তিতে সুফল ভোগে নারীর পূর্ণ মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হওয়া। সামাজিক ক্ষমতায়ন বলতে নারীর অধিকার ভোগের বিষয়টি প্রথমে আসে। সমাজে নারী কী ধরনের ভূমিকা পালন করতে পারে এবং ভূমিকা পালনে তার ক্ষমতার চর্চা কতটা গুরুত্বপূর্ণ, সে বিষয়টি বোঝায়। রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন হলো রাজনীতি চর্চায় নারীর পূর্ণ অংশগ্রহণ। ভোট প্রদান, নির্বাচনে অংশগ্রহণ, রাজনৈতিক দলে সমতার জায়গা অর্জন কতটুকু নিশ্চিত তা বোঝায়। এসব জায়গায় নারী বৈষম্যের শিকার বলে পুরুষের পাশাপাশি নারীর ক্ষমতায়ন একই অর্থে ব্যাখ্যা করা যায় না। সেজন্য ক্ষমতায়নের ধারণা পুরুষের জন্য একরকম, নারীর জন্য অন্যরকম। নারীর ক্ষমতায়ন সমতাভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থার প্রধান দিক।

এক বছর আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল- ‘শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে সমসুযোগ নারীর ক্ষমতায়নের পূর্বশর্ত।’ স্লোগানটি বাংলাদেশের নারীদের জন্য কঠিন নিঃসন্দেহে। কারণ দেশে শিক্ষার হার নগণ্য, সুযোগের অভাব প্রবল। তাই এত বড় স্লোগান বাংলাদেশের লক্ষ-কোটি নারীর কাঁধে বোঝা। যে স্বল্পসংখ্যক নারী বিজ্ঞান-প্রযুক্তির সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতে শিখেছেন, তারা কোনোভাবেই ব্যাপক নারীসমাজের প্রতিনিধিত্ব করেন না।

তারপরও নিরাশ হওয়া আমাদের চলবে না। জেন্ডার সমতার ভিত্তিতে ক্ষমতায়নের জায়গাটি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য বিজ্ঞান-প্রযুক্তি বিষয়ে জ্ঞানলাভ করতে হবে নিজেদের চেষ্টায়। সরকারের দায়িত্ব সুযোগ তৈরি করা। কাজে লাগানোর দায়িত্ব তাদের, যাদের জন্য সুযোগ তৈরি করা হয়েছে। এই অর্থে নারীর নিজের দায়িত্ব অনেক। তাকে বুঝতে হবে কোনটা তার অধিকারের বিষয়, কোনটাকে নিজের পক্ষে টেনে নিতে হবে। যোগ্যতা-দক্ষতা অর্জনের মধ্য দিয়ে সমতার জায়গা তৈরি করতে হবে। নইলে সুযোগ পেলেও সেই সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাবে।

দীর্ঘ সময় ধরে শিক্ষা-বিজ্ঞান-প্রযুক্তির ক্ষেত্রে নারীর সুযোগের অভাব ছিল। মনে করা হতো বিষয়গুলো নারী না শিখলেও চলে। এমনও বলা হয়েছে যে, শেখারই দরকার নেই। সময়ের জল অনেক গড়িয়েছে। পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে সব জায়গায়। সমাজ বুঝতে শিখেছে নারীকে বাদ দিয়ে জীবনমান উন্নয়নের কথা বলা বৃথা। নারী-পুরুষকে একসঙ্গে নিয়ে বলতে হবে। তাই আজকের দিনে জেন্ডার ও ক্ষমতায়ন ডিসকোর্স একসঙ্গে উচ্চারিত হয়।

বর্তমানে আমাদের সরকার ডিজিটাল শব্দটি চালু করেছে। শব্দটিকে ব্যবহার করার প্রক্রিয়া গ্রহণ করেছে এবং নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাইকে এর আওতায় এনে আধুনিক প্রযুক্তিকে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত নিয়ে যেতে চাইছে। আমরা আশাবাদী, এ বছরের আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় আমাদের নারীদের অনেকটা পথ এগিয়ে নিয়ে যাবে। ৎ

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads