• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

বরেন্দ্রভূমি ও ভূগর্ভের পানিস্তর

  • প্রকাশিত ০৬ মে ২০১৮

‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে/বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল থাকে’- বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কালজয়ী এ কবিতার দুটো চরণ দিয়ে আজকের লেখা শুরু করা যাক। কবিতাটি মনে পড়লে শাশ্বত গ্রামবাংলার চিরচেনা নদীর বিমোহিত রূপ চোখের সামনে উদ্ভাসিত হয়। কিন্তু এ কথা সত্য যে, আজ আর কবিগুরুর দেখা ছোট নদীগুলোয় বৈশাখে হাঁটুজল থাকে না, গরুর গাড়িও পার হয় না। কে জানত, কবিগুরু রবিঠাকুরের এ কবিতার হূদয়গ্রাহী বাস্তবতা একদিন জীবনধর্মী স্বার্থের প্রতিঘাতে মলিন হয়ে যাবে?

ছোটবেলায় মহানন্দা নদীর সঙ্গে আমার একটা সখ্য ছিল। বলা যায়, হূদয়ের অকৃত্রিম টান। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলাশহরের শিবতলায় আত্মীয় বাড়িতে আমার ঘন ঘন যাতায়াত ছিল। ওই আত্মীয় বাড়ির কৈশোরের সাথি বন্ধুর সঙ্গে সিনেমা দেখাসহ আরেকটা কাজ ছিল মহানন্দায় ডুব-সাঁতারে দুরন্তপনা করা। কখনো বা ঢালু তীরে বসে মুগ্ধ নয়নে ধ্যানী বকের মতো চেয়ে চেয়ে দেখেছি রঙিন পালতোলা নৌকার অবিরাম ছুটে চলা, শুনেছি সুকণ্ঠী মাঝির প্রাণখোলা গানের সুর। আর মহানন্দার রেহাইচরের ঘাটে ঘন বর্ষায় দেখেছি ওই নদীর উত্তাল তরঙ্গ, দেখেছি দামাল ছেলেদের সাহসী সাঁতার— বিক্ষুব্ধ নদীর উথালপাথাল জলতরঙ্গে তেজি যুবকদের ঝাঁপ দিয়ে চোখের পলকে এপার-এপার হওয়া। তাদের সে কী সাহসিকতা! নদী সাঁতরে চেহারায় সে কী উৎফুল্লতা— তা একবার না দেখলে বোঝা যাবে না। কিন্তু আজ আর সেই মহানন্দার বারোমাসি জল ছলাৎ-ছল নেই, মাঝিরাও গান গায় না, যুবকরাও সাঁতার কাটে না- এখন যেন সবই ফেলে আসা অতীত।

শুধু মহানন্দা নয়, এর নিকটবর্তী যে পদ্মা, দেশের অন্যতম নদীর একটি; যা চাঁপাইনবাবগঞ্জ রাজশাহী হয়ে দেশের নানা জেলা ছুঁয়ে নিপতিত হয়েছে বঙ্গোপসাগরে— সেই খরস্রোতা পদ্মাও আজ মরা নদীর গহীন বালুচর। উজানে বাঁধ দিয়ে পানির গতি ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করায় আজ মূল নদীতে দেখতে হচ্ছে এ ধু-ধু মরুর চিত্র।

কী বর্ষা, কী গ্রীষ্ম— সব ঋতুতেই মহানন্দার রূপসী চেহারা দেখার সুযোগ হয়েছে। কিন্তু আজ আর মহানন্দার সেই দুরন্ত যৌবন নেই, নেই থই থই পানি। আর এর প্রভাব গিয়ে পড়ছে প্রকৃতির বিস্তৃত আঙিনায়। মাঝে মাঝে পরিবেশবিদ কিংবা গবেষকদের শঙ্কিত হয়ে বলতে শোনা যায়, এ অঞ্চল একদিন মরুভূমি হয়ে যাবে।

শুধু উজানের বাঁধকে দোষ দিয়ে কী হবে? আমরাই বা কম কীসে? প্রাচীন বড় গাছগুলো কেটে নেওয়া হচ্ছে। বনায়নের নামে ইউক্যালিপটাস, ইপিল ইপিল ও শিশু গাছ লাগানো হচ্ছে। বট, পাকুড়, শিমুল, আম, জাম, বেল, তাল প্রভৃতি দেশি জাতের বৃক্ষরাজি ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। পাখিরা হারাচ্ছে নীড়, সেই সঙ্গে ওদের খাদ্যসঙ্কটও প্রকট হচ্ছে। আশ্রয় ও খাদ্য জোগানো গাছ বিলুপ্ত হলে পাখিরাই বা কী খেয়ে বাঁচবে আর কীভাবেই বা প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা পাবে।

গাছ নিধনের কারণে কার্বন-ডাই অক্সাইডের মাত্রা কমানোর মতো প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে? এ কারণে বৃষ্টিপাতের মাত্রা ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। তাই এখন বর্ষাকালেও কৃষকরা বৃষ্টিসঙ্কটের দুশ্চিন্তায় ভোগেন। আর তখন অনাবৃষ্টি শুরু হলে ফসল বাঁচানোর চাপটা গিয়ে পড়ে গভীর নলকূপের মাধ্যমে ভূ-গর্ভের পানির স্তরের ওপর।

যে কারণে এত কথা বলা— দেশের উত্তরাঞ্চলে বরেন্দ্রভূমির কোনো কোনো এলাকায় ভূ-গর্ভের পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। অকেজো হয়ে যাচ্ছে হস্তচালিত নলকূপ। সেই সঙ্গে গভীর নলকূপগুলোয় পর্যাপ্ত পানি উঠছে না। ফলে দেখা দিচ্ছে পানিসঙ্কট। এমন একটি সংবাদ জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছে।

পানি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ডাসকো ফাউন্ডেশনের উদ্ধৃতি দিয়ে সংবাদটিতে আরো বলা হয়েছে, এ অঞ্চলের পানির স্তর দিন দিন নিম্নগামী হচ্ছে। সমন্বিত পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের আওতায় ২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোগে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ঝিলিম ইউনিয়নে পানির স্তর পরিমাপের জন্য একটি কূপ বসানো হয়েছিল। ওই কূপে ২০১৫ সালে পানির স্তর ছিল ১০১ ফুট নিচে। ২০১৭ সালে পাওয়া যায় ১০৯ ফুট নিচে। দুই বছরে পানির স্তর ৮ ফুট নেমে গেছে। আর পানির স্তর অবনমনের জন্য নদীগুলোর উজানি বাঁধকেও দায়ী করা হচ্ছে। কারণ ভূ-স্তরের উত্তোলিত পানির শূন্যতা নদীর উপরিভাগের পানির মাধ্যমে পূরণ হয়।

জেলার শুধু ঝিলিম ইউনিয়নই নয়, নাচোল ও গোমস্তাপুর উপজেলাসহ পুরো বরেন্দ্র অঞ্চলে এভাবেই কমছে পানির স্তর। এক যুগ আগেও এসব অঞ্চলে ৬০ থেকে ৭০ ফুট গভীরে পানি পাওয়া যেত। বর্তমানে কোথাও কোথাও ১৫০ ফুট বা তারও নিচে পানি চলে গেছে। বিষয়টি সচেতন মহলকে উদ্বিগ্ন করছে বৈকি।

দেশের অপেক্ষাকৃত উঁচু এলাকা উত্তরাঞ্চলের বরেন্দ্রভূমি। চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নাটোর ও নওগাঁর কিছু উপজেলা নিয়ে এ বরেন্দ্রভূমি গঠিত। উঁচু-নিচু টিলাজমিগুলোয় আগে বছরে একটি করে ফসল চাষ হতো। বছরের বাকি সময় মাঠের পর মাঠ ফাঁকা পড়ে থাকত। সারাবছরই ঘরে ঘরে অভাব লেগেই থাকত।

তৎকালীন সরকার এই উঁচু ভূমির অধিবাসীদের জীবনমান উন্নয়নে বরেন্দ্র প্রকল্প প্রণয়ন করেছিল। কাঙ্ক্ষিত সুফল প্রাপ্তির কারণে পরে সেটি বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ নামে বর্ধিত মেগা প্রকল্পে রূপ লাভ করে। ওই প্রকল্পের অধীনে হাজার হাজার গভীর নলকূপ বসানো হয়। সেই থেকে এখনো সারাবছর সবুজ ফসলে ভরপুর থাকে বরেন্দ্রভূমি। উৎপাদিত ফসলের উদ্বৃত্ত অংশ চলে যায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। বরেন্দ্র প্রকল্প বাস্তবায়িত না হলে ক্রমবর্ধমান মানুষের খাদ্যের চাপ মোকাবেলা করা কতটা সম্ভব হতো সেটাও একটা অন্তহীন জিজ্ঞাসা।

সে সঙ্গে এ উন্নয়নমুখী প্রকল্পের অধীনে হয়ে গেছে পাকা রাস্তা ও ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ। যোগাযোগের নয়া বিপ্লব ঘটেছে এ অঞ্চলে। সুচিন্তিত এ প্রকল্প দূরকে করেছে কাছে। গ্রামকে এনেছে শহরের সান্নিধ্যে। কিন্তু তাতেই কি সব? দিন দিন নির্বিচারে গভীর নলকূপ দিয়ে পানি উত্তোলনের কারণে সমস্যা প্রকট হচ্ছে।

ভূগর্ভের পানির স্তর নিম্নগামী হওয়ার জন্য জেলার দুই প্রধান নদী পদ্মা ও মহানন্দার পানিশূন্যতাকেও দায়ী করেছেন পরিবেশবিদরা। চাঁপাইনবাবগঞ্জে প্রকৃতি ও পরিবেশ নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা সেভ দ্য ন্যাচারের মতে, প্রতিটি নদ-নদীর উজানে প্রতিবেশী দেশ বাঁধ দিয়ে পানি প্রত্যাহার করে নেওয়ায় নদীগুলো শুষ্ক মৌসুমে পানিশূন্য হয়ে পড়ে। এর প্রভাবে ভূগর্ভে পর্যাপ্ত পানির রিচার্জ হচ্ছে না। ফলে শুধু বরেন্দ্র অঞ্চলেই নয়, পুরো জেলাতেই পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। এভাবে পানিশূন্যতার রূপ দেশবাসী দেখে আসছে; যার প্রভাব ভূ-গর্ভের পানির স্তরে গিয়ে সঙ্কটের রূপ লাভ করছে।

যাক, শুষ্ক মৌসুমে আবহাওয়াগত কারণে প্রকৃতি শুষ্ক থাকে। ইরি মৌসুমে নিচু প্রকৃতির বিল এলাকায় প্রচুর ধানচাষ হয়। একই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলে উঁচু জমিতে ধানচাষ। ধানক্ষেতে বেশির ভাগ সময় পানি ধরে রাখা প্রয়োজন হয়। এ কারণে ভূগর্ভের পানি উত্তোলনে পানিস্তরে বেশি চাপ পড়ে। এসব এলাকায় বিকল্পচিন্তা হিসেবে ধানের পরিবর্তে গম চাষ করলে পানির ব্যবহার কয়েক গুণ কম হতো। কিন্তু তা না করে কৃষকরা প্রতিযোগিতা করে ধানচাষেই ঝুঁকছেন। তাই প্রকৃতির বিরূপতা থেকে বাঁচতে বিকল্প চিন্তা প্রয়োগ করা দরকার। প্রয়োজনে ভূগর্ভের পানির ব্যবহারের চাপ কমাতে কোন এলাকায় কম পানির কোন ফসল চাষ করা যাবে, তার নির্দেশনা সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে দিয়ে দেওয়া দরকার, কম সেচ লাগে এমন ফসল চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা দরকার।

ভারত আমাদের প্রতিবেশী বন্ধু দেশ। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে আমাদের পরীক্ষিত বন্ধু। উজানের নদীগুলো থেকে বছরের পর বছর পানি প্রত্যাহার করায় আমাদের নদীগুলো শুকিয়ে যাওয়ার কারণে পানির স্তর যে রিচার্জ হচ্ছে না, তার প্রকটতা নিয়ে কূটনৈতিকভাবে আলোচনা করতে হবে। পানি সমস্যার সমাধান করতে  না পারলে অদূর ভবিষ্যতে ভয়াবহ জলবায়ু সঙ্কট তৈরি হবে— এ আশঙ্কা একবারে উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়।

সত্যেন সেনের একটি বই ‘আমাদের এই পৃথিবী’ অনেকে পড়ে থাকতে পারেন। বইটিতে বায়ুস্তর ও পানিস্তর নিয়ে ব্যাপক বিস্তৃতির চিন্তা সমন্বিতভাবে তুলে আনা হয়েছে। পানিস্তরের পরিচালন ব্যবস্থা নিয়ে অনেক কিছু বলা হয়েছে— যা প্রকৃতির নিয়ম মেনে প্রবাহিত হয়ে আসছে। সঙ্কট তখনই সৃৃষ্ট হয় যখন মানুষ প্রকৃতিবিরোধী কর্মে উর্বর মস্তিষ্ক সঞ্চালনা করে। উন্নয়নের মত্ত চিন্তায় প্রকৃতির বিরূপতার কথা মাথায় রাখে না। ফলে সমগ্র ধরণি ক্ষতির ঝুঁকিতে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যায়।

আমাদের উজানের দেশ বড় বড় স্লুইসগেট যুক্ত ব্রিজ নির্মাণ করে পানি প্রত্যাহার করে নিয়ে নিজের দেশকে আরো সুজলা-সুফলা করছে। ওই দেশের নাগরিকদের জীবনে আসছে অর্থনৈতিক স্বাচ্ছদ্য। আর বিপরীতে আমরা শুষ্কতায় আক্রান্ত হয়ে পানিসঙ্কটে ভুগছি। এই বিরূপতার প্রভাব নানাভাবে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে পড়ছে, এ কথাও ভাবতে হবে।

এসব সমস্যা যেন আগামী দিনগুলোয় আরো ঘনিয়ে না আসে— সেজন্য সর্তকতা অবলম্বন করতে হবে সচেতন মানুষকে। কোনো দেশের সীমানা মেনে নয়, নদীগুলোর পানিপ্রবাহ নির্বিঘ্ন করতে হবে প্রকৃতির নিয়ম মেনে। বনায়নে আঞ্চলিক গাছের প্রাধান্য বৃদ্ধি করতে হবে। ভূগর্ভ থেকে উত্তোলিত পানির ব্যবহারে মিতব্যয়িতা নিশ্চিত করতে হবে। কোন ফসল কম পানিতে আবাদ হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। আর এই বিষয়গুলোর সুব্যবস্থাপনার জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নজরদারি জোরদার করতে হবে। তাহলেই কেবল প্রকৃতির বিরূপতা থেকে মানুষ রক্ষা পেতে পারে। এ বিষয়ে আমাদের সবাইকে আরো সচেতন হওয়া দরকার।

 

মোবারক হোসেন

অর্থনীতি বিশ্লেষক

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads