• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
জাতীয় ঐক্য : দোলাচলে জনগণ

নাগরিক সমাবেশের দিন মঞ্চে জাতীয় ঐক্যের নেতারা

সংগৃহীত ছবি

মতামত

জাতীয় ঐক্য : দোলাচলে জনগণ

  • ফাইজুস সালেহীন
  • প্রকাশিত ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮

বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের আনুষ্ঠানিক যাত্রার পর দুদিন যেতে না যেতেই ড. কামাল হোসেন ধন্দে ফেলে দিয়েছেন বিবিসির সঙ্গে দেওয়া সাক্ষাৎকারে। তিনি স্পষ্ট বলেছেন, এই সরকারের অধীনে নির্বাচনে যেতে তার দল গণফোরামের আপত্তি নেই। নির্বাচন হতে হবে আইন অনুযায়ী। নির্বাচন কমিশন রেফারির ভূমিকা পালন করবে। বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য কোনো নির্বাচনী জোট নয়। এটা নিরপেক্ষ নির্বাচন আদায়ের জন্য গঠিত হয়েছে। চাইলে সরকারি দলও এই জোটে আসতে পারে। ঐক্যের অন্যতম প্রধান নেতা যখন এরকম বললেন, সঙ্গত কারণেই তখন সদ্য ফোটা জাতীয় ঐক্যের ফুলে ফল দেবে কি-না তা নিয়ে দেখা দিয়েছে ঘোরতর সন্দেহ। এদিকে অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী গত মঙ্গলবার যা বলেছেন, তাতে পরিষ্কার যে, বিএনপির সঙ্গে এখনো তাদের ঐক্য হয়নি। আদৌ হবে কি-না, সে সিদ্ধান্ত ২৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠেয় বিএনপির সমাবেশের পর। ওই সমাবেশে জামায়াতের সঙ্গ বিএনপি ছাড়ছে কি-না, তার ওপর নির্ভর করছে দলটির সঙ্গে যুক্তফ্রন্টের ঐক্য না অনৈক্য। বিএনপি জামায়াতকে না ছাড়লে ঐক্য হবে না। বিএনপির আমীর খসরু মাহমুদও বলেছেন, ২৯ সেপ্টেম্বরের সমাবেশে জাতীয় ঐক্য সম্পর্কে বিএনপির অবস্থান পরিষ্কার করা হবে। শনিবার মহানগর নাট্যমঞ্চের সমাবেশ থেকে সর্বসম্মত ঘোষণায় কী বলা হলো আর সেই গরম চায়ে চুমুক দেওয়ার আগেই কী বলছেন শরিক নেতারা! নাটকের সেই মঞ্চে মাহমুদুর রহমান মান্না বললেন, জাতীয় ঐক্য তো হয়েই গেল। এরপর দুটি রাত না যেতেই এখন অন্যকথা। তাহলে কি নাট্যমঞ্চে একটা নাটকই হয়ে গেল! ঐক্যপ্রত্যাশী সাধারণ সমর্থকরা এরকম ভেবে হতাশার মধ্যে যে পড়েছেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। পক্ষান্তরে যারা এই ঐক্যপ্রয়াসে তিক্তবিরক্ত, অনবরত যারা কটাক্ষ করে যাচ্ছিলেন, তারা ডুগডুগি বাজিয়ে বলতেই পারেন, বলেছিলাম না ঐক্যফৈক্য কিছু না, দুদিনও টিকবে না।

কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কী ঘটতে যাচ্ছে, সেই জটিল পাটিগণিতের ফল নির্ণয় করা অতটা সহজ বলে মনে হয় না। সরল অঙ্কের চাইতে অনেক বেশি কঠিন রাজনীতির সরলাঙ্ক। রাজনীতি রসায়নের সূত্রে বাঁধা নয় যে, পানি ভাঙলে হাইড্রোজেন আর অক্সিজেন পাওয়া যাবেই। আসলে রাজনীতির মুখ দুটি। একটি আদি অকৃত্রিম মাউথ, আরেকটি মুখোশ। দুটি মুখই সমানভাবে সক্রিয় মঞ্চে ও নেপথ্যে। কোন কথাটা মুখ বলছে আর কোন কথাটা মুখোশের, তা ধরে ফেলা সাধারণ মানুষের কম্ম নয়। তারা দেখে ও শুনেই হাততালি দিতে শুরু করেন অথবা মন্দচারি করেন। কিন্তু কানে যা শোনা যায়, চোখে যা দেখা যায়, রাজনৈতিক বিচারে তা সবসময় সত্য হওয়া জরুরি নয়। কেননা চোখ ও কানের আড়ালে রাজনীতির যে আরেকটা মাঠ আছে, সেটা কম বড় নয়। সদর ও অন্দরের এই পাশা খেলাকে রাজনৈতিক পরিভাষায় বলা হয় স্ট্র্যাটেজি- রণকৌশল। রণকৌশল শব্দটা অবশ্য বামপন্থিদের। অ-বামরা একেই বলেন কৌশল। রাজনীতির এই কৌশল পড়ার জন্য অনুমানবিদ্যার চর্চা কম্পলসারি, যদিও এই নামে প্রথাগত কোনো বিদ্যা নেই। এই অনুমানবিশারদদের আমরা রাজনৈতিক জ্যোতিষীও বলতে পারি। সেদিন ফেসবুকে দেখলাম অতিপরিচিত এক সম্পাদক, টকার ও রাজনৈতিক জ্যোতিষী স্ট্যাটাস দিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে, সামনের মেয়াদেও আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করবে। বিএনপি হবে পার্লামেন্টের শক্তিশালী বিরোধী দল। কী জানি, হলে হতেও পারে!

এই বেলায় আমরাও বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে কিঞ্চিৎ অনুমানবিদ্যার চর্চা করতে পারি বৈকি! অনুমান সত্য বলে প্রমাণিত হতেই হবে, এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। তবে পূর্বাপর ঘটনাপ্রবাহ ও কথামালার প্রজ অ্যান্ড কন্স- কার্যকারণ বিচার করে আমরা এখানে এই চর্চাটা করব। এতে আশা করা যায় সত্যের কাছাকাছি পৌঁছা যাবে। অনুমান বলছে, জাতীয় ঐক্য ভেঙে ছত্রখান হয়ে গেল মনে করে যারা ডুগডুগি বাজাতে শুরু করেছেন, শিগগিরই তারা আবার হতাশ হবেন। কারণ বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের যে রঙধনু চা টেবিলে এসেছে, তা অত তাড়াতাড়ি জুড়িয়ে যাবে না। নেতারা এখন যা যা বলছেন, তার কোনোটাই নতুন কথা নয়। আকারে-প্রকারে এই কথাগুলো আগে থেকেই তারা বলে আসছেন। জামায়াত কিংবা স্বাধীনতাবিরোধী কোনো দলের সঙ্গে ঐক্য নয়- এ কথা যারা বলছেন, তারা খুব ভালো করেই জানেন যে, বিএনপির ছায়াসঙ্গী জামায়াতে ইসলামী। ঐক্য প্রক্রিয়া ও যুক্তফ্রন্টের নেতারা তো জানেনই, অধ্যাপক বি চৌধুরীর এই সখ্যের কথা না জানার কোনো কারণই থাকতে পারে না। ডা. চৌধুরী প্রবীণ ও বিদগ্ধ রাজনৈতিক পার্সোনালিটি। তিনি আমাদের পরম শ্রদ্ধাভাজন। কিন্তু পাবলিক ফিগার হিসেবে আমরা তার কথা ও কাজের মিঠেকড়া আলোচনা করতেই পারি। আশা করি তিনি বেয়াদবি নেবেন না। জিয়াউর রহমানের ইমিডিয়েট পরের সারিতে তিনি বিএনপির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। শাহ আজিজুর রহমান যখন প্রধানমন্ত্রী, বি. চৌধুরী তখন বিএনপির ডাকসাইটে নেতা।  জামায়াতে ইসলামীকে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতিতে জায়গা করে দেওয়া, অধ্যাপক গোলাম আযমকে দেশে ফিরে আসার পথ করে দেওয়ার কালপর্বেও তিনি ছিলেন বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক বলয়ের অন্যতম নীতিনির্ধারক। কাজেই আজকে যখন তিনি স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির বিপক্ষে উচ্চকণ্ঠে বলেন, তখন এটি মুখের কথা না মুখোশের, তা নিয়ে সন্দেহ দেখা দেওয়া বিচিত্র নয়। সত্যি কথা বলতে কি, স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগবিরোধী যতগুলো রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম তৈরি হয়েছিল, তার কোনোটাতেই স্বাধীনতাবিরোধীদের প্রবেশাধিকার কার্যত নিষিদ্ধ ছিল না; বরং ক্ষেত্রবিশেষে একাত্তরের স্বাধীনতাবিরোধীরা পৃষ্ঠপোষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল। এগুলো ইতিহাসের সত্য। এখন সময় বদলেছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ইন্টেলেকচুয়ালি এবং পলিটিক্যালি স্বাধীনতাবিরোধী ইস্যুটি খুবই পপুলার। বি. চৌধুরীর মতো পোড়খাওয়া নেতারা এই পপুলার ইস্যুটিকে অ্যানক্যাশ করতে চাইবেন, এটাই তো স্বাভাবিক। তিনি এবং সহমত পোষণকারী অন্য নেতারা খুব ভালো করেই জানেন, বিএনপিকে ছাড়া ঐক্যপ্রক্রিয়া ও  যুক্তফ্রন্টের পক্ষে সরকারের আমলে নেওয়ার মতো কোনো রাজনৈতিক চাপ তৈরি করা সম্ভব নয়। লোকে বলে, নাট্যমঞ্চে বিএনপির মানুষ না এলে মিলনায়তনের বহু আসন হয়তো খালি পড়ে থাকত। পক্ষান্তরে বিএনপিও জানে যে, বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যে থাকা তার জন্য জরুরি। তা না হলে পিঞ্জিরার পাখি উড়ে যাবে। মাইনাস বিএনপি একটা ‘বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য’ ঠিকই হয়ে যাবে। সে তো হয়েও গেছে। বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য নির্বাচনী মোর্চায় রূপান্তরিত হয়ে কিংবা ড. কামাল হোসেনের ঐক্যপ্রক্রিয়া ও বি. চৌধুরীর যুক্তফ্রন্ট আলাদা আলাদাভাবে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গঠিত নিবাচনপূর্ব স্কেলিটন সরকারের অধীনে শাসনতন্ত্র নির্দেশিত ইলেকশনে শামিল হয়ে যাবে। এইচ এম এরশাদ তো বলেই রেখেছেন যে, বিএনপি ভোটে না এলে জাতীয় পার্টি তিনশ আসনেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। মাইনাস বিএনপি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনটা মোটামুটি ফেয়ার হলে শাসকদল না করবে না। আওয়ামী লীগের বিচারে সেটা হবে, ‘সাপও মরল লাঠিও ভাঙল না’ ধরনের ঐতিহাসিক বিজয়।

এই বাস্তবতায় কী হতে পারে বিএনপির সঙ্গে যুক্তফ্রন্ট ও ঐক্যপ্রক্রিয়ার একমঞ্চে এক সুরসারিতে মিলিত হওয়ার মন্ত্রটি! যতদূর মনে হয়, ঐক্যপ্রক্রিয়া ও যুক্তফ্রন্ট চাইছে যে, বিএনপি জামায়াতকে ত্যাগ করতে না পারুক, তাকে ঘোমটা পরিয়ে অন্দরমহলে আটকে রাখুক। এই কাজটি বিএনপির জন্য কঠিন হবে যদি জামায়াত ঘোমটা পরতে রাজি না হয়। তবে রাজি না হওয়ার কোনো কারণ নেই। কেননা দলটির নির্বাচন করার অনুমতি নেই, কার্যত নিষিদ্ধ। এক্ষণে বিএনপি তার কাছে অন্ধের যষ্ঠিস্বরূপ। তার অন্দরে থাকলে যদি সুবিধা হয়, তাহলে থাকতে আর অসুবিধা কী! কমিউনিস্ট পার্টি ব্রিটিশ-ভারত এবং পাকিস্তান আমলে নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু সে মিশে ছিল আওয়ামী লীগের মধ্যে, ভারতে কংগ্রেসের মধ্যে, পাকিস্তানে ন্যাপের মধ্যে তো ছিলই। এটা কমিউনিস্ট রণকৌশল, পরের পোশাক পরে কার্যসিদ্ধি করা। শুনেছি কৌশল নির্ধারণে জামায়াত কমিউনিস্টদের মতোই।

এখন থাকল ড. কামাল হোসেনের বিবিসির সঙ্গে দেওয়া আপাত স্ববিরোধী সাক্ষাৎকার। বর্তমান সরকারের অধীনে তার দলের ইলেকশনে যেতে কোনো আপত্তি নেই। সরকারও ইচ্ছা করলে এই ঐক্যজোটে আসতে পারে। এটা এমন কোনো বেমক্কা কথা নয়, যাতে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য শুরুতেই হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়ে খানখান হয়ে যাবে। নাট্যমঞ্চের সমাবেশ থেকে ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সব দলের সঙ্গে আলোচনা করে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন ও সংসদ ভেঙে দেওয়ার দাবি করা হয়েছে। এই সরকারের পদত্যাগ চাওয়া হয়নি। চাওয়া হয়েছে সংলাপ। সংসদ ভেঙে দেওয়ার দাবিটি হচ্ছে দাবির টেইল। নাট্যমঞ্চে কোনো কোনো নেতা তো স্পষ্টই বলেছেন, নির্বাচন হতে হবে জাতীয় সনদের ভিত্তিতে। বিএনপিও সংলাপ চায়। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও উপর্যুপরি বলে চলেছেন, আওয়ামী লীগকে ছাড়া কোনো জাতীয় ঐক্য হবে না। মোটকথা দলগুলো চাইছে একটি স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ অবাধ নির্বাচন, যাতে প্রতিটি ভোটার নির্বিঘ্নে নির্ভয়ে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন। বাঞ্ছিত এই পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজন জাতীয় ঐকমত্য। সেই ঐকমত্যের জন্যই আসলে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য। তবে এই ঐক্য বিএনপিকে নিয়ে অগ্রসর হবে নাকি দলটিকে পেছনে ফেলে হবে, সেটা বোঝা যাবে ২৯ সেপ্টেম্বর বিএনপির সমাবেশের মধ্য দিয়ে। কাবাব মে হাড্ডি জামায়াতে ইসলামীকে বিএনপি কতটা কীভাবে ম্যানেজ করবে- সেটাই এখন দেখার বিষয়। 

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক

saleheenfa@gmail.com    

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads