• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
দেশে কমছে দারিদ্র, বাড়ছে প্রবৃদ্ধি

নানা রাজনৈতিক টানপড়েনের মধ্যেও বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা ঈর্ষান্বিত

আর্ট : রাকিব

মতামত

দেশে কমছে দারিদ্র, বাড়ছে প্রবৃদ্ধি

  • প্রকাশিত ০২ অক্টোবর ২০১৮

রবিউল ইসলাম

একটা সময় বাইরের বিশ্বের মানুষের কাছে বাংলাদেশ সম্বন্ধে বিভিন্ন নেতিবাচক ধারণা ছিল। কেউ কেউ মনে করত এটি একটি চরম দরিদ্র দেশ, পরনির্ভরশীলতা যাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ব্যঙ্গ করে আমাদের দেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে আখ্যায়িত করেছিল কেউ কেউ। মুক্তিযুদ্ধের পর দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা নাজুক ছিল এবং সেটিই স্বাভাবিক। একটি ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ যাত্রা শুরু করেছিল। বিদেশি সাহায্য তখন অপরিহার্য হয়ে পড়ে। এখন এসব অতীত।

তলাবিহীন ঝুড়ি বা টেস্ট কেস থেকে দেশ এখন দারিদ্র্য বিমোচনে বিশ্বের রোল মডেল। নানা রাজনৈতিক টানপড়েনের মধ্যেও বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা ঈর্ষান্বিত। ৮৫ শতাংশ দারিদ্র্য নিয়ে যাত্রা শুরু করা দেশটি দ্রুত এই হার কমানোর ক্ষেত্রে নজিরবিহীন সাফল্য অর্জন করেছে। ৭০ ডলার মাথাপিছু আয় নিয়ে যাত্রা করা বাংলাদেশ তিনটি শর্তই পূরণ করে উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি পেতে যাচ্ছে ২০২৪ সালে। বর্তমানে মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৭৫২ ডলারে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, দারিদ্র্য হ্রাস, উচ্চ প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিসহ টেকসই উন্নয়নে বাংলাদেশের বড় সফলতা এসেছে গত ১০ বছরে। সরকারের ধারাবাহিকতার সঙ্গে উন্নয়ন নীতি কৌশল বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতায় এটি অর্জন সম্ভব হয়েছে। অবকাঠামো খাতে দৃশ্যমান উন্নয়নের পাশাপাশি সামাজিক ও মানবসম্পদ উন্নয়ন সূচকেও দেশ এগিয়ে গেছে অনেকটা। ২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর পর্যন্ত বর্তমান সরকারের আমলে এসব ক্ষেত্রে যেসব উন্নয়ন হয়েছে তা আশাতীত। মঙ্গাপীড়িত অঞ্চলে যেখানে দরিদ্রতা বাসা বেঁধেছিল কঠিনভাবে, সেটি দূর করা সম্ভব হয়েছে। এখন আর কেউ বসে নেই। প্রায় সবাই কাজ করে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিদ্যুৎ অথবা সোলার পৌঁছে গেছে। একজন শ্রমিকের ঘরেও এখন টিভি, ফ্রিজ, মোবাইল দেখা যাচ্ছে। যে যুবক আগে বেকার বসে থাকত সে এখন অটো চার্জার চালিয়ে দিনে ৭০০-৮০০ টাকা রোজগার করছে। বেকারত্ব কমেছে।

স্বাধীনতার ২৯ বছর পর ২০০০ সালে দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪৮.৯ শতাংশ। অর্থাৎ প্রতি দশজনে পাঁচজনই দরিদ্র। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সর্বশেষ যে জরিপ করেছে তাতে এই হার কমে দাঁড়িয়েছে ২৪.৩ শতাংশ। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি) চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছর শেষে দেশে দারিদ্র্যের হার ২১ শতাংশ প্রক্ষেপণ করেছে। অর্থাৎ বর্তমানে প্রতি ১০ জনে দুজন দারিদ্র্যসীমার নিচে রয়েছে। আর চলতি অর্থবছর শেষে তা আরো কমে ১৯.৮ শতাংশে দাঁড়াবে বলে প্রাক্কলন করেছে জিইডি।

জিইডি জানাচ্ছে, এক দশক আগে বর্তমান সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে ২০২১ সালের মধ্যে সুনির্দিষ্ট কিছু লক্ষ্য অর্জনের পরিকল্পনা করে। যে কারণে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি দারিদ্র্য বিমোচন হয়েছে। সরকার ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করেছে। এতে প্রায় এক কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হবে বলে আশা করা হচ্ছে। সরকারি সূত্র বলছে, প্রতিবছর যেখানে ২০ লাখ তরুণ কর্মবাজারে প্রবেশ করে, সেখানে গত ১০ বছরে সরকারের উদ্যোগে ১ লাখ ৮২ হাজার ৭৫৬ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া সম্ভব হয়েছে। আর ২০১০ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত সাত বছরে দেশে ৬৩ লাখ মানুষের নতুন কর্মসংস্থান হয়েছে, বিদেশে গেছে ৫১ লাখ।

সরকার আশা করছে ২০৩০ সাল নাগাদ দেশে দরিদ্র্যের সংখ্যা কমে দাঁড়াবে ১০ জনে একজন। উন্নত দেশগুলোতেও ১০ শতাংশ দারিদ্র্য থাকে। এই পরিমাণ দারিদ্র্য কখনো দূর করা যায় না। কারণ নদীভাঙন, প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ সামাজিক বিভিন্ন কারণে দারিদ্র্যসীমার ঊর্ধ্বে থাকা কিছু মানুষ হঠাৎ করেই দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যেতে পারে। তবে ২০৩০ সালের পর দেশে অতি দারিদ্র্য বলতে যা বোঝায়, তেমন মানুষ থাকবে না বলে আশা করছে সরকার।

বিশেষজ্ঞদের মতে, সারা দেশে চলমান উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে কাজের সুবিধা বৃদ্ধি, প্রচলিত কৃষি খাত বাণিজ্যমুখী কৃষিতে রূপান্তর, প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিদ্যুতায়ন, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী, বেসরকারি খাতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি ও প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্স দারিদ্র্য বিমোচনে বড় ভূমিকা রাখছে। এ ছাড়া আশ্রয়ণ প্রকল্প, একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পসহ বিশেষ এলাকার উন্নয়নের জন্য সরকার বিশেষ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে, যা দারিদ্র্য বিমোচনে সহায়ক। দারিদ্র্যের হার কমার পাশাপাশি বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয়ও বেড়েছে। ২০০৬ সালে যা ছিল ৫৪৩ ডলার, ২০১৬ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ৬১০ ডলারে। বর্তমানে তা ১ হাজার ৭৫২ ডলার।

বৈশ্বিক গবেষণা সংস্থা প্রাইসওয়াটার কুপারসের (পিডব্লিউসি) প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০৫০ সালে বাংলাদেশ বিশ্বের ২৩তম বৃহৎ অর্থনৈতিক দেশে পরিণত হবে। ওই সময় বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার হবে ০.৬ শতাংশ। গড় মাথাপিছু প্রকৃত আয় বাড়বে ৪.১ শতাংশ এবং দেশীয় মুদ্রায় গড় জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার হবে ৪.৮ শতাংশ। ওই সময় এই তিনটি সূচকে শুধু ভারত ও ভিয়েতনাম বাংলাদেশের চেয়ে ভালো করতে পারবে।

সবশেষে বলা যায়, দারিদ্র্যের মধ্যেই বাংলাদেশের জন্ম। বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে ২০২১ সাল মেয়াদি উন্নয়নের রূপকল্প গ্রহণের মাধ্যমে তা বাস্তবায়ন করছে। আয় বৈষম্য কমাতে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি নিয়েছে। গ্রামাঞ্চলে সড়ক অবকাঠামো ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। কৃষির আধুনিকায়ন হতে চলেছে। উৎপাদন ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তনের সুবাতাস বইছে। বিদ্যুতায়ন আশাতীত পর্যায়ে হয়েছে। এসব কারণে এ কথা বলা যায় যে, আমাদের দারিদ্র্য কমেছে, মাথাপিছু আয় বেড়েছে। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা সফলতার সঙ্গে বাস্তবায়নের পাশাপাশি বাংলাদেশ ২০৩০ সাল নাগাদ জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়নে সর্বাত্মকভাবে কাজ করছে। এতে আগামী দিনে দারিদ্র্য আরো কমবে, বাড়বে মাথাপিছু আয়। আর এসবের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে বলে আমরা আশাবাদী। বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকলে বাংলাদেশ আরো এগিয়ে যাবে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূলমন্ত্র ছিল অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন। সমতাভিত্তিক বাংলাদেশ। বর্তমান সরকার সেই সোনার বাংলা গঠনে এগিয়ে চলেছে। সাধারণ জনগণও তা দেখতে চায়।

লেখক : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক



আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads