• সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪২৯
সুরক্ষিত নয় নারী চা-শ্রমিক

নারী চা-শ্রমিক

সংগৃহীত ছবি

মতামত

ভিন্নমত

সুরক্ষিত নয় নারী চা-শ্রমিক

  • প্রকাশিত ০২ অক্টোবর ২০১৮

সেলিম আহমেদ

‘দুটি পাতা একটি কুঁড়ি’ বললে প্রথমেই আমাদের মানসপটে ভেসে আসে সবুজে ঘেরা চা বাগানের উঁচু-নিচু আঁকাবাঁকা টিলায় বেষ্টিত অনিন্দ্য সুন্দরের সমারোহ। আবার প্রতিদিন সকালে কিংবা কাজের ফাঁকে চায়ের কাপে চুমুক না দিলে দূর হয় না ক্লান্তি। এক কাপ চা পানের মাধ্যমে নিঃশ্বাস ফেলি সজীবতার। কিন্তু এই চা উৎপাদনে জড়িতদের নিয়ে কেউ কি কখনো চিন্তা করেছেন। কয়জনই বা জানি এসব মানুষের নিষ্পেষিত জীবন ব্যবস্থার কথা! আজ থেকে বহু বছর আগে ব্রিটিশ শাসনামলে ভারত উপমহাদেশে বিভিন্ন রাজ্য থেকে আগমন ঘটে তাদের। এরপর থেকে বংশ পরম্পরায় তারা কাজ করছে চা বাগানে।

চা বাংলাদেশের অন্যতম একটি বৃহৎ শিল্প। জাতীয় অর্থনীতিতে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও এর নেপথ্যের মানুষগুলো নানা বঞ্চনা আর অবহেলার শিকার। চা শিল্পের উন্নয়ন হলেও ভাগ্যের পরিবর্তন হয় না শ্রমিকদের। মধ্যযুগের ভূমিদাসের মতোই চা মালিকের বাগানের সঙ্গে বাঁধা তার নিয়তি।

চা বাগানে পাতা সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত ৯৫ শতাংশ শ্রমিকই হচ্ছেন নারী। চা শ্রমিক নারীদের দিন শুরু হয় সেই কাকাডাকা ভোরে। প্রতিটি নারী শ্রমিককেই তাড়াহুড়ো করে গৃহস্থালির কাজ শেষ করে, ছোট ছোট সন্তানদের রেখে দলবেঁধে ছুটতে হয় বাগানপানে। এক চিমটে লবণ চা দিয়েই সকালের যাত্রা শুরু হয় চা শ্রমিকের। রোদ, বৃষ্টি, ঝড়-তুফান সবকিছু মাথায় নিয়েই কাজে থাকতে হয় শ্রমিকদের। এমনকি প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে এসব নারী শ্রমিকের ঝোপঝাড়ই ভরসা, নেই কোনো স্যানিটারি ল্যাট্রিনের ব্যবস্থা। নারী শ্রমিকরা শুধু পাতি (চা পাতা) উত্তোলনের কাজই করেন না, তারা কলম কাটা, চারাগাছ রোপণ থেকে শুরু করে গাছের আগাছা পরিষ্কার করার কাজেও নিয়োজিত থাকেন।

অথচ এসব নারী শ্রমিকের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় উদাসীন বাগান মালিকরা। নেই তাদের পর্যাপ্ত চিকিৎসার সুব্যবস্থা। বাগানে কর্মরত প্রায় নারীকেই দেখা যায় রক্তশূন্যতা, স্বাস্থ্যহীনতা, জন্ডিস, ডায়রিয়া, জরায়ু ক্যানসারসহ নানা রোগে ভুগতে। অসচেতনতা, নোংরা পরিবেশ, পরিচ্ছন্ন পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার অভাব, অপুষ্টিকর খাবার, নালা ও খালের পানির ব্যবহার, বাল্যবিয়ে, বেশি সন্তান নেওয়া, নিয়ন্ত্রণহীন যৌনাচারসহ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাবই তাদের মূলত এসব রোগে আক্রান্ত হওয়ার কারণ। আর্থিক অসচ্ছলতা, ভূমির সমস্যা, লোকবল বৃদ্ধি ও কিছুটা অভ্যাসগত কারণে চা বাগানের শ্রমিকদের ৪৫ থেকে ৫০ শতাংশ পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা নাজুক। বাগান কর্তৃপক্ষ, ইউনিয়ন পরিষদ ও এনজিওসমূহের মাধ্যমে কিছু ল্যাট্রিন বিতরণ করা হলেও বিশাল শ্রমিক পরিবারের মধ্যে সেগুলো পর্যাপ্ত নয়।

চা শ্রমিকদের মধ্যে ১৫ শতাংশ নারী প্রাথমিকভাবে জরায়ুমুখে ক্যানসারে আক্রান্ত— এমন ভয়াবহ তথ্য উঠে এসেছে গবেষণামূলক সংস্থা সিআইপিআরবির এক জরিপে। এতে দেখা গেছে, দেশের মোট ১৬৪টি চা বাগানে প্রায় ৯ লাখ শ্রম-জনগোষ্ঠীর অর্ধেক নারী শ্রমিক। এই অর্ধেক নারী শ্রমিকের ১৫ শতাংশের শরীরে বাসা বেঁধেছে মরণব্যাধি ক্যানসার। মৌলভীবাজারের রাজঘাট, খেজুরীছড়া, আমরাইলছড়া, সাতগাঁও, হোসেনাবাদ, আলীনগর, শমসেরনগর, মিরতিংগা, মাধবপুরসহ ১০টি বাগানে পরিচালিত এক জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেহেতু দেশের সব চা বাগানে কাজের ধরন ও বাসস্থানের পরিবেশ একই, সেহেতু চা বাগানগুলোতে একই অবস্থা থাকার সম্ভবনাই বেশি।

জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) অর্থায়নে জাতীয় স্বাস্থ্য উন্নয়ন ও গবেষণামূলক সংস্থা সিআইপিআরবির কারিগরি সহযোগিতায় ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে মৌলভীবাজার জেলার চা বাগানে প্রজনন ও মাতৃস্বাস্থ্য সেবার মান উন্নয়নে বিবাহিত নারীদের জরায়ুমুখের ক্যানসার শনাক্তকরণের জন্য বিনামূল্যে ‘ভায়া’ টেস্ট কার্যক্রম শুরু হয়েছে। সিআইপিআরবি সূত্রে জানা যায়, মৌলভীবাজারের ৯২টি চা বাগানের মধ্যে ১০টি চা বাগানে মোট তিন হাজার নারীর ভায়া টেস্ট সম্পন্ন হয়েছে। এর মধ্যে ৫১৯ জনের দুরারোগ্য ক্যানসার নামক ব্যাধিটি পজিটিভও এসেছে। এই ভায়া টেস্টের যে ভয়াবহ ফল এসেছে তা চমকে দেওয়ার মতো। তথ্যমতে, চা বাগানে কর্মরত নারীদের শতকরা ১৫ জনের জরায়ুমুখে ক্যানসারের লক্ষণ পাওয়া গেছে। এই কার্যক্রমে অংশ নেওয়া নারীরা সাধারণত ২১ থেকে ৬৫ বছরের। চা বাগানে শিক্ষার অভাব, স্বাস্থ্য সম্পর্কে অসচেতনতা, কাজের নোংরা পরিবেশ ইত্যাদিকে জরায়ুমুখে ক্যানসারের জন্য দায়ী করা হয়েছে।

একজন চা শ্রমিক দৈনিক যে মজুরি পান তা দিয়ে চিকিৎসা করানো দূরের কথা, পরিবারের খরচ জোগানোই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। আর অধিকাংশ চা বাগানের নির্ধারিত কম্পাউন্ডারে (হাসপাতাল) গেলে সব রোগের ওষুধ হিসেবে দেওয়া হয় কয়েকটি প্যারাসিটামল ট্যাবলেট।

চা গাছ ছেঁটে ছেঁটে ২৬ ইঞ্চির বেশি বাড়তে দেওয়া হয় না। চা শ্রমিকের জীবনটাও তেমনি ছেঁটে দেওয়া চা গাছের মতো, লেবার লাইনের ২২২ বর্গফুটের একটা কুঁড়েঘরে বন্দি। বাস্তবিক অর্থে যারা চা শ্রমিকের জীবনযাত্রা কাছ থেকে দেখেছেন তারাই কেবল বলতে পারবেন চা বাগানে সবুজের ছায়াঘেরা ভান্ডারে কতটা অমানবিক ও বর্বর জীবন কাটাতে হয় শ্রমিকদের। বাগানের সবুজের হাসি আমরা খুব দেখতে পাই, কিন্তু দেখতে পাই না কেবল শ্রমিকের কান্না এবং আহাজারি! দেখতে পাই না কীভাবে মাত্র ১০২ টাকা দৈনিক মজুরি দিয়ে জীবন পার করে চা শ্রমিকরা। কখনো ভাবি না সবুজঘেরা বিস্তৃত প্রান্তরে কীভাবে বর্বরোচিত জীবন আজো যাপন করে এই শ্রমিকরা, বিশেষত নারী শ্রমিকরা।

লেখক : সাংবাদিক

selimnews18@gmail.com

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads